কলকাতার ফুটবল ময়দানে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের আগমন ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। একদিকে মোহনবাগান যখন পশ্চিম বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, ঠিক তখন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ফুটবলপ্রেমী ও খেলোয়াড়দের জন্য এক নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই পটভূমিতেই জন্ম নেয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব, যা পরবর্তীকালে 'লাল-হলুদ ব্রিগেড' নামে পরিচিতি লাভ করে এবং ভারতীয় ফুটবলে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ১৯২০ সালের ১লা আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিষ্ঠার পটভূমি: এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন (Background of Establishment: A Historical Need)
বিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতার ফুটবল জগতে বর্ণবাদ এবং অঞ্চলভিত্তিক বিভেদ প্রকট ছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ ক্লাবগুলির দাপট ছিল বেশি, এবং ভারতীয় ক্লাবগুলির মধ্যেও এক প্রকার বিভাজন ছিল। পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের প্রায়শই উপেক্ষা করা হতো অথবা কলকাতার অন্য বড় ক্লাবগুলিতে তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হতো না। এই প্রেক্ষাপটে একটি বিশেষ ঘটনা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্মকে ত্বরান্বিত করে:
- জোরবাগান ক্লাবের ঘটনা: ১৯২০ সালে আইএফএ শিল্ডের সেমিফাইনালে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলার কথা ছিল জোরবাগান ক্লাবের। সেই ম্যাচের আগে জোরবাগান ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের দলের পূর্ববঙ্গীয় সেন্টার-হাফ ফুটবলার শৈলেশ চন্দ্র বসুকে দলে রাখতে অস্বীকার করে। ক্লাবের অন্যতম কর্তা এবং তৎকালীন ঢাকার জমিদার রাজা মনমথ নাথ চৌধুরী এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হন। তিনি জোরবাগান থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পূর্ববঙ্গের খেলোয়াড়দের জন্য একটি নতুন ক্লাব গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রাজা মনমথ নাথ চৌধুরীর এই প্রতিবাদ এবং পূর্ববঙ্গের মানুষের বঞ্চনার অনুভূতিই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি তৈরি করে।
প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা (Establishment and Founders)
এই ঐতিহাসিক প্রয়োজনের তাগিদেই ১৯২০ সালের ১লা আগস্ট ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতার বাগবাজারে সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে এই ক্লাবটি আত্মপ্রকাশ করে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠায় যাঁরা প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন:
- সুরেশচন্দ্র চৌধুরী: তিনি ছিলেন ক্লাবের প্রাণপুরুষ এবং প্রথম সম্পাদক। তাঁর বাড়ি থেকেই ক্লাবের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়।
- রাজা মনমথ নাথ চৌধুরী: তিনি ছিলেন ক্লাবের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং অর্থনৈতিক সহায়তাকারী। জোরবাগান ক্লাবের ঘটনাটিই তাকে ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্ঠার দিকে ঠেলে দেয়।
- তরিত ভূষণ রায়: তিনি ছিলেন ক্লাবের প্রথম সচিব (সেক্রেটারি)।
- অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন শৈলেশ চন্দ্র বসু, এম.সি. ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ।
এই সকল ব্যক্তিবর্গ পূর্ববঙ্গের ফুটবল প্রতিভাদের একটি নিজস্ব মঞ্চ দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
উদ্দেশ্য ও দর্শন (Objectives and Philosophy)
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও দর্শন, যা কেবল ফুটবল খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না:
- পূর্ববঙ্গের খেলোয়াড়দের সুযোগ: পূর্ববঙ্গের প্রতিভাবান ও বঞ্চিত ফুটবলারদের জন্য একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।
- আত্মপরিচয় ও ঐক্য: ফুটবলের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গীয় মানুষদের মধ্যে একতা, আত্মমর্যাদা এবং আত্মপরিচয় সুদৃঢ় করা।
- ফুটবলের প্রসার: সামগ্রিকভাবে বাংলার ফুটবলকে আরও শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করে তোলা।
- লাল ও হলুদ রঙ: ক্লাবের জার্সির জন্য লাল ও হলুদ রঙ নির্বাচন করা হয়। কথিত আছে, লাল রঙ বিপ্লব, সংগ্রাম ও আবেগের প্রতীক এবং হলুদ রঙ বিজয় ও সাফল্যের প্রতীক।
প্রাথমিক যাত্রা ও স্বীকৃতি (Initial Journey and Recognition)
প্রতিষ্ঠার পরপরই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। ১৯২০ সালের শেষের দিকে ক্লাবটি দ্বিতীয় বিভাগে খেলোয়াড়দের নাম নথিভুক্ত করে। তবে তাদের স্বপ্ন ছিল প্রথম বিভাগে খেলার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইস্টবেঙ্গল নিজেদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রমাণ করে এবং দ্রুতই ফুটবল মহলে পরিচিতি লাভ করে।
- মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল প্রতিদ্বন্দ্বিতা: ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মোহনবাগান ক্লাবের সাথে তাদের এক ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবলমাত্র খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং দুই বাংলার আত্মপরিচয়ের এক প্রতীকী লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। এই ডার্বি ম্যাচগুলি আজও ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম আকর্ষণ।
ইস্টবেঙ্গল: শুধু একটি ক্লাব নয়, একটি আবেগ (East Bengal: More Than Just a Club, An Emotion)
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পরেও শুধু একটি ফুটবল ক্লাব হিসেবেই নয়, এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এক আবেগের নাম। বিশেষ করে দেশভাগের পর যখন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ছিল তাদের কাছে আত্মপরিচয় ও শিকড়ের প্রতীক। মাঠের লাল-হলুদ জার্সি তাদের কাছে শুধুমাত্র খেলার পোশাক ছিল না, ছিল হারানো ভূমি, স্মৃতি আর নতুন করে নিজেদের প্রমাণ করার সংকল্পের প্রতীক।
এটি কেবল একটি ক্লাব নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, একটি আবেগ, একটি জীবনদর্শন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলেছে।
উপসংহার (Conclusion)
১৯২০ সালের ১লা আগস্ট স্থাপিত হওয়া ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের বঞ্চনা ও আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গী করে যে ক্লাবটির জন্ম হয়েছিল, তা আজ শুধু একটি ফুটবল দল নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়, সংগ্রাম ও গৌরবের এক জ্বলন্ত প্রতীক। শতবর্ষ পেরিয়েও ইস্টবেঙ্গল বাংলার ফুটবল এবং বাঙালি জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে। এর ঐতিহ্য, এর লড়াই, এর আবেগ চিরকাল অমলিন থাকবে।
Post a Comment