গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো

গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো

গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গুপ্ত সম্রাটদের অধীনে ভারত সাম্রাজ্যের পুনর্গঠন ভারতীয় ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় এ কথা উঠে আসে৷ গুপ্ত সম্রাটরা সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাসন যন্ত্রকে প্রজাকল্যান মুখী করে তুলেছিল৷ শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে জনগনের অংশ গ্রহন লক্ষ্য করে ঐতিহাসিক ইউ. এন. ঘোষাল গুপ্ত শাসনকে '... one of the boldest administrative experiments of the imperial Guptas'.

উপাদান

গুপ্ত শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য প্রধান উপাদান গুলি হল,
  • ১. প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান: এলাহাবাদ প্রশস্তি, দামোদরপুর লিপি, বিভিন্ন ভূমি পট্টলী প্রভৃতি৷
  • ২. সাহিত্যিক উপাদান: শুদ্রকের 'মৃচ্ছককটিক', কালিদাসের 'মালবিকাগ্নিমিত্রম', কামন্দকের 'নীতিসার' প্রভৃতি৷
  • ৩. স্মৃতিশাস্ত্র: কাত্যায়ণ স্মৃতি, মনুস্মৃতি, নারদ স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি প্রভৃতি৷
  • ৪. চৈনিক পরিব্রাজক: ফাহিয়েন এর বিবরণ এবিষয়ে নানা তথ্য সরবরাহ করে৷

রাজার দৈবসত্ত

গুপ্ত যুগে রাজা দৈবসত্তে বিশ্বাসী ছিলেন ৷ তারা নিজেদের দেবতার সমকক্ষ বলে দাবি করত৷ এবং সমসাময়িক বিভিন্ন লিপিতে গুপ্ত রাজাদের "পরমেশ্বর", "পরমভট্টারক", "অচিন্তপুরুষ", "লোকধামদেব" প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে৷ এলাহাবাদ প্রশস্তিতে সমুদ্র গুপ্তকে "মর্ত্যলোকের ঈশ্বর" বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ 

রাজার ক্ষমতা

রাজা ছিলেন সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা ৷ সামরিক বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ পরিচালনা, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ, আইন প্রনয়ণ প্রভৃতি সকল বিষয়ে তার ক্ষমতা ছিল সবচেয়ে বেশি৷ তার সত্ত্বেও তিনি কখনই স্বৈরাচারী ছিলেন না৷ কেননা রাজাকে সর্বদাই চিরাচরিত প্রথা, ধর্মশাস্ত্র ও ব্রাহ্মণদের বিধান মেনে চলতে হত৷

রাজকর্মচারী

কেন্দ্রে রাজাকে সাহায্য করার জন্য মন্ত্রী, যুবরাজ ও বিভিন্ন উচ্চ রাজ কর্মচারী ছিলেন৷ মন্ত্রী ছিলেন সর্বোচ্চ রাজ কর্মচারী৷ এছাড়াও অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীরা হলেন, মহাবলাধিকৃত, মহাদন্ডনায়ক, সন্ধিবিগ্রহীক, কুমারমাত্য প্রমুখ৷

প্রাদেশিক শাসন

শাসন কার্যের সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে ক়য়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়৷ এযুগে প্রদেশ গুলিকে বলা হত যথাক্রমে,
  •  ১. দেশ: সীমান্তবর্তী প্রদেশকে বলা হত দেশ৷ যেমন- সুকুলি দেশ, সৌরাষ্ট্র দেশ প্রভৃতি ৷ দেশের শাসককে বলা হত গোপতি৷
  • ২. ভুক্তি: গাঙ্গেয় উপত্যকা প্রদেশকে বলা হত ভুক্তি৷ যেমন- তীরভুক্তি, পুন্ড্রভুক্তি প্রভৃতি ৷ ভুক্তির শাসককে বলা হত উপরিক৷

জেলা শাসন

প্রদেশ গুলি কতকগুলো বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল৷ বিষয় শাসনের দায়িত্ব ছিল বিষয়পতি ও কুমারমাত্য উপর৷ সাধারণত সম্রাট এই জেলা শাসকদের নিয়োগ করতেন৷ জেলা শাসকের দায়িত্ব প্রাপ্ত অন্যান্য কর্মচারীরা হলেন ভান্ডাগারিক, করণিক, বলভটক প্রভৃতি ৷

গ্রাম শাসন

জেলা গুলি আবার কতকগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল৷ গ্রাম ছিল শাসন ব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক৷ গ্রামের শাসন ভার ছিল গ্রামিক নামক কর্মচারীর উপর৷ গ্রামের প্রধান বা মোড়লকে বলা হত ভোযাক৷ তিনি গ্রাম শাসনে গ্রামিককে সাহায্য করতেন৷ এছাড়া গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠ ও মোড়লদের নিয়ে একটি সভা গঠিত হত৷ যে সভা গ্রাম শাসনে গ্রামিককে সাহায্য করত৷

নগর শাসন

গুপ্ত যুগে জনবহুল শহর গুলিতে পৌর শাসন প্রচলিত ছিল৷ নগর শ্রেষ্ঠী, স্বার্থবহ, প্রথমকুলিক প্রভৃতি ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত গ্রাম সভা নগর শাসনে সাহায্য করত৷ নগর শাসনের দায়িত্ব ছিল পুরত্তপাল বা নগর রক্ষকের উপর৷

আইন ও বিচার

গুপ্ত আমলেই প্রথম আইন ও বিচার ব্যবস্থার যথাযথ বিকাশ ঘটেছিল৷ এযুগের আইন রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বৃহস্পতি, কাত্যায়ন প্রমুখ৷ ফাহিয়েন এর রচনা থেকে জানা যায়, গুপ্ত যুগে উদার দন্ড নীতির প্রচলিত ছিল৷ তার মতে, অপরাধির প্রানদন্ড বা অঙ্গচ্ছেদ হত না৷ কেবলমাত্র রাজদ্রোহীদেরই অঙ্গচ্ছেদ করা হত৷

পরিশেষে বলা যায়, গুপ্ত শাসকরা ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী হলেও তারা কখনই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেনি৷ তাছাড়া মৌর্যদের মত গুপ্ত শাসন ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত ছিল না৷ গ্রাম, জেলা ও প্রদেশ গুলি যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করত৷ গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার এই বি-কেন্দ্রীকরনের ফলে গুপ্ত রাজারা কর্মচারী ও ব্রহ্মনদের প্রচুর ভূমি দান করতেন৷ যার ফলে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ও সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়৷
Next Post Previous Post