পৌরাণিক কাহিনি বা Myth বলতে কি বোঝায়? বর্তমান সমাজে মিথেসের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

প্রাচীন কালে মানুষ যে সকল ধর্মীয় অলৌকিক কল্পকাহিনী রচনা ও প্রচার করেন তাকে পৌরাণিক কাহিনি বা লোকপুরাণ বা Myth বলে৷ এগুলি লোকসমাজে মৌখিক ভাবে প্রচলিত ছিল৷ Myth শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ Muthos থেকে৷ জর্জ লরেন্স গোম এর মতে, লোকপুরাণ হল "The science of a prescientific age"৷ জে. এফ বিয়ারলেইন তাঁর "Parallel Myths" গ্রন্থে লিখেছেন, পৌরাণিক কাহিনি হল "আমাদের অবচেতন মনের কাহিনিবিশেষ যা সম্ভবত আমাদের জিনে লিপিবদ্ধ থাকে"৷

উচ্চমাধ্যমিক: মিথ (উপকথা) ও লিজেন্ড (পুরাকাহিনী) বলতে কী বোঝ? অতিতের বিষয়ে মানুষের ধারনাকে এরা কিভাবে রূপ দান করে?

পৌরাণিক কাহিনির সাধারন বৈশিষ্ট্য


চরিত্রগত

লোকপুরাণে কেন্দ্রীয় চরিত্র হল অলৌকির দেবদেবীগন৷ এখানে ঈশ্বরের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ৷ ঈশ্বরের অলৌকিক লীলাকাহিনী এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ৷

কাহিনিগত

পৌরাণিক কাহিনি গুলি মূলত ধর্মভিত্তিক৷ ধর্মীয় আচারানুষ্টান, সংস্কার, রীতিনীতি, পূজা-প্রার্থনা ইত্যাদি নিয়ে পৌরাণিক কাহিনি গড়েতোলা হয়েছিল৷ বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য, দেবতাদের জন্ম, দেব-দানব যুদ্ধ, জন্ম-মৃত্যু-পূনর্জন্ম, অবতার, পাপ-পূণ্য প্রভৃতি বিষয় লক্ষ্য করা যায়৷

প্রকৃতিগত

পৌরাণিক কাহিনি গুলি ধর্মীয় প্রকৃতির হয়৷ ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পূজা পার্বন ইত্যাদির ভিত্তিতে পৌরাণিক কাহিনি গড়ে উঠেছিল৷

শ্রেণীবিভাগ

পৌরাণিক কাহিনি গুলিকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়,
  • ১. দৃষ্টিতত্ত্বমূলক
  • ২. মানুষের উদ্ভবমূলক
  • ৩. দৃষ্টিমূলক
  • ৪. প্রলয় সূচক
  • ৫. সংস্কৃতি মূলক, ইত্যাদি ৷

বিশ্বজণীনতাগত

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনি গুলির মধ্যে এক ধরনের বিশ্বজণীনতা আছে৷ বিশ্বসৃষ্টিগত ধারনা, মহাপ্লাবনতা, দেবদেবীর সৃষ্টি তত্ত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনি গুলি গুরুত্ব আরোপ করেছে৷

ঐতিহ্যবাহী

পৌরাণিক কাহিনি গুলি দেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে৷ বর্ণমালা তৈরির অনেক আগে থেকেই এগুলি সমাজে মৌখিক ভাবে প্রচলিত ছিল৷ এই কাহিনী গুলি থেকে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য জানা সম্ভব হয়৷

উৎসের সন্ধান

বিশ্বের  অধিকাংশ পৌরাণিক কাহিনি গুলির উৎসের সন্ধান মেলে মহাকাব্যে৷ এমনই বিশ্বের পাঁচটি প্রচীনতম মহাকাব্য হল,
  1. রামায়ন
  2. মহাভারত
  3. গিলগামেশ
  4. ইলিয়াড
  5. ওডিসি
যদিও মহাকাব্যের বাইরেও পৌরাণিক কাহিনির সন্ধান মেলে৷

পৌরাণিক কাহিনিগুলির গুরুত্ব


ঈশ্বর ভাবনায়

পৌরাণিক কাহিনিগুলি মানুষের ঈশ্বর ভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পৌরাণিক কাহিনিগুলি পাঠের মাধ্যমে পাঠকের মন ঈশ্বরমুখী হয়ে ওঠে। পৌরাণিক কাহিনিগুলি আপাতভাবে কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন বলে মনে হলেও পাঠকমনে তা ঐশ্বরিক বিশ্বাসের জন্ম দেয়।

বিজ্ঞান পূর্ব যুগের ঘটনার অনুসন্ধানে

বিজ্ঞান পূর্ব যুগের ঘটনার অনুসন্ধানে পৌরাণিক কাহিনিগুলির গুরুত্ব কম নয়। অতীতে সমাজের পরিবেশের চারদিকে, আকাশে, মাটিতে যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটেছে তার উত্তর খোঁজার তাগিদেই প্রথম সৃষ্টি বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনিগুলি গড়ে ওঠে। তাই ব্রিটেনের ফোকলোর সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ লরেন্স গোম বলেছেন, পৌরাণিক কাহিনি হল বিজ্ঞান পূর্ব যুগের বিজ্ঞান।

ঐতিহাসিক উপাদানের সূত্র হিসেবে

পৌরাণিক কাহিনিগুলিতে অনেকসময় প্রচ্ছন্নভাবে ঐতিহাসিক উপাদানের সূত্র মিলতে পারে। প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে তাদের দেবতা, পূর্বপুরুষ এবং বীরপুরুষদের গল্প বলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে গ্রিসের কাহিনির সূত্র ধরেই আধুনিক গ্রিসে ট্রয় নগরী ও ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান জানা গেছে। তাই জে. এফ. বিয়ারলেইন বলেছেন— পৌরাণিক কাহিনিগুলি (Myth) গল্পের আকারে (মানব সংস্কৃতির) সত্য ঘটনার প্রকাশ।

আনুমানিক সময়কাল ও বংশতালিকা নির্ণয়ে

পৌরাণিককাহিনিগুলির সঙ্গে তুলনামূলক পদ্ধতিতে যাচাইয়ের মাধ্যমে ইতিহাসের বহু সাল-তারিখ নির্ণয় করা যায়। এ ছাড়াও পুরাণে বর্ণিত বিভিন্ন রাজার কাহিনি থেকে রাজবংশের পরিচয় ও বংশতালিকা জানা যায়। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন পুরাণে বহু প্রাচীন রাজবংশের নাম ও পরিচয় মেলে। পুরাণে উল্লেখিত সমস্ত ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ড. রণবীর চক্রবর্তী তাঁর 'ভারত ইতিহাসের আদিপর্ব' (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে লিখেছেন— “পুরাণে বর্ণিত রাজবংশগুলির অস্তিত্বের বেশিরভাগই স্বীকৃত সত্য।”

আর্থসামাজিক ইতিহাস রচনায় 

আর্থসামাজিক ইতিহাস রচনায় পৌরাণিক কাহিনিগুলির ভুমিকা কম নয়। বস্তুত পৌরাণিক কাহিনিগুলির বেশিরভাগই রচিত হয়েছিল সমকালীন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। সমাজ ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনিগুলি রচিত হয়েছিল। ভারতের প্রেক্ষাপটে পুরাণে বর্ণিত কলিযুগের সূত্র ধরে প্রাচীন ও আদি মধ্য যুগের ভারতবর্ষের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো বিশ্লেষণে উদ্যোগী হয়েছেন রামসরণ শর্মাসহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ।
Next Post Previous Post