ব্রিটিশ ভারতের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণ কি ছিল?

১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ১৬ এপ্রিল ভারতে প্রথম রেল চলাচল শুরু হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ গর্যন্ত ১২০ মাইল রেলপথ খোলা হয়। ভারতে রেল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পিছনে ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ কাজ করেছিল৷

উচ্চমাধ্যমিক: ভারতে রেলপথের বিস্তারের কারন ও ফলাফল আলোচনা করো৷


১৮৩০ থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংল্যান্ডে রেলওয়ে ব্যবস্থার দ্রুত প্রসার ও উন্নতি ঘটে এবং ভারতে রেললাইন স্থাপন ও রেলগাড়ি চলাচল ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শিল্পপতিরা ভারতে রেল ব্যবস্থার প্রবর্তনের জন্য বিশেষ আগ্রহী ছিল, কারণ তারা মনে করেছিল এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের দূরস্থিত অঞ্চলগুলিতে তাদের উৎপন্ন শিল্পদ্রব্যগুলির চাহিদা ও বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে। ব্রিটেনের কারখানাগুলি চালু রাখতে যে বিরাট পরিমাণ কাঁচামাল দরকার রেলের সাহায্যে সেগুলি সংগ্রহ করাও সহজবোধ্য হয়ে উঠবে। ব্রিটিশ ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ীরা চাইছিল যে ভারতে রেল কোম্পানি চালু হলে তারা এতে বাড়তি অর্থসম্পদ লগ্নি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে পারবে কারণ রেল কোম্পানির পিছনে অর্থলগ্নি করার ঝুঁকি কম এবং এটি বেশ নিরাপদ লগ্নি। ব্রিটেনের ইস্পাত ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসার স্বার্থে ভারতে রেলপথ নির্মাণে সমর্থন জানিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভারতে রেললাইন প্রবর্তিত করার ও বেসরকারি সংস্থা দ্বারা এগুলি পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ১৬ এপ্রিল ভারতে প্রথম রেল চলাচল শুরু হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ গর্যন্ত ১২০ মাইল রেলপথ খোলা হয়। মাদ্রাজ রেলওয়ে কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথম চুক্তি হয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে। একই বছরে বোম্বাই, বরোদা এবং সেন্ট্রাল রেলওয়ে কোম্পানিও সংগঠিত হয়। রেল কোম্পানিগুলির সঙ্গে যে সব চুক্তি রচিত হয়েছিল তার শর্তানুসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেলওয়ে কোম্পানিগুলির মূলধনের ওপর সুদ প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে রেল কোম্পানিগুলির পক্ষে রেলপথ নির্মাণের কাজে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছিল। রেল কোম্পানিগুলিকে মূলধন ও তার সুদ সম্পর্কে নিশ্চিত আশ্বাস দেওয়ার এই ব্যবস্থাকে অনাবশ্যক এবং অপচয়মূলক বলে সমালোচনা করা হয়ে থাকে। এটি অন্যবশ্যক ছিল এই অর্থে যে ভারত সরকারের বিশেষ নিশ্চয়তা প্রদান ব্যতিরেকেও ব্রিটিশ রেলওয়ে কোম্পানিগুলি খুব সম্ভবত রেলপথ নির্মাণকার্যের জন্য মূলধন সরবরাহ করত। এটি অপচয় মূলক ছিল এই অর্থে যে সরকারের এরূপ উদারপূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদানের ফলে রেলওয়ে কোম্পানিগুলির অর্থনৈতিক ভাবে যে পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করা উচিত তার অনেক বেশি পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করেছিল। রেলপথগুলি পরিচালনার ব্যাপারে ব্যয়সংকোচের কোনও উৎসাহ কোম্পানিগুলির ছিল না। পরবর্তীকালে সরকারি ভাবে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়া হয়। এ সময় রেলপথ নির্মাণ ভারত সরকার ও ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির অংশীদারিতে হতো।

নতুন ধরনের শর্তাবলি অনুযায়ী রেলওয়ে কোম্পানিগুলি কর্তৃক রেলপথ নির্মাণের ব্যবস্থাকে ভারতের আর্থিক ব্যবস্থার ইতিহাসে ‘নতুন আশ্বাসমূলক ব্যবস্থা' রূপে অভিহিত করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একাধিক ক্ষেত্রে রেল কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত চড়া হারে রেলের মাসুল ধার্য করার অভিযোগ ছিল। রেল কোম্পানিগুলি নিজেদের উচ্চ লভ্যাংশ বজায় রাখার আগ্রহে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভাবনাকে বিসর্জন দিয়েছিল। রেলের নতুন মাসুল হারের ফলে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত নতুন নতুন শিল্পকেন্দ্র বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়েছিল। ভারতের জনগণের একাংশ মনে করত সাময়িক ভাবে রেলপথের সম্প্রসারণ বন্ধ রেখে সেচ ও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হোক। রেল ব্যবস্থার পরিকল্পনা বা পরিচালন ব্যবস্থায় ভারতের তথা ভারতবাসীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছিল। যে সব জায়গায় ব্রিটেনে রপ্তানিযোগ্য কাঁচামালের প্রাচুর্য ছিল সেই জায়গাগুলি থেকে নিকটতম বন্দর পর্যন্ত লাইন পাতা হতো। ভারতীয় শিল্পদ্রব্যের উপযোগী কাঁচামালের উৎস স্থানগুলি বা বিক্রয় কেন্দ্রগুলি লাইন পাতার সময় উপেক্ষিত হয়। ব্রহ্মদেশ এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিছক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে প্রচুর খরচ করে লাইন পাতা হয়েছিল। তাই বলা যায় ভারতে রেল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পিছনে ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ কাজ করেছিল৷
Next Post Previous Post