ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো।

ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো।

ইলতুৎমিস দিল্লি সুলতানদের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রাদেশিক প্রশাসন পরিচালনা ও কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করার জন্য ইক্তা প্রথা প্রবর্তন করেন। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব লিখেছেন, ইসলামের বিধান যেহেতু কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্তকে কর হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং তা প্রাদেশিক মুসলিম শাসকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়, তাই এই প্রথাকে বলে ইক্তা প্রথা। প্রশাসনিক প্রয়োজনে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য কতকগুলি সামরিক এলাকায় ভাগ করা হয়েছিল, যার নাম ইক্তা (Iqta)। ইক্তার সামরিক প্রশাসককে বলা হত “মুকতি” বা ইক্তাদার। ইক্তা প্রথার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের দিক হল : সংশ্লিষ্ট এলাকায় কর আদায়, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা; খুৎ মুকাদ্দাম, চৌধুরীদের বিদ্রোহ দমন করে সুলতানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি। কর আদায়, তার বণ্টন ও অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়োগও ছিল ইক্তাদারের দায়িত্ব ত এ. এল. শ্রীবাস্তবের মতে, ইক্তাদারেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। কারণ, খরচ মিটিয়ে বাকি রাজস্ব রাজকোষে জমা না দিয়ে বেশি করে হিসাব দেখিয়ে নিজেরাই তা আত্মসাৎ করত।

  1. ভারতে ইক্তা ব্যবস্থাকে প্রথম বৈধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন ইলতুৎমিস। তিনি প্রধানত তুর্কী সেনাপতিদের মধ্যে ইক্তা বণ্টন করেন এবং ইক্তা ব্যবস্থাকে প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তিরূপে সংগঠিত করেন।
  2. গিয়াসউদ্দিন বলবন ইক্তা ব্যবস্থায় নানা ত্রুটি ও দুর্নীতি লক্ষ করেছিলেন। এই ত্রুটি দূর করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। যে-সব সৈনিক সামরিক দায়িত্ব পালন করত না বা দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েছিল তিনি তাদের ইকতা কেড়ে নেন। বংশানুক্রমিক নীতি যাতে ইক্‌তা ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্র ক্ষুণ্ণ না করে সেদিকে তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। বলবন ইক্তা প্রথার বিরোধী ছিলেন না। তাঁর সংস্কারের ফরে ইক্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

বরনির লেখা থেকে ইকতা ব্যবস্থার আরো একটি পরিবর্তনের কথা জানা যায়। ত্রয়োদশ শতক শেষ হওয়ার আগেই এই পরিবর্তন ঘটেছিল। সুলতানগণ নির্দেশ দেন যে ইক্তার উদ্বৃত্ত রাজস্ব রাজকোষে জমা দিতে হবে। ইক্তার সম্ভাব্য আয় ও সেনাবাহিনী বাবদ ব্যয় এ দয়ের হিসাব করার ব্যবস্থা করা হয়। এই হিসাব করার জন্য বলবন মুক্তির সঙ্গে একজন করে খাজা (হিসাবরক্ষক) নিযুক্ত করেন। ইক্তার আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ জানবার জন্য সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

আলাউদ্দিন খলজির রাজত্বকালে ইক্তা ব্যবস্থার গঠন ও চরিত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। আলাউদ্দিন নতুন-নতুন অঞ্চল জয় করে সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেছিলেন। একই সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন পুরনো অঞ্চলের সমস্ত শ্রেণীর কৃষকের ওপর কর ধার্য ও তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি ইতা ব্যবস্থায় পরিবর্তন অনিবার্য করে তুলেছিল। ইক্তা সম্পর্কে আলাউদ্দিন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি তার পদস্থ কর্মচারীদের দূরবর্তী অঞ্চলে ইক্‌তা দিতেন। অন্যদিকে নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিকে তিনি খালিসা বা খাস অঞ্চলে পরিণত। নিকটবর্তী অঞ্চলগুলির ওপর নজর রাখা বা এদের তত্ত্বাবধান ছিল অনেক বেশি সুবিধাজনক। 'মধ্য দোয়াব ও রোহিলখণ্ড অঞ্চল খালিসার অন্তর্গত করা হয়। দ্বিতীয়ত, খালিসা থেকে প্রাপ্ত সমস্ত আয় রাজকোষে জমা হয় এবং সৈনিকদের নগদ বেতন দানের ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে সুলতানের নিজস্ব অশ্বারোহী সেনাদের বেতনের পরিবর্তে ইতা দান করা হত। আগেকার এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের শেষ পর্যন্ত এই আলাউদ্দিন পরিকল্পিত ইক্তা ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। অবশ্য আলাউদ্দিন তাঁর সেনাবাহিনীর অফিসার মুক্তি বা ওয়ালিদের ইতা দান ব্যবস্থা বজায় রাখেন।

