ট্রুম্যান নীতি সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

★★★★★
ট্রুম্যান নীতি ১৯৪৭ সালে গ্রীস ও তুরস্ককে সাহায্য দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনে, যা ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা করে।
ট্রুম্যান নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা

ট্রুম্যান নীতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অসুবিধাজনক অবস্থায় ফেলে। তার একদিকে পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত গতিবৃদ্ধি, অন্যদিকে ফ্রান্স ও ইতালীতে কমিউনিজমের প্রকোপে ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোণঠাসা হতে থাকে। এই সময়, পূর্ব ইউরোপের নিকটবর্তী গ্রীস ও তুরস্ক মার্কিন সরকারকে উত্তেজিত করে। ১৯৪৬ সালে গ্রীসের রাজতন্ত্রের অনুগামী দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা (কমিউনিস্ট) বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। বিদ্রোহীরা যুগোশ্লাভিয়া ও বুলগেরিয়া থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠলে গ্রীসে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এতদিন ব্রিটেন গ্রীসকে সহায়তা করত, মার্কিনদের অনুরোধ সত্ত্বেও তারা সাড়া দেয় নি। কিন্তু গ্রীসের সাম্যবাদী গেরিলা আক্রমণ বিদেশী সাহায্য না পেলে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না বলেই রাজতন্ত্রী সরকার উপলব্ধি করে। তারা ব্রিটেনের কাছে সাহায্যের দাবি জানায়। কিন্তু, যুদ্ধাবসানে ব্রিটেনের আর্থিক ও সামরিক অবস্থা খারাপ থাকায় তারা গ্রীসকে সহায়তা দান করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। এরই সঙ্গে ১৯৪৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে তারা এক বার্তা পাঠিয়ে মার্কিনদের গ্রীসকে সাহায্য দানের অনুরোধ জানায়। ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের ১২ই মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে প্রদত্ত ভাষণে গ্রীস ও তুরস্ককে মার্কিন সহায়তা দানের কথা ঘোষণা করেন। তাঁর বিবৃতিতেও মানবিক ও আদর্শগত যুক্তি দেখানো হয়েছে।


মার্কিন কংগ্রেসের ভাষণে ট্রুম্যান যে সমস্ত নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ

  • (১) ট্রুম্যান নমনীয়তার পরিবর্তে রাশিয়ার প্রতি কঠোর ও বিরোধী নীতির প্রবর্তন করেন, যাকে জঙ্গীনীতি বলা যায়। আদর্শকে সামনে রেখে এমনভাবে তিনি নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যা সোভিয়েত-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ককে পুনরায় তুলে ধরে।
  • (২) ট্রুম্যান নীতি ইউরোপে মার্কিন হস্তক্ষেপ বন্ধ করে। অনেকে আবার একে মনরো নীতির সাথে তুলনা করেছেন।
  • (৩) ট্রুম্যান নীতির দ্বারা ব্রিটেনের সর্বত্র আধিপত্যের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। তবে এর জন্য ব্রিটেনের আর্থিক দুবর্লতাকে দায়ী করা যায়। বলা যায়, ব্রিটেনই মার্কিনদের এই নীতি গ্রহণে বাধ্য করেছে।
  • (৪) সমগ্র বিশ্বে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষিত হলেও এর পিছনে ছিল মার্কিন সামরিক নীতি। বলকান অঞ্চলে সোভিয়েত অগ্রসর প্রতিরোধ ও মধ্য প্রাচ্যে তেলের অফুরন্ত ভাণ্ডারকে নিজ অঞ্চলে আনার জন্য মার্কিনীরা গ্রীস ও তুরস্ককে সহায়তা করে। ট্রুম্যান তাঁর ভাষণে এর উল্লেখ না করলেও সোভিয়েত বিরোধিতার কারণে একথা অনুমান করাই যেতে পারে।
  • (৫) ট্রুম্যান ড্রাফট্রিনে আরও বলা হয়, কোথাও শান্তি ভঙ্গ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসুবিধে বলে ধরা হবে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে সোভিয়েতকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করার ক্ষেত্রে।
  • (৬) ট্রুম্যান ডকট্রিনের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রপুঞ্জকে অগ্রাহ্য করে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার দুটি তাত্ত্বিক দিক ছিল-একটি হল প্রয়োগগত, অপরটি হল বিশ্বজনীন। আর এই দুই দিকই সম্ভব হয় গ্রীস ও তুরস্ককে আর্থিক ও সামরিক সাহায্যদানের মধ্যে দিয়ে।


