All MCQ

ভারত ইতিহাসে যুগ বিভাজন সমস্যা | যুগ বিভাজন সমস্যা কি? ইতিহাস পাঠশালা

১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে History of British India নামে ভারতের ইতিহাস লেখেন জেমস মিল। বইটা লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের অতীতকথাকে এক জায়গায় জড়ো করা। তাঁর ঐ বইতে মিল ভারতের ইতিহাসকে তিনটে ভাগে ভাগ করলেন। সেগুলো হলো— হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ।

ভারতের ইতিহাসে যুগ বিভাজন সমস্যা 


ভারতের ইতিহাসে তিনটে ভাগ পাওয়া যাচ্ছে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক। ‘আধুনিক’ শব্দটা এসেছে অধুনা থেকে । এর মানে বর্তমানকাল, সম্প্রতি বা নতুন। আর সম্প্রতি কিংবা বর্তমানে ঘটেছে যে ঘটনা তাই আধুনিককালের ঘটনা। সেভাবে দেখলে সত্যিইতো কলিঙ্গ যুদ্ধ আজকের দিনের তুলনায় অনেক আগে ঘটেছে। তার অনেক পরে ঘটেছে পানিপতের প্রথম যুদ্ধ। তারও অনেক পরে ঘটেছে পলাশির যুদ্ধ। তাই সময়ের হিসাবে পলাশির যুদ্ধ তুলনায় কম অতীত। তাই সেটা খানিকটা ‘আধুনিক’। আর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সময় যত এগিয়েছে, ততই আরো ‘আধুনিক’ হয়ে উঠেছে ভারতের ইতিহাস। 

কিন্তু এভাবে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এই তিনভাগে ভারতের ইতিহাসকে ভাগ করা শুরু হলো করে? ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রাজাবলি নামে একটি ইতিহাস বই লিখেছিলেন। ভারতের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় সময় গোনা শুরু করেছিলেন মহাভারতের রাজা যুধিষ্ঠিরের কাল থেকে। শেষ পর্যন্ত রাজাবলি কলিযুগের সময়ে এসে শেষ হয়। আজ কেউ ইতিহাস লিখতে গিয়ে 'কলিযুগের ইতিহাস' শব্দ ব্যবহার করবেন না। কিন্তু উনিশ শতকের একেবারে গোড়ায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তাই করেছেন। তাছাড়া রাজাবলিতে প্রায় সব ঘটনার পিছনেই নানা অদ্ভুত সব যুক্তি রয়েছে। রাজাদের কথা বলার জন্যই রাজাবলি লেখা। কিন্তু সেইসব রাজাদের কাজগুলোকে যেন চালায় কোনো অদৃশ্য শক্তি। রাজারা কেবল তাদের কৃতকাজের ফল ভোগ করেন।

আজ যেসব ইতিহাস বই লেখা হয়, তাতে অবশ্য এধরনের কথা বলা হয় না। বরং বিভিন্ন ঘটনার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নানা যুক্তি হাজির করা হয়। তাহলে রাজাবলি-র ইতিহাস লেখার ছকটা কীভাবে বদলাল?

১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে History of British India নামে ভারতের ইতিহাস লেখেন জেমস মিল। বইটা লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের অতীতকথাকে এক জায়গায় জড়ো করা। যাতে সেটা পড়ে ভারতবর্ষ বিষয়ে সাধারণ ধারণা পেতে পারে ব্রিটিশ প্রশাসনে যুক্ত বিদেশিরা। কারণ, যে দেশ ও দেশের মানুষকে শাসন করতে হবে, সেই দেশের ইতিহাসটাও জানতে হবে। অর্থাৎ, ভারতবাসীর প্রতি ব্রিটিশ প্রশাসনের আচরণের যুক্তি নাকি লুকিয়ে আছে ইতিহাসে। সেই আগের নেকড়ে ও ছাগলছানার গল্পটার মতো।

তাঁর ঐ বইতে মিল ভারতের ইতিহাসকে তিনটে ভাগে ভাগ করলেন। সেগুলো হলো— হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ। প্রথম দুটো কালপর্যায় শাসকের ধর্মের নামে। আর শেষটা শাসকের জাতির নামে। তাই শেষটা খ্রিস্টান যুগ হলো না, হলো ব্রিটিশ যুগ। অর্থাৎ ধর্ম নয়, জাতির পরিচয়েই ব্রিটিশ সভ্যতা পরিচিত হতে চায়। আধুনিক হতে হলে ধর্মের বদলে জাতির পরিচয়ের দরকার। তার সঙ্গে মিল লিখলেন যে, মুসলিম যুগ ভারত-ইতিহাসে ‘অন্ধকারময় যুগ। পাশাপাশি হিন্দু যুগ বিষয়েও মিল অশ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন।

