মুঘল আমলের শিল্পী ও লেখকদের নাম ও গ্রন্থের তালিকা

মুঘল আমলের প্রধান শিল্পী ও লেখকদের নাম, তাদের সৃষ্টিকর্ম এবং সেই সময়ের সমসাময়িক সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

মুঘল সাম্রাজ্য শুধু রাজনৈতিক বিস্তারের জন্যই নয়, বরং শিল্পকলা, সাহিত্য ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যও বিখ্যাত। এই পৃষ্ঠপোষকতা ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ সূচনা করেছিল, যেখানে পারস্য, মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় শৈলীর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল।


#### ১. বাবর (১৫২৬-১৫৩০)

   সাহিত্য:

       বাবর নিজে ছিলেন একজন সুশিক্ষিত মানুষ এবং তুর্কি ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক।

       গ্রন্থ: তাঁর আত্মজীবনী 'তুজুক-ই-বাবরী' (তুর্কি ভাষায়) বা এর ফার্সি অনুবাদ 'বাবরনামা' মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উৎস। এটি কেবল একটি আত্মজীবনী নয়, বরং সমসাময়িক ভূগোল, রাজনীতি, প্রকৃতি ও সমাজের এক বিস্তারিত চিত্র।


#### ২. হুমায়ুন (১৫৩০-১৫৪০, ১৫৫৫-১৫৫৬)

   শিল্পকলা (চিত্রকলা):

       হুমায়ুন পারস্যের সাফাভি দরবারে থাকাকালীন সেখানকার চিত্রশিল্প দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

       তিনি পারস্য থেকে প্রখ্যাত শিল্পী মীর সাইয়িদ আলী (Mir Sayyid Ali) ও আবদুস সামাদ (Abdus Samad)-কে ভারতে আমন্ত্রণ জানান। এই দুই শিল্পীই মুঘল চিত্রকলার ভিত্তি স্থাপন করেন, যা ভারতীয় ও পারস্য শৈলীর সংমিশ্রণে একটি নতুন ধারা তৈরি করে।

   সাহিত্য:

       গ্রন্থ: হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম তাঁর রাজত্বের ইতিহাস 'হুমায়ুননামা' রচনা করেন, যা মুঘল ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নারী দৃষ্টিকোণ থেকে লিখিত বিবরণ।


#### ৩. আকবর (১৫৫৬-১৬০৫)

আকবরের শাসনকালকে মুঘল চিত্রকলা ও সাহিত্যের 'স্বর্ণযুগ' বলা হয়। তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।


   শিল্পকলা (চিত্রকলা):

       আকবর একটি বিশাল চিত্রশালা (Atelier) প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে পারস্য ও ভারতীয় উভয় ধারার প্রায় ১০০ জনের বেশি শিল্পী কাজ করতেন।

       শৈলী: এই সময়ের চিত্রকলা ছিল ইন্দো-ফার্সি বা মুঘল শৈলীর এক অপূর্ব মিশ্রণ, যা জীবন্ত বিবরণ, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং দরবারী দৃশ্যের উপর জোর দিত।

       উল্লেখযোগ্য শিল্পী:

           দসওয়ান্ত (Daswant): একজন হিন্দু শিল্পী, যিনি 'হামজানামা' চিত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

           বসাওয়ান (Basawan): অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী, যিনি মানবিক প্রতিকৃতি এবং জটিল দৃশ্যের জন্য পরিচিত ছিলেন।

           কেশব (Keshav), মিসকিন (Miskin), ফররুখ বেগ (Farrukh Beg): অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী।

       উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম:

           'হামজানামা' (Hamzanama): মুঘল চিত্রকলার প্রথম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা প্রায় ১৪০০টি চিত্রের সংকলন।

           'রাজমনামা' (Razmnama): মহাভারতের ফার্সি অনুবাদের সচিত্র সংস্করণ।

           'আকবরনামা' (Akbarnama): আকবরের জীবনের উপর ভিত্তি করে সচিত্র পাণ্ডুলিপি।


   সাহিত্য:

       আকবরের সময় ফার্সি ছিল রাজভাষা, কিন্তু তিনি সংস্কৃত ও হিন্দি সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

       ফার্সি সাহিত্য:

           আবুল ফজল (Abul Fazl): আকবরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও উপদেষ্টা।

               গ্রন্থ: 'আকবরনামা' (Akbarnama) – আকবরের রাজত্বের বিস্তারিত ইতিহাস, এবং এর তৃতীয় খণ্ড 'আইন-ই-আকবরী' (Ain-i-Akbari) – মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর বিশদ বিবরণ।

