মার্শাল পরিকল্পনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
মার্শাল পরিকল্পনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে পশ্চিম ইউরোপে এক তীব্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি এরূপ হয় যে, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির অর্থসংকট নিরসনের জন্য একমাত্র পথ বাইরে থেকে খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করা। ডলারের অভাবে তা অসম্ভব হয়ে ওঠে। মার্কিনীদের মনে এই উদ্বেগ সৃষ্টি হয় যে ঠান্ডা লড়াইজনিত রাজনীতির কারণে সাম্যবাদ পশ্চিম ইউরোপের দিকে ক্রমেই অগ্রসর হবে এবং ইউরোপ ক্রমেই সোভিয়েত প্রভাবাধীন অঞ্চল হয়ে পড়বে।
এমতাবস্থায় ১৯৪৭ খ্রীঃ-এর ৫ই জুন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জর্জ সি. মার্শাল হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাষণ দেন। এতে তিনি বলেন অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন সম্পর্কিত নীতি কোনো দেশ মতাদর্শের বিরুদ্ধে নয়, সার্বিকভাবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হতাশা ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল, এক অখণ্ড ও সার্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থাপন, যা বিশ্বের বাহারী অর্থনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে।
মার্শাল পরিকল্পনা দু'ভাবে রূপায়িত হয়। একদিকে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে আর্থিক সংহতি এবং অন্যদিকে মার্কিনদের আর্থিক সহায়তা দান। এর জন্য গঠিত হয় 'OPEC' নামে একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় যৌথ কাঠামো। এর দ্বারা ইউরোপীয় দেশগুলি পুনরুজ্জীবন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর জন্য ব্যয়-বরাদ্দ হয় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু পাশ হয় মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার যা অর্থনৈতিক প্রশাসনের
হাতে দেওয়া হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানী এর অর্ধাংশ পায়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই দিক থেকেই এই পরিকল্পনা সফল হয়। ইউরোপের হতাশা ও মন্দা দূর হয়ে উৎপাদনের মাত্রা প্রাক যুদ্ধ স্তর থেকে ২৫% বৃদ্ধি পায়। ব্রিটেনের রপ্তানি বাড়ে, ফ্রান্সের মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা কমে যায়। ১৯৫২ সালে এই পরিকল্পনার পরিসমাপ্তি ঘটলেও এই সময় পর্যন্ত শিল্প, কৃষিসহ অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে উৎপাদনের মাত্রা ৪৫% বৃদ্ধি পায়। ফলে সমাজজীবনেও সুস্থিরতা ফিরে আসে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রও লাভবান হয়। পরিকল্পনানুসারে, সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলির আমদানির ১% মার্কিন থেকে আসে। যুদ্ধোত্তর বিশ্ব অর্থনীতির অগ্রগতিতে IMF-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার আবার বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। মার্কিন উদ্যোগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থায় সংহতির জন্য 'GATT' গঠিত হয়। তাই বলা যায় রাজনৈতিক দিক থেকে পশ্চিম ইউরোপে ভারসাম্য স্থির হওয়ার পাশাপাশি সাম্যবাদী অভ্যুত্থানের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়।
তবে, এই পরিকল্পনার কারণে ঠান্ডা লড়াই-এর ফলে উদ্ভূত শক্তি দুটির সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে পরিকল্পনাটি করা হয়েছে, এটা মেনে নেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ ১৯৪৫ খ্রীঃ-এর যুদ্ধশেষের দুবছর পর, ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার পর তা বলবৎ করার জন্য মার্শাল পরিকল্পনা করা হয় বলে মনে করা হয়। এক কথায়, মার্শাল পরিকল্পনা ছিল অর্থনৈতিক সাহায্য দানের আবরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোভিয়েত বিরোধী পদক্ষেপ।