মিলের লেখা ইতিহাস থেকে দুটো বিষয় তৈরি হলো। প্রথমত, ভারত ইতিহাসের যুগ ভাগ করা শুরু হলো শাসকের ধর্মের পরিচয়ে। আর মিল ধরে নিলেন প্রাচীন। ভারতের সব শাসকই হিন্দু। তাই জৈন ধর্মাবলম্বী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিম্বিসারের ইতিহাসও ঢুকে পড়ল হিন্দু যুগের ইতিহাসে। একইভাবে মধ্যযুগের সব শাসককেই মিল মুসলমান ধর্মের সঙ্গে একাকার করে দিলেন। ফলে মুঘল সম্রাট আকবরের মতো উদার শাসকও নিছক ধর্মের পরিচয়ে আটকা পড়লেন। দ্বিতীয়ত, ভারতের ইতিহাসকে মিল তিনটে ধাপের ছকে বেঁধে দিলেন। হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ। ধীরে ধীরে সেই তিনটে ধাপ নাম বদলে হয়ে গেল প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক। বছর বছর এই ধাঁচেই চলল ভারতের ইতিহাস চর্চা। সেজন্য পলাশির যুদ্ধ বা মহাত্মা গান্ধির আন্দোলন— সব কিছুকেই আধুনিক ভারতের ইতিহাসের খোপে ফেলে দেওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু, এভাবে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক-এর ছাঁচে ফেলে ইতিহাস দেখাটা সমস্যার। রবীন্দ্রনাথের কথাটা আবার দেখা যাক। সব দেশের ইতিহাস যে একই রকম হতে হবে তার মানে নেই। ঔরঙ্গজেব মারা গেলেন ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর সময়কালকে সাধারণত ভারত ইতিহাসের মধ্যযুগে ফেলা হয়। তার মাত্র অর্ধশতক পরে পলাশির যুদ্ধ হয় (১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ)। পলাশির যুদ্ধকে ফেলা হয় ভারত-ইতিহাসের আধুনিক পর্বে। অথচ বাংলার নবাবি শাসনের আদবকায়দাগুলো মুঘল প্রশাসন থেকেই নেওয়া হয়েছিল। এমনকী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের শাসনকালের প্রথমদিকে মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থাই বহাল রেখেছিল। তাহলে কোন যুক্তিতে ঔরঙ্গজেব মধ্যযুগে পড়বেন আর সিরাজ উদ-দৌলা বা লর্ড ক্লাইভ পড়বেন আধুনিক যুগে ?

আরেক দিক থেকেও বিষয়টা দেখা যায়। সুলতান ইলতুৎমিস যখন মারা যান, তখন মেয়ে রাজিয়াকে দিল্লির শাসনভারের জন্য নির্বাচন করে যান। যথাক্রমে রাজিয়া সুলতান হন। অন্যদিকে অষ্টাদশ শতকে বা তার পরেও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর - জেনারেল বা প্রশাসনিক কর্তার পদে কোনো নারীর খোঁজ পাওয়া যায় না। এখন নারীর শাসনক্ষমতার নিরিখে বিচার করলে কোনটা আধুনিক আর কোনটা আধুনিক নয়? শুধু আগে জন্মেছেন বলেই কী সুলতান রাজিয়াকে মধ্যযুগের বৃত্তে পড়তে হবে?

তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক পর্বে ভেঙে ভারত-ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টার মধ্যে প্রায়ই অতিসরলীকরণ আছে। ‘যুগ” বলতে একটা বড়ো সময়কে বোঝায়। প্রতিটি যুগের মানুষ ও তার জীবনযাপনের নানারকম বৈশিষ্ট্য থাকে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলি রাতারাতি পালটে যায় না। তাই সবসময় যুগ বদলের ধারাকে সময়ের হিসাব কষে ধরে ফেলা যায় না।

আর একটা জরুরি কথা হলো ইতিহাস থেকে বর্তমানের দূরত্ব। এই দূরত্ব সময়ের হিসাবে যত বেশি হবে, ইতিহাসের বিষয় নিয়ে বাদ-বিতর্কের চরিত্র ততই বদলাবে। যেমন, সম্রাট অশোকের ভাবনাচিন্তায় কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রভাব কী? এই নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও, সেই বিষয়টা মানুষের প্রতিদিনের জীবনে আজ আর তত প্রাসঙ্গিক নয়। তাই তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও, সামাজিকভাবে সেই বিতর্ক ততটা জরুরি নয়।

পানিপতের প্রথম যুদ্ধ বিষয়েও কথাটা খানিকটা একইরকম বলা যায়। কিন্তু প্রশ্নটা যদি ওঠে যে, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের বিভাজন কী কোনোভাবেই ঠেকানো যেত না? তাহলে প্রশ্নটা সামাজিকভাবেও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। আজও ভারতবর্ষের অনেক মানুষ ঐ সময়ের দেশভাগের স্মৃতিতে কষ্ট পান। হয়তো তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে দেশভাগ নানারকম ছাপ ফেলেছিল। ফলে, প্রশ্নটা এক্ষেত্রে অনেক সরাসরি বর্তমান সমাজকে ছুঁয়ে যায়। তাই এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যেও নানা বিতর্ক রয়েছে। তেমনি সাধারণ মানুষেরও নানা বক্তব্য থাকা স্বাভাবিক। ফলে দেশভাগ বিষয়ে ইতিহাস লিখতে গেলে খুব নির্লিপ্তভাবে লেখা কঠিন। অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে ইতিহাসের বিশ্লেষণে প্রায়শই ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত মতামত ও ভাবনাচিন্তা বেশি বেশি করে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ইতিহাসের সময় যত দূরের হয়, সেই সম্ভাবনা তত কমে।
Next Post Previous Post
3 Comments
  • নামহীন
    নামহীন ২৬ আগস্ট, ২০২২ এ ৫:৪৮ PM

    Nice

    • Editor
      Editor ২৬ আগস্ট, ২০২২ এ ৫:৫১ PM

      Thank you

  • নামহীন
    নামহীন ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ এ ১০:৫৯ AM

    থ্যাংকস

Add Comment
comment url