যুদ্ধোত্তর বিশ্বরাজনীতিতে ট্রুম্যান নীতির গুরুত্ব অপরিসীম। যুদ্ধ-পূর্ব মার্কিন নিষ্ক্রিয় ও নির্দিষ্ট পররাষ্ট্রনীতি ট্রুম্যানের ঘোষণার ফলে শীঘ্রই সক্রিয় ও হস্তক্ষেপমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তিত হয়। তা ক্রমেই তীব্র হয়ে ঠান্ডা যুদ্ধ ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই ট্রুম্যান নীতিকে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির সূচনা বলা যায়, যাকে পরবর্তী মার্শাল প্ল্যান ও আইজেনহাওয়ারড কট্রিনের পথপ্রদর্শক বলা যায়।


FAQ Question

প্রশ্ন ১: ট্রুম্যান নীতি কী?

উত্তর: ট্রুম্যান নীতি হল মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস. ট্রুম্যানের ১৯৪৭ সালের ঘোষণা, যা গ্রীস ও তুরস্ককে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিরোধের জন্য করা হয়েছিল।


প্রশ্ন ২: ট্রুম্যান নীতি কেন গ্রহণ করা হয়েছিল?

উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণ এবং ইউরোপে কমিউনিজমের উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্রুম্যান নীতি গ্রহণ করে। বিশেষ করে গ্রীস ও তুরস্কে কমিউনিজমের বিপদ মোকাবিলা করার জন্য।


প্রশ্ন ৩: গ্রীসে গৃহযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল?

উত্তর: গ্রীসে কমিউনিস্ট বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রীসকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে সমর্থন করে। ব্রিটেন সাহায্য করতে অপারগ হওয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকা পালন করে।


প্রশ্ন ৪: ট্রুম্যান নীতির বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

উত্তর: ট্রুম্যান নীতির বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রাশিয়ার প্রতি কঠোর নীতি, ইউরোপে মার্কিন হস্তক্ষেপ, ব্রিটিশ আধিপত্য কমানো, এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার আদর্শের আড়ালে সামরিক কৌশল অন্তর্ভুক্ত ছিল।


প্রশ্ন ৫: ট্রুম্যান নীতি কি রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূমিকাকে প্রভাবিত করেছিল?

উত্তর: হ্যাঁ, ট্রুম্যান নীতি রাষ্ট্রপুঞ্জকে অগ্রাহ্য করে মার্কিন প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দেয়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক হস্তক্ষেপের প্রতিফলন।


প্রশ্ন ৬: ট্রুম্যান নীতি কেন ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা হিসেবে গণ্য করা হয়?

উত্তর: ট্রুম্যান নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ও হস্তক্ষেপমুখী পররাষ্ট্রনীতির সূচনা করে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের ভিত্তি স্থাপন করে। এটি পরবর্তীতে মার্শাল প্ল্যান ও আইজেনহাওয়ার ডকট্রিনের পথপ্রদর্শক ছিল।


প্রশ্ন ৭: ট্রুম্যান নীতি কোন দেশগুলিকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিল?

উত্তর: ট্রুম্যান নীতি সরাসরি গ্রীস ও তুরস্ককে প্রভাবিত করেছিল, তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিরোধ করার জন্য।


প্রশ্ন ৮: ট্রুম্যান নীতি মার্কিন-সোভিয়েত সম্পর্ককে কিভাবে প্রভাবিত করেছে?

উত্তর: ট্রুম্যান নীতি মার্কিন-সোভিয়েত সম্পর্ককে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে, কারণ এটি সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিরোধের জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে, যা ঠান্ডা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ায়।

Tags:
Next Post Previous Post

You May Also Like

Editor
ইতিহাস পাঠশালা

যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু অতীত তাই হল ইতিহাস৷ ইতিহাস পাঠশালা হল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত, উত্তরধর্মী, প্রবন্ধ মূলক পাঠ সহায়ক একটি ব্লগ৷ মূলত ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরাই এই ব্লগের প্রধান লক্ষ্য৷