           ফৈজি (Faizi): আবুল ফজলের ভাই এবং রাজকীয় কবি।

               কর্ম: তিনি ফার্সি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন ছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে মহাভারত ও রামায়ণ ফার্সিতে অনূদিত হয়। মহাভারতের ফার্সি অনুবাদের নাম ছিল 'রাজমনামা' (Razmnama)।

           আব্দুল কাদির বাদায়ুনী (Abdul Qadir Badauni): আকবরের একজন সমালোচক ঐতিহাসিক।

               গ্রন্থ: 'মুনতাখাব-উৎ-তাওয়ারিখ' (Muntakhab-ut-Tawarikh) – আকবরের শাসনকালের একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনামূলক ইতিহাস।

           নিজামুদ্দিন আহমেদ (Nizamuddin Ahmad):

               গ্রন্থ: 'তবকাত-ই-আকবরী' (Tabaqat-i-Akbari) – মুঘল ভারতের একটি সাধারণ ইতিহাস।

       সংস্কৃত ও হিন্দি সাহিত্য:

           তুলসীদাস (Tulsidas): যদিও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাননি, তিনি আকবরের সমসাময়িক ছিলেন এবং 'রামচরিতমানস' (Ramcharitmanas) (অবধী হিন্দিতে রামায়ণের অনুবাদ) রচনা করেন, যা উত্তর ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

           সুরদাস (Surdas): তিনিও আকবরের সমসাময়িক ছিলেন এবং ব্রজভাষায় কৃষ্ণভক্তি কাব্য 'সুরসাগর' (Sursagar) রচনা করেন।

           আব্দুর রহিম খান-ই-খানান (Abdur Rahim Khan-i-Khanan): বৈরাম খানের পুত্র। তিনি হিন্দি ও ফার্সি উভয় ভাষায় কবিতা লিখতেন। তাঁর দোহাগুলো (dohas) হিন্দি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

           মালিকা মুহাম্মদ জায়সী (Malik Muhammad Jayasi): যদিও শের শাহ সুরির সমসাময়িক, তার বিখ্যাত কাব্য 'পদুমাবত' (Padumavat) (অবধী ভাষায় লিখিত) আকবরের সময়েও অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল।


#### ৪. জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭)

জাহাঙ্গীরের শাসনকালে মুঘল চিত্রকলা তার পরিপূর্ণতা লাভ করে। তিনি নিজেও একজন গুণী শিল্পী ও রসিক ছিলেন।


   শিল্পকলা (চিত্রকলা):

       জাহাঙ্গীর চিত্রকলার একজন মহান সমঝদার ছিলেন এবং শিল্পীদের কাজ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে তিনি একই চিত্রকর্মে বিভিন্ন শিল্পীর অবদান শনাক্ত করতে পারতেন।

       শৈলী: তাঁর সময়ে প্রকৃতি, প্রাণী, উদ্ভিদ ও পাখির চিত্রাঙ্কনে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। ইউরোপীয় চিত্রকলার প্রভাবও এই সময়ে লক্ষ্য করা যায়।

       গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী:

           উস্তাদ মনসুর (Ustad Mansur): বিখ্যাত প্রাণী ও উদ্ভিদ চিত্রকর। তাকে 'নাদির-উল-আসর' (Nadir-ul-Asr) বা 'যুগের বিস্ময়' উপাধি দেওয়া হয়।

           আবুল হাসান (Abul Hasan): প্রতিকৃতি চিত্রকর এবং দরবারী দৃশ্যের চিত্রণে সিদ্ধহস্ত। তাকে 'নাদির-উজ-জামান' (Nadir-uz-Zaman) বা 'যুগের সেরা চিত্রকর' উপাধি দেওয়া হয়।

           বিশনদাস (Bishandas): প্রতিকৃতি অঙ্কনে দক্ষ।

           গোবর্ধন (Goverdhan): দরবারী ও আধ্যাত্মিক দৃশ্যের শিল্পী।

   সাহিত্য:

       গ্রন্থ: জাহাঙ্গীর নিজেই তাঁর আত্মজীবনী 'তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী' (Tuzuk-i-Jahangiri) বা 'জাহাঙ্গীরনামা' রচনা করেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং রাজত্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিশদ বিবরণ।


#### ৫. শাহজাহান (১৬২৮-১৬৫৮)

শাহজাহানের শাসনকাল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ হলেও, চিত্রকলা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাও বজায় ছিল।


