ইক্তা ব্যবস্থায় মুকতির ভূমিকা কি ছিল আলোচনা করো।

আক্ষরিক অর্থে ইক্তা বলতে বোঝায় একটি এলাকা (an area)। সুলতানি সাম্রাজ ইক্তা বা প্রদেশে বিভক্ত হয়েছিল। তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যগুলির বিলুপ্তি ঘটে; তাদের স্থান অধিকার করে ইক্তা। প্রতিটি ইক্‌তা ছিল একজন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ও অধীনে। ইক্তার প্রধানকে বলা হত ইক্তাদার। ইক্তাদারেরা তাদের এলাকার স্বাধীন শাসক ছিলেন না। তাঁদের নিয়োগ, কার্যকলাপ, বদলী ইত্যাদি নির্ভর করত সুলতানের ইচ্ছার উপরে। ইক্তাদার তাঁর ইতার আয় থেকে তাঁর অধীনস্থ সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণ করতেন। এবং বাকি আদয়কৃত অর্থ রাজকোষে জমা দিতেন। ইক্তাদারকে দুরকম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য পালন করতে হত। রাজস্ব আদয় এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষা। রাজপুতদের সামন্ত প্রথা অবসান করার লক্ষ্যে ইকতা প্রথা পরিকল্পিত হয়। ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের ফলে সাম্রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্পর্শে আসে।

ডব্লিউ. এইচ. মোরল্যান্ড-এর অভিমত, সুলতানি যুগে ছোট বা বড় ভূমিখণ্ড থেকে ভূমি রাজস্ব আদায়ের অধিকার হল ইক্তা (territorial assignment)। এই অধিকার লাভের বিনিময়ে ইক্তার অধিকারী মুক্তিকে (Muqti) সামরিক দায়িত্ব পালন করতে হত। সুলতানি যুগে কৃষকের উদ্বৃত্তের একাংশ কর ব্যবস্থার মাধ্যমে আদায় করা হত। শাসকদের মধ্যে এই উদ্বৃত্ত বণ্টন করা হত। উদ্বৃত্ত আহরণ ও বণ্টনের জন্য একটি সরকারি কাঠামো বা যন্ত্রের প্রয়োজন ছিল। এই যন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ইক্তা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, হতা হল ভূমি রাজস্বের বন্দোবস্ত।

ইক্তা ব্যবস্থায় মুকতির ভূমিকা

ইক্তার অধিকারীকে বলা হত মুকতি। একটি আদর্শ ইক্তা ব্যবস্থায় ইক্তার মালিক মুকতি অধীনস্থ কৃষক বা রায়তের কাছ থেকে নির্ধারিত ভূমি রাজস্ব (মাল) আদায় করতেন। কৃষকের ওপর তার কোনো অধিকার ছিল না। কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের পরে তার স্ত্রী, পুত্র, সম্পত্তি বা পণ্যের ওপর মুক্তির কোনো অধিকার ছিল না। প্রজা বা কৃষক প্রয়োজন বোধে সুলতানের দরবারে উপস্থিত হয়ে নিজের অবস্থা জানাতে পারত। এই ব্যাপারে তাকে বাধা দানের অধিকার মুক্তির ছিল না। ইক্তার নিয়ম-বিধি অমান্য করলে সুলতান মুক্তিকে শাস্তি দিতে ও তার ইতা অধিগ্রহণ করতে পারতেন। দেশ ও প্রজা (রায়ত) সুলতানের; মুকতি তাদের তত্ত্বাবধায়ক ভারপ্রাপ্ত মাত্র।

সুলতানই ছিলেন ইক্তার প্রকৃত মালিক। তিনি ইচ্ছা মতো ইক্তা দিতেন এবং ততদিনই মুক্তি ইক্তা ভোগ করতে পারতেন যতদিন তা সুলতানের অভিপ্রেত ছিল।

ইক্তার রাজস্ব ভোগ করার জন্য ইক্তার মালিককে কয়েকটি শর্ত মেনে চলতে হত। একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, ইক্তার আয় থেকে ইক্তার মালিক সেনাবাহিনী পোষণ করবেন এবং প্রয়োজনে সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করবেন। ইতার মালিক মূর্তি ছিলেন কর সংগ্রাহক এবং সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ও বেতন দাতা। আবার মুকতি ইক্তার রাজস্ব পেতেন ও সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহ করতেন।

দিল্লি সুলতানির প্রথম দিকে কোনো রাজস্বব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সেনাধ্যক্ষদের নগদ বেতন দানও ছিল কষ্টসাধ্য। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সুলতান বিজিত। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। সেনাধ্যক্ষগণ এই সব অঞ্চলে লুঠপাট চালিয়ে বা নগদ অর্থ আদায় করে ব্যয় নির্বাহ করতেন। বিজয়ী তুর্কীদের কাছে ইকতা ছিল পরিচিত ব্যবস্থা। সুতরাং (সামরিক নেতাদের নাম হল মুকতি আর তাদের অধীনস্থ ভূমির নাম হল ইক্তা।)

সুলতানি শাসন ভারতে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইতার চরিত্রে পরিবর্তন ঘটে। সুলতানি যুগে রায়তদের কাছ থেকে যে রাজস্ব আদায় করা হত তা বণ্টিত হত করাজকোষে জমা পড়ত তাকে বলা হত খলিফা, আর অভিজাতদের মধ্যে যা বণ্টিত সুলতান ও অভিজাতদের মধ্যে। যে-সব ভূখণ্ড থেকে রাজস্ব সরাসরি সুলতানের হত তাকে বলা হত ইক্তা।

সুলতানি যুগে ইক্তার বিবর্তনে তিনটি পর্যায় ঐতিহাসিকগণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথম দিকে সুলতান সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল ইকতা রূপে বণ্টন করতেন। এই ইক্তা থেকে যে রাজস্ব আদায় হত তা দিয়ে অভিজাতগণ নিজেদের এবং সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহ করতেন। এই পর্যায়ে ইক্তাদারগণ প্রাদেশিক শাসকরূপে কাজ করতেন। রাজস্ব আদায় ও প্রশাসন পরিচালনা এই দুই ধরনের কাজ ইক্তাদারকে করতে হত।


Next Post Previous Post