প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিতর্কটি কী?

 প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব

প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব পণ্ডিত এবং ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের একটি বিষয়। এখানে কিছু মূল বিষয় রয়েছে যা এই বিতর্ক সম্পর্কিত যুক্তি এবং দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে:

 1. সীমিত সামন্তবাদ দৃষ্টিকোণ:

  •     - এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা যুক্তি দেন যে সামন্তবাদ, যেমনটি ঐতিহ্যগতভাবে ইউরোপীয় ইতিহাসে বোঝা যায়, প্রাচীন ভারতে বিদ্যমান ছিল না। তারা বিশ্বাস করে যে "সামন্তবাদ" শব্দটি সরাসরি ভারতীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা উচিত নয়।
  •     - তারা যুক্তি দেয় যে প্রাচীন ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোগুলি বর্ণ (বর্ণ) এবং জাতি (উপবর্ণ) ব্যবস্থা দ্বারা স্বতন্ত্র এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিল, যা মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পৃথক ছিল।
  •     - বংশগত ভূমি অনুদানের অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর ধর্মীয় ও নৈতিক বাধ্যবাধকতার উপর জোর দেওয়া সামন্তবাদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

 2. সামন্তবাদী উপাদানের দৃষ্টিকোণ:

  •     - এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনকারী পণ্ডিতরা যুক্তি দেন যে যদিও ভারতে সামন্তবাদ তার ইউরোপীয় প্রতিরূপকে প্রতিফলিত করতে পারেনি, তবে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে সামন্তবাদী উপাদান বিদ্যমান ছিল।
  •     - তারা দাবি করে যে ভূমি অনুদানের উপস্থিতি এবং সামন্ত নামে পরিচিত শক্তিশালী আঞ্চলিক প্রভুদের উত্থান, যারা জমি ও কৃষকদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করেছিল, সামন্ত সম্পর্কের অনুরূপ।
  •     - এই পণ্ডিতরা পরামর্শ দেন যে রাজার কর্তৃত্ব অনুশীলনে সীমিত ছিল, এবং স্থানীয় ক্ষমতাধররা জমি, শ্রম এবং সম্পদের উপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, সামন্ততন্ত্রের মতো একটি ব্যবস্থা তৈরি করে।

 3. আঞ্চলিক পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ:

  •     - প্রাচীন ভারতে সমাজের সংগঠনের আঞ্চলিক ভিন্নতার চারপাশে বিতর্ক কেন্দ্রগুলির আরেকটি দিক। এটি যুক্তি দেওয়া হয় যে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব এবং প্রকৃতি, যদি উপস্থিত থাকে, তবে বিভিন্ন অঞ্চল এবং সময়কাল জুড়ে পরিবর্তিত হতে পারে।
  •     - কিছু অঞ্চলে শক্তিশালী সামন্তবাদী বৈশিষ্ট্যগুলি প্রদর্শিত হতে পারে, অন্যদের বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো থাকতে পারে।
  •     - এই দৃষ্টিকোণটি প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয় এবং সামন্তবাদের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সম্পর্কে সাধারণীকরণ করা এড়িয়ে যায়।

 4. সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের প্রয়োজন:

  •     - সামগ্রিকভাবে, বিতর্কটি প্রাচীন ভারতীয় সমাজকে বোঝার জটিলতা এবং সামন্তবাদের ইউরোপীয় ধারণাকে সরাসরি প্রয়োগ করার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে।
  •     - প্রাচীন ভারতের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো পরীক্ষা করার সময় পণ্ডিতরা সংক্ষিপ্ত এবং প্রসঙ্গ-নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ পরিচালনার গুরুত্বের উপর জোর দেন।
  •     - তারা প্রাচীন ভারতীয় সমাজের সংগঠনের একটি বিস্তৃত বোঝার জন্য জমির মালিকানা, ক্ষমতার গতিশীলতা, শ্রম সম্পর্ক এবং স্থানীয় শাসনের মতো একাধিক কারণ বিবেচনা করার তাৎপর্যের উপর জোর দেয়।

 এটা লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক চলছে, এবং পণ্ডিতদের মধ্যে কোন ঐক্যমত নেই। বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান, এবং প্রাচীন ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে আরও চূড়ান্ত বোঝার জন্য আরও গবেষণা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব : বিতর্ক

সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের সপক্ষে মতামত: ঐতিহাসিক ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ড. রামশরণ শর্মা, ড. ডি. ডি. কোশাম্বী, ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ ঝা, অধ্যাপক বি. এন. এস. যাদব, এস. গোপাল, ভকতপ্রসাদ মজুমদার প্রমুখ মনে করেন যে, প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। এই প্রসঙ্গে তাঁরা প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের উপাদান হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির অস্তিত্বের কথা তাঁরা তুলে ধরেন—

1. দাসপ্রথা : 

সামন্ততন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দাসপ্রথার অস্তিত্ব। বৈদিক সাহিত্য, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র ও অন্যান্য উপাদান থেকে প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায় ।

2. অগ্রহার ব্যবস্থা : 

প্রাচীনযুগে ভারতে রাজা, অভিজাত ও অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা পূণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মস্থানে এবং ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতেন। এই দানপ্রথা অগ্রহার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে জমিতে দানগ্রহীতার ব্যক্তিগত অধিকার স্থাপিত হয় এবং জমির উপর রাজার বা রাষ্ট্রের মালিকানা হ্রাস পায়।

3. কৃষকের বদ্ধ জীবন : 

আদিমধ্যযুগে (৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) কৃষককে 'হালকর', 'বদ্ধহল' প্রভৃতি শব্দ দ্বারা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি থেকে পণ্ডিতগণ ব্যাখ্যা করেন যে, এযুগে কৃষকরা জমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধু প্রভুর জমিতে শ্রমদানে বাধ্য হয়েছিল। শ্রমদানে বাধ্য ভূমিহীন কৃষকের অস্তিত্ব সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বকে সমর্থন করে।

4. শিল্প-বাণিজ্যের অবনতি : 

আদিমধ্যযুগে স্বনির্ভর গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির প্রসার ঘটেছিল যেখানে কৃষক গ্রাম জীবনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদনে আদৌ আগ্রহী ছিল না। বিভিন্ন পুরাণ থেকে বৈশ্যদের কলিযুগে বাণিজ্যের পেশা ছেড়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত হওয়ার ইঙ্গিত মেলে। এসব বিষয়গুলি আদিমধ্যযুগে ভারতে শিল্প-বাণিজ্যের অবনতির পরিচয় দেয়।

5. নগরের অবক্ষয় : 

শিল্প-বাণিজ্যের অবনতির ফলে প্রাচীন ভারতে এক সময় নগরগুলির অবক্ষয় শুরু হয়। ড. রামশরণ শর্মার মতে, ‘নগরের রক্তাল্পতা' ভারতে আদিমধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল।

অস্তিত্বের বিপক্ষে বক্তাগণ 

ঐতিহাসিক ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, হরবনস মুখিয়া, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ড. রণবীর চক্রবর্তী প্রমুখ মনে করেন যে, প্রাচীন ভারতে কখনোই পশ্চিম ইউরোপের মতো সুস্পষ্ট সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। এই প্রসঙ্গে তাঁরা প্রাচীন ভারতে সামন্ততন্ত্রের অনস্তিত্বের উপাদান হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির অস্তিত্বের কথা তুলে ধরেন—

1. শক্তিশালী কেন্দ্ৰীয় শাসন : 

গুপ্তযুগে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অস্তিত্ব ছিল বলে তাঁরা মনে করেন। তাঁদের মতে, অগ্রহার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় শক্তিকে মোটেই দুর্বল করতে পারেনি। তাঁদের মতে, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অস্তিত্ব থাকায় গুপ্তযুগে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক প্রভুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।

2. কৃষকের মালিকানা : 

অধ্যাপক হরবনস মুখিয়া মনে করেন যে, আলোচ্য সময়কালে ভারতে উৎপাদনের উপকরণের উপর সামন্তপ্রভুর নয়, কৃষকের পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল।

3. সমৃদ্ধ বাণিজ্য : 

ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে উত্তর ভারতে মণ্ডপিকা' এবং দক্ষিণ ভারতে ‘নগরম’ গুলির উল্লেখ করেছেন। ড. রণবীর চক্রবর্তী আদিমধ্যযুগের ‘মনিগ্রামম্' এবং 'নানদেশী' নামে দক্ষিণ ভারতের দুটি শক্তিশালী বণিকসংঘের উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা তারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, আলোচ্য সময়ে ভারতে বাণিজ্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল।

4. নগর সভ্যতার বিকাশ : 

ড. শর্মা প্রমুখের বক্তব্যকে খণ্ডন করে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিভিন্ন লেখমালার সাহায্যে প্রমাণ দিয়েছেন যে, আলোচ্য সময়কালে ভারতে নগরায়ণের ধারা মোটেই সংকুচিত হয়নি।

Next Post Previous Post