ইক্তা ব্যবস্থায় আলাউদ্দিন পরিবর্তন আনার ফলে ইক্তার ব্যাপারে সরকারি আমলারা হস্তক্ষেপের সুযোগ পান। এঁরা বিভিন্ন সময়ে হস্তক্ষেপ করতেও শুরু করেন। সুলতান ইক্তার জমি জরিপ করে কর ধার্য ও আদায়ের আদেশও দিয়েছিলেন। দেওয়ান-ই-উজিরাৎ বা রাজস্ব বিভাগ প্রত্যেক ইক্তার রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিতেন। রাজস্ব বিভাগ সর্বদা চেষ্টা করত সম্ভাব্য রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে। এই রাজস্বের একটি অংশ মুক্তির অধীনস্থ সেনাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হত। ইক্তার কোন্ অংশ থেকে সৈন্যদের জন্য নির্দিষ্ট আয় আর কোন্ অংশ থেকে মুক্তির নিজস্ব ব্যয় ও তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীদের ব্যয় নির্বাহ করা হবে তা স্থির করে দেওয়া হত। এই দুই খাতে ব্যয় নির্বাহ করার পর অর্থ উদ্বৃত্ত থাকত তা জমা দিতে হত রাজকোষে।

মুক্তিরা সর্বদা চেষ্টা করতেন তাঁদের আয় কম করে দেখাতে। যে উদ্বৃত্ত রাজস্ব রাজকোষে জমা দেওয়ার নির্দেশ ছিল তাও তাঁরা কম করে দেখাতেন। ইক্তা ব্যবস্থায় আলাউদ্দিন যে-সব পরিবর্তন এনেছিলেন তার কিছু কুফল ছিল। এর ফলে ইক্তাগুলির আয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা দেয় গোপনীয়তা, অবিশ্বাস ও দুর্নীতি।

সুলতান মুক্তিদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী করেছিলেন। প্রয়োজনে সুলতান একজন মুক্তিকে বন্দী করে রাখতেন। এমনকি তাঁর ওপর দৈহিক নির্যাতন পর্যন্তও চালাতেন। এর ফলাফল শুভ হয়নি। মুক্তিরা আবার তাদের অধীনস্থদের ওপর একই নীতি খাটাতেন। নিজেদের আয় বাড়ানোর জন্য এই নীতি তাঁরা অনুসরণ করতেন। বরনি ও আফিফের লেখা থেকে সরকার ও মুক্তিদের মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে জানা যায়।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সময়ে ইক্তা ব্যবস্থার তেমন বড় রকমের পরিবর্তন দেখা যায় না। বরং এই ব্যবস্থা দ্রুত সংস্কার করার ফলে যে সব ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল তা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তির বার্ষিক জমা ১/১০ বা ১/১১ অংশের বেশি না বাড়াতে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ সেই ক্ষেত্রে বাড়তি করের বোঝা শেষপর্যন্ত কৃষকের ওপর গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। তাছাড়া গিয়াসউদ্দিনের নির্দেশ ছিল, মুতি তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদের জন্য নির্দিষ্ট ইকতার অর্থের কোনো অংশ নিতে পারবেন না।

মহম্মদ বিন তুঘলক ইক্তার দুটি বৈশিষ্ট্য—

  • ১. কর সংগ্রহ
  • ২. সেনাবাহিনী পোষণ

এই দুয়ের মধ্যে পৃথকীকরণ শুরু করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত সরকারের আয় বৃদ্ধি করা। বরনি লিখেছেন, চুক্তিকারী ও বণিক নিজাম মাইন ও নসরত খান যথাক্রমে কারা ও বিদরের ইক্তার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করেছিলেন। ইবন বতুতার বর্ণনা অনুসারে আমরোহা অঞ্চলের ওয়ালির কাজ ছিল কেবল রাজস্ব আদায়।

মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলের ইকতা ব্যবস্থার সব থেকে ভালো বর্ণনা পাওয়া যায় ‘মাসালিক-অল-অবসর-এ ফিরোজ তুঘলকের আমল থেকে ইকতার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পেতে শুরু করে। ইক্তার দুই অংশের মধ্যেকার বিভাজন রেখাও ক্রমশ মুছে যেতে শুরু করে। ইক্তা বণ্টনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দিল্লির। সুলতানদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উদার। তাঁর নীতির ফলে ইক্তার পরিমাণ বাড়ে, অন্য দিকে খালিসার পরিমাণ হ্রাস পায়। ফিরোজ তুঘলকের ব্যবস্থার ফল খুব একটা ভালো হয়নি। ইক্তা থেকে সৈন্যরা তাদের নির্দিষ্ট বেতনের মাত্র অর্ধেক পেত। ফিরোজ তুঘলকের রাজত্বকালে ইক্তা ব্যবস্থায় বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার নীতি স্বীকৃত হয়।

লোদী সুলতানদের রাজত্বকালে ইক্‌তা ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ কেবল ইক্তা শব্দের পরিবর্তে সরকার ও পরগণা শব্দ ব্যবহৃত হয়। সুলতানি যুগের ইকতা ব্যবস্থার ওপরই গড়ে ওঠে মুঘল যুগের জায়গির ব্যবস্থা যা ছিল আরও বিস্তারিত ও জটিল।

Next Post Previous Post