গান্ধীজীর উত্থান ও প্রথম পর্যায়ের রাজনৈতিক আন্দোলন | চম্পারণ সত্যাগ্রহ, আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ এবং খেদা সত্যাগ্রহ

★★★★★
১৯১৫ খ্রীঃ বিজয়ী বীর রূপে গান্ধীজী দেশে ফিরে আসেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দি়য়ে ভারতে তিনটি আঞ্চলিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং সাফল্য লাভ করেন।

গান্ধীজীর উত্থান ও প্রথম পর্যায়ের রাজনৈতিক আন্দোলন - চম্পারণ সত্যাগ্রহ, আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ এবং খেদা সত্যাগ্রহ

ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে মোহনদাস করমমচাঁদ গান্ধী এক অবিস্মরণীয় নাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তিনি "মহাত্মা", জহরলাল নেহেরুর কাছে তিনি "আলোর ঝলক" সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে তিনি "জাতির জনক" হিসাবে প্রতিভাত। আইনস্টাইন এই দেখে খুসি হয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষে গান্ধীজীর মত একজন মহত্ম ব্যক্তির পদচিহ্ন পরেছে।

১৮৬৯ খ্রীঃ ২ রা অক্টোবর গুজরাটের পোর বন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যারিষ্টারি পাশ করে আইন ব্যবসার উদ্দেশ্যে গান্ধীজী ইংল্যাণ্ডে গেলেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা অভিযান করেন। সেখানেই গান্ধীজীর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি সেখানকার মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করেন। বিশ্ববাসীর সামনে গান্ধীজী ও তাঁর সত্যাগ্রহ নীতি রাজনীতিতে এক নতুন পথ ও মত রূপে স্বীকৃতি পায়। এপ্রসঙ্গে S. R. Meheratta বলেছেন

"The greatest gift of the Indian struggle in South Africa to the Indian National Movement was guide himself."

১৯১৫ খ্রীঃ বিজয়ী বীর রূপে গান্ধীজী দেশে ফিরে আসেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দি়য়ে ভারতে তিনটি আঞ্চলিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং সাফল্য লাভ করেন।

চম্পারণ সত্যাগ্রহ

বিহারের চম্পারণে নীলকররা স্থানীয় কৃষকদের মোট জমির ৩/২০ অংশে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। এই ব্যবস্থা "তিনকাটিয়া ব্যবস্থা" নামে পরিচিত। চম্পারণের কৃষকদের আবেদনে গান্ধীজী এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পাশেএসে দাঁড়ায়। তৎকালীন কংগ্রেসের কিছু তরূণ যুবককে নিয়ে (রাজেন্দ্র প্রসাদ, মহাদেব দেশাই, ব্রজকিশোর প্রমুখ) চম্পারণে উপস্হিত হলে ব্রিটিশ সরকার তাদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু জনতার চাপে তাদের মক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং "চম্পারণ কৃষি বিল" পাশ করে অত্যাচারের অবসান ঘটায়।

চম্পারণে গান্ধীজীর সংগ্রাম ভারতের প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন। এই আন্দোলনে তিনি জয়যুক্ত হন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, চম্পারণ সত্যাগ্রহ হল সর্বভারতীয় রাজনৈতিক নেতা হিসাবে গান্ধীজীর উত্থানের প্রথম পদক্ষেপ। জুডিথ ব্রাউন বলেন যে, চম্পারণ আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষক সমাজের সাথে গান্ধীজীর প্রথম যোগসুত্র স্থাপিত হয়।

আমেদাবাদ শ্রমিক ধর্মঘট

চম্পারণের পর গান্ধীজী আমেদাবাদের সুতাকল শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে বেতন বৃদ্ধির দাবি জানায়। গান্ধীজী অহিংস ধর্মঘটের আহ্বানের পরামর্শ দেন এবং তাদের দাবির সমর্থনে অনশন শুরু করেন। ইংরেজ সরকার এতে ভৃত হয়ে শ্রমিকদের বেতন ৩৫% বাড়িয়ে দেয়।

এই আন্দোলনে অংশগ্রহনের ফলে গান্ধীজীর সাথে শ্রমিকদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং শহরাঞ্চলে গান্ধীজীর রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনে গান্ধীজী অহিংসাকে প্রথম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন। অহিংস শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি মালিক পক্ষের সহানুভূতি ও বিশ্বাস আদায় করেন।

খেদা কৃষক বিদ্রোহ

এরপর গান্ধীজী গুজরাটের খেদা জেলায় কৃষক আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯১৮ খ্রীঃ অজন্মার কারণে এখানকার কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পরে। তাসত্ত্বেও তাদের উপর থেকে বলপূর্বক রাজস্ব আদায় করা হত। এর বিরুদ্ধে গান্ধীজী, বল্লভভাই প্যাটেল ও অন্যান্য নেতাদের নিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন তুলে ধরেন এবং প্রজাদের কর না দেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেন।

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, খেদা আন্দোলন একটি আঞ্চলিক আন্দোলন হলেও এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চরিত্রের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চরিত্রের রূপান্তর ঘটায়। শান্ত, নীরিহ গ্রামবাসীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে সত্যাগ্রহের পথ ধরে। জুডিথ ব্রাউনের মতে, কোনো রাজনৈতিক গোষ্টির সাথে যুক্ত না হয়েও খেদা সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধীজী রাজনীতিবিদ হিসাবে তার দক্ষতা প্রমান করেন এবং ভারতীয় রাজনীতিতে নিরক্ষর কৃষকদের সাথে শহরের শিক্ষিত মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর যোগসূত্র স্থাপন করেন।


               গান্ধীজীর প্রথম পর্যায়ের আন্দোলন গুলি তাকে রাজনীতির আঙ্গিনায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ছিল-


প্রথমতঃ

বিহার, আমেদাবাদ ও গুজরাটে গান্ধীজী কৃষক ও শ্রমিকদের ইংরেজ শাসক ও নীলকর সাহেবদের সম্পর্কে ভয় কাটাতে সাহায্য করেছিল।

দ্বিতীয়তঃ

নিরক্ষর গ্রামবাসীরা গান্ধীজীকে অবতারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। চম্পারণে তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ দিতে গিয়ে এক কৃষক বলেন, "গান্ধীজী হলেন রাম, তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন। তাই আমরা আর নীলকর রাক্ষসদের ভয় পাই না।"

তৃতীয়তঃ

বিপান চন্দ্র বলেন, এই আন্দোলনের গুলি গান্ধীজীকে দিন দরিদ্র মানুষের জীবন ধারার সাথে একাত্য হয়ে উঠে ছিলেন।

চতুর্থতঃ

এতদিন পর্যন্ত জাতীয় আন্দোলন মধ্যবৃত্ত শ্রেণির হস্তগত ছিল। গান্ধীজী কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবৃত্তদের সহাবস্থান ঘটিয়ে জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজের প্রবেশের দ্বার উন্মূক্ত করে ছিলেন।


Tags:
Next Post Previous Post

You May Also Like

Editor
ইতিহাস পাঠশালা

যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু অতীত তাই হল ইতিহাস৷ ইতিহাস পাঠশালা হল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত, উত্তরধর্মী, প্রবন্ধ মূলক পাঠ সহায়ক একটি ব্লগ৷ মূলত ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরাই এই ব্লগের প্রধান লক্ষ্য৷