সতীদাহ প্রথা রদ, ও বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন, | অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায়

★★★★★
বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলন : সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ প্রচলন\n\nপ্রথম দিকের কোম্পানি শাসকরা ভারতীয় সমাজ বিষয়ে মূলত নিরপেক্ষ নীতি নিতেন। ঊনবিংশ

বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলন : সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন

প্রথম দিকের কোম্পানি শাসকরা ভারতীয় সমাজ বিষয়ে মূলত নিরপেক্ষ নীতি নিতেন। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে কিছু কিছু সামাজিক সংস্কার বিষয়ক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়। নৃশংস, অমানবিক কিছু রীতিনীতি বন্ধ করতে আইন প্রণীত হয়। তবে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের তরফে বিভিন্ন সংস্কারমূলক আইন জারি করা হলেও কুপ্রথাগুলি রয়েই গিয়েছিল। যেমন, ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলি সাগরে কন্যাশিশু ভাসিয়ে দেওয়ার প্রথা নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তাতে করে ঐ প্রথা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি।

ঊনবিংশ শতকে শিক্ষিত ভদ্রলোক ভারতীয়দের অনেকেই সমাজ সংস্কারের কাজে উদ্যোগী হন। বাংলায় ঐ আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। যুক্তিসম্মত বিচারের সাহায্যে তিনি হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করার কথা বলেছিলেন। তিনি মূর্তিপুজো, পুরোহিততন্ত্র এবং বহু ঈশ্বরবাদের নিন্দা করেন। সতীদাহ প্রথার নিষিদ্ধকরণে তাঁর উদ্যোগ ছিল। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উনিশ শতকেও কলকাতা ও তার আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে সতীদাহ প্রথা বজায় ছিল। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার পক্ষে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্ক আইন করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেন। যদিও সতীপ্রথাকে নিয়ে নানানরকম গৌরবময় ধারণা সমাজে রয়েই গিয়েছিল। সম্পত্তিতে নারীর আইনগত স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও রামমোহন সওয়াল করেন।


উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় বিধবা নারীদের পুনরায় বিয়ে দেওয়া নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরও ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে আইন জারি করে বিধবা বিবাহ চালু করার দাবি জানিয়েছিলেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন জারি করা হয়। কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে মোটেই বিধবা বিবাহ জনপ্রিয় হয়নি। বরং বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকটি বিধবা বিবাহ আয়োজন করা হয়েছিল।

আলোচ্য পাঠাংশ সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

রামমোহন রায়কে (১৭৯২-১৮৩৩) 'আধুনিক ভারতের জনক' বলা হয় কেন ?

ঊনবিংশ শতকের ভারতের সমাজ ছিল কু-সংস্কার ও কূপমণ্ডুকতায় আচ্ছন্ন। রাজা রামমোহন রায়ই হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও কু-প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন, ভারতীয় সমাজ তথা নারীজাতির উন্নতির চেষ্টা করেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় সাধন করেন, শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেন, অর্থাৎ একজন পথপ্রদর্শক রূপে সামাজিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধাগুলি দূর করেন। এইজন্য তাঁকে 'আধুনিক ভারতের জনক' অভিধায় ভূষিত করা হয়।

রামমোহন রায় কোন্ কোন্ নামে পরিচিত ছিলেন?

রামমোহন রায় 'ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত', 'ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ', 'আধুনিক ভারতের জনক, ‘ভারত পথিক' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’(জহরলাল নেহেরু), নবজাগরণের কেন্দ্রবিন্দু (বিপান চন্দ্র), 'রাজা' (মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর), ‘বিশ্বমানব’ (ব্রজেন্দ্রনাথ শীল) প্রভৃতি নামে অভিহিত ছিলেন।

কে কবে কেন আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা করেন? 

রাজা রামমোহন রায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার কয়েকজন সদস্য হলেন–দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ প্রমুখ।
রামমোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাঁর একশ্বরবাদী ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনার জন্য কোলকাতায় 'আত্মীয় সভা' প্রতিষ্ঠা করেন।

কে কবে কেন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন ?

রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৮২৯) 'ব্রাহ্মসভা' প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীকালে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে 'ব্রাহ্মসমাজ' নাম ধারণ করে।
বৈদান্তিক একেশ্বরবাদ শিক্ষা দেওয়া, পৌত্তলিকতা পরিহার করে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার লক্ষ্যে তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

সমাজ-সংস্কারে রামমোহনের অবদান কি ছিল?

বাংলাদেশে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ হলেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য সংস্কারগুলি হল—
  • ১. অমানবিক সতীদাহ প্রথা রোধ।
  • ২. নারী ও পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। 
  • ৩. বিধবা বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা প্রচারের প্রচেষ্টা।
  • ৪. বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানান।

শিক্ষা বিস্তারে রামমোহনের অবদান কি ছিল?

রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের একজন উৎসাহী সমর্থক। তিনি বেদাত্ত কলেজ, অ্যাংলো হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় ডেভিড হেয়ারকে এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় আলেকজান্ডার ডাফকে সহায়তা করেছিলেন। এছাড়া শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা এক লক্ষ টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষায় ব্যয় করার জন্য প্রচার চালান। 

রামমোহন রায় কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকাগুলির নাম লেখো।

১৮২০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘প্রিসেপ্টস্ অব জিসাস', ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে 'অ্যাপীলস টু দি ক্রিশ্চিয়ান পাবলিক' পুস্তিকা প্রকাশ করেন।

রামমোহন রায়ের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা কি ছিল?

রামমোহনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা হল—
  • ১। কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্য ও অসম শুল্কের বিরোধিতা,
  • ২। সম্পদ নির্গমনের বিরোধিতা, 
  • ৩। জমির উপর কর ধার্যের সরকারি নীতির বিরোধিতা,
  • ৪। সরকারি ব্যয় হ্রাস,
  • ৫। ভারতে কৃষি ও শিল্পে বিদেশী পুঁজির বিনিয়োগ প্রভৃতির কথা বলেন।

রামমোহন রায় কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থের নাম লেখো।

 ‘বেদান্ত গ্রন্থ' ও 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ' নামে দুটি গ্রন্থ রামমোহন প্রকাশ করেন।

রামমোহন রায় কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাগুলির নাম কর।

(বাল্যবিবাহের দোষ) ‘ব্রাহ্মনিক্যাল ম্যাগাজিন' (১৮২১-২৩), 'সম্বাদ কৌমুদী' (১৮২১) মিরাৎ-উল-আখবর' (১৮২২), 'বঙ্গদূত' 'ব্রাহ্মণ-সেবধি' প্রভৃতি পত্রিকা রামমোহন প্রকাশিত করেন।

সতীদাহ প্রথা নিবারণে রামমোহন রায়ের অবদান কি ছিল? 

রামমোহন রায় বাংলার সামাজিক কু-প্রথাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। এবং বিভিন্ন পুস্তিকা ও পত্রিকার মাধ্যমে সতীদাহ ধর্মবিরুদ্ধ ও অশাস্ত্রীয় প্রমাণিত করে জনমত গড়ে তোলেন এবং ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর সহায়তায়, আইনত পথে সতীদাহ প্রথা রদ করেন।

রামমোহন রায়ের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে লেখো, বা রামমোহন রায়কে ভারতের ‘জাতীয়তাবাদের জনক' বলা হয় কেন?

রামমোহন রায় বিচার ও শাসন বিভাগের পৃথকীকরণ, জুরি আইনের অবসান, কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান, বিচারের ক্ষেত্রে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের জন্য একই আইন প্রয়োগ প্রভৃতি জাতীয় দাবিগুলি ব্রিটিশদের কাছে তুলে ধরেন। ভারতের জাতীয় দাবিগুলি সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে আদায়ের পথ তিনি প্রথম দেখান। তাই তাঁকে জাতীয়তাবাদের জনক বলা হয়।

রামমোহন রায়ের সীমাবদ্ধতাগুলি লেখো। 

রামমোহন রায়ের সীমাবদ্ধতাগুলি হল—
  • ১। হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি।
  • ২। হিন্দুধর্মের সংস্কার করতে গিয়ে যুক্তি নয়—ধর্মশাস্ত্রগুলির উপর বেশি গুরুত্ব দেন। 
  • ৩। ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের কথা বলতে গিয়ে দেশীয় শিক্ষার প্রতি তিনি অবহেলা প্রকাশ করেন। 
  • ৪। তিনি মাতৃভাষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারেন নি।

সমাজ-সংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান কী ছিল?

সমাজ-সংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য—
  • ১। বিদ্যাসাগর বাল্য-বিবাহ ও বহু বিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। 
  • ২। ১৮৫৬ খ্রিঃ বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ করেন
  • ৩। দরিদ্র বিধবাদের সাহায্যার্থে ১৮৭২ খ্রিঃ হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেন।
  • 8 ৷ শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ৫০টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

বিধবা-বিবাহ আইন কবে ও কোন্ বড়লাটের আমলে পাশ হয়?

বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বিধবা-বিবাহ আইন ১৮৫৬ খ্রিঃ বড়লাট লর্ড ক্যানিং-এর আমলে পাশ হয়।


Tags:
Next Post Previous Post

You May Also Like

Editor
ইতিহাস পাঠশালা

যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু অতীত তাই হল ইতিহাস৷ ইতিহাস পাঠশালা হল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত, উত্তরধর্মী, প্রবন্ধ মূলক পাঠ সহায়ক একটি ব্লগ৷ মূলত ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরাই এই ব্লগের প্রধান লক্ষ্য৷