ঠাণ্ডা লড়াই কী? ঠাণ্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব কীভাবে হয়েছিল?

ঠাণ্ডা লড়াই কী?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ঘটেছিল বৃহৎ রাষ্ট্ররূপে। দুটি রাষ্ট্রই উন্মুখ ছিল বিশ্ব রাজনীতির উপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে। তবে সশস্ত্র সংঘর্ষের পরিবর্তে উভয়েই নানা অঞ্চলে নিজ নিজ প্রভাবাধীন মিত্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রজোট গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। দীর্ঘমুখী এই স্নায়ু যুদ্ধই ঠাণ্ডা লড়াই নামে পরিচিত।


ঠাণ্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন জোট এক হয়ে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। এই সময় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে একটা সুসম্পর্ক বজায় ছিল। যদিও উভয় দেশের রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা ও জীবন প্রণালী এক ছিল না তবুও তখন তা অতটা প্রকট হয়নি। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও রাশিয়ার স্ট্যালিনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্ব বজায় ছিল। কারণ এরা তিনজন একত্রিত হয়ে ইয়াল্টার সম্মেলন স্বাক্ষরিত করেন। কয়েক বছরের মধ্যে রাজনীতিতে পরিবর্তন সাধিত হল কেননা রুজভেল্টের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হলেন ট্রুম্যান। ট্রুম্যান মনে করতেন স্ট্যালিন ছিলেন সুযোগ সন্ধানী।


তিনি রুজভেল্টকে নিজের জালে জড়িয়ে ছিলেন এবং বাধ্য করেছিলেন ইয়াল্টা সম্মেলন স্বাক্ষর করতে। তাই তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েই সোভিয়েতের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করেন। অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় যে মিত্রতা আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ছিল তা নির্বাপিত হয়। সৃষ্টি হল উভয়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। এইভাবে বিশ্বরাজনীতিতে সৃষ্টি হয় দুই পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায়। ঐতিহাসিক জন মন্তব্য করেছেন ইয়াল্টা সম্মেলনের পর যে পটাসভাম্ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, এখান থেকেই উভয়ের দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়। স্ট্যালিনকে এই ঘটনা খুবই দুঃখ দেয় যে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ সকলেই রাশিয়ার বিরোধিতায় নেমেছে।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার প্রভৃত ক্ষতি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়া এই সময় যথেষ্ট শক্তিশালী দেশ ছিল। এই সময় রাশিয়া নিজেকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করে। এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগামীদের একটি জোট তৈরি হয় এবং আমেরিকা ও পশ্চিমী শক্তিবর্গ একটি জোট তৈরি করে। রাশিয়ার এই আগ্রাসন আমেরিকা তথা পশ্চিমী শক্তিবর্গের মনঃপুত হয়নি। তাই ট্রুম্যান তাঁর রাশিয়া বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন। 

ট্রুম্যান ঘোষণা করলেন, "I believe that we must assist free people to work out their destines in their own way." 

অনেকের মতে এটি হল আমেরিকা ও রাশিয়ার আধিপত্যের লড়াই। আর এই পরিবেশই ঠাণ্ডা যুদ্ধ (Cold War) নামে পরিচিত।


ঠান্ডার যুদ্ধের কারণ

এই যুদ্ধের সৃষ্টির পিছনে কিছু কারণ আছে, সেগুলি নিম্নরূপ:

যদিও এই নিয়ে পন্ডিতমহলে বিতর্কের অবকাশ নেই, তবুও তাদের ভিন্ন মতামত থেকে এই যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে কিছু কথা বলা যায়। যথা-


প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে রাশিয়া ও আমেরিকা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক বেশি সবল ছিল। কিন্তু এই সময় রাশিয়াকে পিছনে ফেলে আমেরিকা সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক বাজার দখল করতে এগিয়ে আসে যা রাশিয়া মেনে নিতে পারেনি। গ্যাব্রিয়েল কালকো মন্তব্য করেছেন যে অর্থনৈতিক কারণই উভয়ের মধ্যে মতপার্থক্য ও যুদ্ধজনিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।


দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক উইলিয়াম প্রমুখ ঐতিহাসিক জন মন্তব্য করেছেন যে, আমেরিকার আদর্শ ছিল রাশিয়ার আদর্শ থেকে ভিন্ন। মার্কিন পুঁজিবাদ ও রুশ সাম্যবাদ এক হতে পারেনি। এই রকম এক আদর্শগত সংঘাত ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূচনা করে।


তৃতীয়ত, ইয়াল্টা সম্মেলনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ও রাশিয়ার স্ট্যালিনের মধ্যে একটি বোঝাপড়া হয়েছিল। কিন্তু রুজভেল্টের মৃত্যুর পর ট্রুম্যান রাষ্ট্রপতি হলে তিনি রাশিয়া বিরোধী কঠোর নীতি গ্রহণ করেন যা স্ট্যালিনের মনে কষ্ট দিয়েছিলেন। তা কোনো কোনো ঐতিহাসিক ঠাণ্ডা যুদ্ধের জন্য ট্রুম্যানের কঠোর নীতিকে দায়ী করেন।


চতুর্থত, চিরায়ত ইতিহাসের ব্যাখ্যাকারীগণ মন্তব্য করেছেন যে, আমেরিকা ও রাশিয়ার সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও শাসন প্রণালীতে বিস্তর দূরত্ব ছিল। John Spawar বলেছেন এই দূরত্ব ঠাণ্ডা যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছিল।


পঞ্চমত, পন্ডিতমহলে এই রকম কথাও শোনা যায় যে আমেরিকা ও রাশিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি যুদ্ধের পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। এর জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়, উভয়েই সমানভাবে দায়ী। আমেরিকার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করেনি, তেমনই রাশিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তারে আমেরিকার বাধাদান উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটায়।


ষষ্ঠত, অনেকে ঠাণ্ডা যুদ্ধেৰ জন্য রাজনৈতিক কারণকে দায়ী করেন। যেমন, জার্মানী রাশিয়া আক্রমণ করলে রাশিয়া মিত্রশক্তির কাছে আবেদন করে যাতে একটি দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হয়। রাশিয়া সাহায্যের আশ্বাস না পেয়ে নিজের ক্ষমতায় জার্মানীকে পরাস্ত করে তখন মিত্রশক্তি দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলে। এইভাবে পদাঘাত করে। পুনরায় তার ক্ষতস্থানে প্রলেপ দেওয়ার কূটনীতি সম্পর্কে রাশিয়া ওয়াকিবহাল হয়।


সপ্তমত, আমেরিকার সঙ্গে স্ট্যালিনের ঠিক হয় তারা যুগ্মভাবে জাপানের উপর আঘাত হানবে। কিন্তু ইতিমধ্যে আমেরিকা পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলায় রাশিয়াকে না জানিয়ে জাপানের উপর এককভাবে আক্রমণ করে। এই রকম অপমান স্ট্যালিন সহ্য করতে পারেনি। এই যুদ্ধের জন্য কেবলমাত্র আমেরিকা এককভাবে দায়ী ছিল না। স্ট্যালিনের সাম্রাজ্য বিস্তার আমেরিকা উদ্যমতা পৃথিবীকে দুটি শক্তিকে বিভক্ত করে দেয়। আর এই স্থান থেকেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের কারণগুলি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

Next Post Previous Post