   শিল্পকলা (চিত্রকলা):

       এই সময়ের চিত্রকলায় বাস্তবতার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। মূলত রাজকীয় প্রতিকৃতি, দরবারের দৃশ্য, উৎসব এবং শিকারের চিত্রাঙ্কনে জোর দেওয়া হয়।

       গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী:

           মুহম্মদ ফকিরুল্লাহ খান (Muhammad Faqirullah Khan): প্রধান শিল্পী।

           মীর হাসিম (Mir Hashim), হনুমান (Hanuman), গোবর্ধন (Goverdhan): অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিল্পী।

   সাহিত্য:

       গ্রন্থ:

           আব্দুল হামিদ লাহোরী (Abdul Hamid Lahori): শাহজাহানের রাজত্বের বিস্তারিত ইতিহাস 'বাদশাহনামা' (Badshahnama) রচনা করেন।

           মুহম্মদ সালেহ কম্বো (Muhammad Saleh Kamboh): আরও একটি 'বাদশাহনামা' রচনা করেন।

       দারাসিকোহ (Dara Shikoh): শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র, একজন সুফি এবং পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন।

           কর্ম: তিনি হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধনে আগ্রহী ছিলেন।

           অনুবাদ: ৫২টি উপনিষদ ফার্সি ভাষায় 'সির-ই-আকবর' (Sirr-i-Akbar) নামে অনুবাদ করেন। এছাড়াও ভগবদ্গীতা এবং যোগবশিষ্ট-ও অনুবাদ করেন।

           গ্রন্থ: 'মাজমা-উল-বাহরাইন' (Majma-ul-Bahrain) ('দুই সাগরের মিলন') – সুফি দর্শন এবং হিন্দু ধর্মের অভিন্নতার উপর ভিত্তি করে রচিত।


#### ৬. ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭)

ঔরঙ্গজেবের শাসনামলে রাজকীয় শিল্পকলা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুটা ভাটা পড়ে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পকলার প্রতি ততটা আগ্রহী ছিলেন না।


   শিল্পকলা (চিত্রকলা):

       রাজকীয় দরবারে চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা কমে যাওয়ায় অনেক শিল্পী স্থানীয় রাজ্যগুলিতে যেমন রাজস্থান, পাহাড়ী রাজ্যগুলি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দরবারে চলে যান। এর ফলে আঞ্চলিক মুঘল শৈলীর জন্ম হয়।

   সাহিত্য:

       ঔরঙ্গজেব নিজে একজন পন্ডিত ছিলেন এবং ইসলামিক আইনশাস্ত্র অধ্যয়নে আগ্রহী ছিলেন।

       গ্রন্থ: তাঁর নির্দেশে ইসলামিক আইনের একটি বৃহৎ সংকলন 'ফতোয়া-ই-আলমগীরী' (Fatawa-i-Alamgiri) প্রস্তুত করা হয়।

       ঐতিহাসিক কাজ: যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইতিহাস রচনার বিরোধী ছিলেন, তার রাজত্বের একটি বিস্তারিত ইতিহাস 'আলমগীরনামা' (Alamgirnama) লিখেছেন মির্জা মুহম্মদ কাজিম (Mirza Muhammad Kazim)।


মুঘল শিল্পকলা ও সাহিত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য:


   সমন্বয়বাদী ধারা: মুঘল শিল্পকলা ও সাহিত্যে পারস্য, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় উপাদানগুলির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল, যা এক নতুন ভারতীয়-ইসলামিক শৈলীর জন্ম দেয়।

   রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা: শাসকদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা শিল্পকলা ও সাহিত্যের বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

   বাস্তববাদিতা ও বিশদ বিবরণ: মুঘল চিত্রকলা তার বাস্তবসম্মত চিত্রণ এবং সূক্ষ্ম বিশদ বিবরণের জন্য পরিচিত ছিল।

   ভাষা বৈচিত্র্য: ফার্সি রাজভাষা হলেও, হিন্দি, সংস্কৃত এবং তুর্কি ভাষার উন্নতিও সাধিত হয়েছিল।

   অনুবাদের গুরুত্ব: বহু সংস্কৃত ও হিন্দি গ্রন্থ ফার্সিতে অনূদিত হওয়ায় জ্ঞান ও সংস্কৃতির আদান-প্রদান সহজ হয়।

   ব্যক্তিগত বিবরণ: শাসকদের আত্মজীবনী (বাবরনামা, তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী) সমসাময়িক সমাজের মূল্যবান উৎস।