আধুনিক ভারত গঠনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা কি কি ছিল আলোচনা করো৷

আধুনিক ভারত গঠনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা কি কি ছিল আলোচনা করো৷

ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত ৷ আমাদের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি যাকেই আমরা আধুনিক বলি না কেন রামমোহন ছিলেন তার অগ্রদূত ৷ রামমোহন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ' যে সব কঠিন বাধা আমাদের অগ্রগতি রোধ করত তিনি পথ প্রদর্শক রুপে সেগুলি দূর করেন'৷

উচ্চমাধ্যমিক: ভারতের সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান লেখ৷



সমাজ সংস্কারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা

রামমোহন রায় হিন্দু সমাজের প্রচলিত বিভিন্ন কু-প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান৷ এই সমস্ত কুপথা গুলি ছিল,
  • সতীদাহ প্রথা,
  • বাল্যবিবাহ,
  • কন্যাপন,
  • কৌলিন্য প্রথা,
  • জাতিভেদ,
  • অদৃশ্যতা৷
বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ থেকে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহ প্রথা অশাস্ত্রীয়৷ এই প্রথা নিবারণের উদ্দেশ্যে প্রায় ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষর-সম্মত একটি আবেদন পত্র বেন্টিং এর কাছে পাঠান। শেষ পর্যন্ত বেন্টিং ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ করেন৷ এবং সতীদাহ প্রথা নয় তিনি নারীদের মর্যাদা সহকারে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করেন৷ তিনি নারী পুরুষের সমান অধিকার, পুরুষের বহুবিবাহ রোধ, বিধবার পুনবিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন৷

শিক্ষা সংস্কারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা

রামমোহন রায় সমাজ, ধর্ম ও অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে সাথে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন৷ তিনি বেদান্ত কলেজ ও অ্যাংলো হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন৷ হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি ডেভিড হেয়ারকে এবং General Assemblage Institution প্রতিষ্ঠায় আলেকজান্ডার ডাফকে সহায়তা করেছিলেন৷ এছাড়াও শিক্ষা খাতে যে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার কথা বলা হয়েছিল তা তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় ব্যয় করার সমর্থনে এই প্রচার চালানো৷

ধর্মীয় সংস্কারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা

প্রচলিত আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব, হিন্দু ধর্মে নানা কুসংস্কার ও পুরোহিত তন্ত্রের স্বৈরাচারী আচরণে তিনি মর্মাহত হন৷ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র পাঠের ফলে তিনি ক্রমশ একেশ্বরবাদী ও নিরাকার ব্রহ্মবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন৷ ধর্ম সম্পর্কে আলোচনার জন্য ১৮১৪-১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন৷ পরবর্তীকালে একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য ১৮২৮ (মতান্তরে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে) তিনি ব্রহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন৷ যা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নাম ধারণ করে৷ বেদান্ত বা উপনিষদ ছিল তার ধর্ম সাধনের মূল ভিত্তি৷ কেবল হিন্দু ধর্মের পুনপ্রতিষ্ঠায় নয় খ্রিস্টান মিশনারীদের হাত থেকেও তিনি হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করেন এবং বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে মিশনারীদের প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে তিনি সমালোচনা করেন।

রামমোহন রায়ের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

রামমোহন রায়কে আধুনিক ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারার জনক বলা হয়৷ তৎকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তাবিদ মন্তেস্ক, রুশো, ভলতেয়ার, বেন্থাম প্রমুখের চিন্তা ধারায় সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন৷ তিনি মনে করতেন ভারতবাসী রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক বিকাশের জন্য অন্তত ৪০ বছর ভারত ইংরেজ শাসনে থাকা উচিত৷ তাছাড়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতার বিভাজনের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন৷ তিনি আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের পৃথক অস্তিত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন৷ তিনি আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় কাজে সরাসরি ভারতীয়দের অংশগ্রহণের কথা বলেননি কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি ভারতীয়দের মতামত গ্রহণের কথা বলেছেন৷ তিনি মনে করতেন জনগণ সংবাদপত্রের মাধ্যমে তাদের মতামত ব্যক্ত করলে সরকারের পক্ষে তা বিবেচনা করে আইন প্রণয় অনেক সহজ হবে৷ বিপান চন্দ্র রামমোহনকে তাঁর " ফাদার অব পলিটিক্যাল রিজেনারেশন অফ ইন্ডিয়া" গ্রন্থে "ভারতের রাজনৈতিক পূনরুজীবনের স্রষ্টা" বলে অভিহিত করেছে৷

রামমোহন রায়ের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা

রামমোহন দেশবাসীর অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন৷ তিনি কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকারের বিশেষ করে লবণের উপর ও দেশীয় পণ্যের উপর একচেটিয়া অধিকার এবং ভারতীয় সম্পদের নির্গমনের তীব্র প্রতিবাদ জানান৷ তিনি চিরস্থায়ী ও রয়তওয়ারি বন্দোবস্তের কুফল সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন৷ তিনি কৃষকের খাজনা কমানো ও তা চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট করার দাবি জানান৷ তিনি সরকারি ব্যয় কমানোর জন্য উচ্চ বেতনের ইউরোপীয় কর্মচারীদের পরিবর্তে স্বল্প বেতনে ভারতীয় কর্মচারীদের নিয়োগের কথা বলেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন ইউরোপীয়রা এ দেশে বসবাস করলে তারা উন্নত ধরনের চাষবাস ও শিল্প প্রতিষ্ঠায় উদ্দ্যোগী হবে।

পরিশষে বলা যায়, আধুনিক ভারতে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা নির্ণয় করা অত্যন্ত দূরহ ব্যাপার৷ রাজা রামমোহন রায় ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার সংস্কারমুখী কার্যকলাপ তুলে ধরে ভারতীকে আধুনিক করে তোলেন এবং সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগ্রত করে তোলেন৷

Next Post Previous Post