মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান দাবি – ভারত বিভাজন ও স্বাধীনতা (Indian Muslim League and the Demand for Pakistan – Partition and Independence)
ভূমিকা:
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাজনৈতিক সত্তার ধারণা ক্রমশ জোরালো হতে থাকে, যা অবশেষে পাকিস্তান দাবির জন্ম দেয় এবং ভারত বিভাজনে পর্যবসিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি, মুসলিমদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পরিচয়ের সংকট, এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
I. মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক লক্ষ্য
* প্রতিষ্ঠা: ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় (বর্তমান বাংলাদেশ) সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
* প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ: ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব মহসিন-উল-মুলক, নবাব ভিকার-উল-মুলক, আগা খান তৃতীয় প্রমুখ।
* প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট:
* ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার উদ্বেগ।
* আলীগড় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের 'দ্বি-জাতি তত্ত্বের' প্রভাব।
* ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা।
* মুসলিমদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব।
* প্রাথমিক লক্ষ্য:
* ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলিমদের আনুগত্য বৃদ্ধি করা।
* মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে পেশ করা।
* মুসলিমদের মধ্যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের (বিশেষত হিন্দুদের) প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব রোধ করা।
II. মুসলিম লীগের রাজনৈতিক বিবর্তন ও পাকিস্তান ধারণার উন্মেষ
1. লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬): প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে একটি বোঝাপড়া হয়, যা লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে মুসলিম লীগ কংগ্রেসের স্বশাসনের দাবিকে সমর্থন করে এবং কংগ্রেস মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন মণ্ডলীর দাবি মেনে নেয়। এটি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক বিরল উদাহরণ ছিল।
2. মুসলিম লীগের ক্ষমতার বৃদ্ধি: ১৯২০-এর দশক থেকে মুসলিম লীগ ধীরগতিতে শক্তি অর্জন করে। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেসের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর এবং কয়েকটি প্রদেশে কংগ্রেসের সরকার গঠনের পর, মুসলিম লীগ নিজেদের প্রান্তিক বলে মনে করে। এই সময় থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে মুসলিমদের জন্য পৃথক ভূখণ্ডের দাবি জোরদার হতে থাকে।
3. স্যার মুহাম্মদ ইকবালের ধারণা (১৯৩০): এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে কবি ও দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা পেশ করেন। তিনি সিন্ধু, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তান নিয়ে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন।
4. চৌধুরী রহমত আলীর 'পাকিস্তান' নাম (১৯৩৩): কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ১৯৩৩ সালে 'Now or Never; Are We to Live or Perish Forever?' শীর্ষক পুস্তিকায় 'পাকিস্তান' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। (P-পাঞ্জাব, A-আফগান, K-কাশ্মীর, S-সিন্ধু এবং TAN-বেলুচিস্তান)।
5. মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভূমিকা: প্রথম দিকে জিন্নাহ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের পর এবং কংগ্রেসের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যর্থতার পর, তিনি 'দ্বি-জাতি তত্ত্বের' ঘোর সমর্থক হয়ে ওঠেন।
III. লাহোর প্রস্তাব (পাকিস্তান প্রস্তাব) – ১৯৪০
* তারিখ ও স্থান: ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে এই ঐতিহাসিক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
* প্রস্তাবক: বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক।
* মূল দাবি: প্রস্তাবটিতে বলা হয় যে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিকে একত্রিত করে 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ' (Independent States) গঠন করতে হবে এবং এই রাজ্যগুলি স্বাধীন ও সার্বভৌম হবে।
* তাৎপর্য: এটিই ছিল মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক ভূখণ্ডের প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবি। যদিও প্রস্তাবটিতে 'পাকিস্তান' শব্দটি সরাসরি ব্যবহৃত হয়নি, এটিই 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামে পরিচিতি লাভ করে এবং পরবর্তীতে মুসলিম লীগের প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪৬ সালে প্রস্তাবের 'রাজ্যসমূহ' (states) অংশটি 'একক রাজ্য' (a state) রূপে সংশোধিত হয়, যা একটি একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিকে আরও স্পষ্ট করে।
IV. দেশভাগের পথে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ও পরিকল্পনা
1. ক্রিপস মিশন (১৯৪২):
* প্রেক্ষাপট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের সমর্থন আদায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে একটি মিশন ভারতে পাঠায়।
* প্রস্তাবনা: যুদ্ধ শেষে ভারতকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস প্রদান, একটি সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠন, এবং যে কোনো প্রদেশ নতুন সংবিধান মানতে না চাইলে তাদের জন্য পৃথক সংবিধান রচনার অধিকার।
* ব্যর্থতার কারণ: কংগ্রেস তাৎক্ষণিক পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং মুসলিম লীগ মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায় এটি প্রত্যাখ্যান করে।
2. রাজাগোপালাচারী ফর্মুলা (১৯৪৪):
* প্রস্তাবক: সি. রাজাগোপালাচারী।
* উদ্দেশ্য: কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা এনে দেশভাগের প্রক্রিয়াকে শান্তিপূর্ণ করা।
* প্রস্তাবনা: যুদ্ধ শেষে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে গণভোটের মাধ্যমে ভারত থেকে পৃথক হওয়ার অধিকার।
* ব্যর্থতার কারণ: জিন্নাহ এই ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি অখণ্ড পাকিস্তান চেয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চাননি।
3. ওয়েভেল পরিকল্পনা ও সিমলা সম্মেলন (১৯৪৫):
* প্রেক্ষাপট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর লর্ড ওয়েভেল একটি পরিকল্পনা পেশ করেন এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে সিমলায় একটি সম্মেলন ডাকেন।
* প্রস্তাবনা: একটি নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় সদস্য থাকবে (ভাইসরয় ও সেনাপ্রধান বাদে), এবং হিন্দু-মুসলিমদের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি থাকবে।
* ব্যর্থতার কারণ: মুসলিম লীগের দাবি ছিল, কার্যনির্বাহী পরিষদের সমস্ত মুসলিম সদস্য মুসলিম লীগ থেকে মনোনীত হতে হবে, যা কংগ্রেস ও অন্যান্য মুসলিম দল মানতে রাজি ছিল না।
4. ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা (১৯৪৬):
* প্রেক্ষাপট: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি ভারতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি ক্যাবিনেট মিশন পাঠান (লর্ড পেথিক-লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, এ. ভি. আলেকজান্ডার)।
* প্রস্তাবনা:
* পাকিস্তানের পৃথক দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয় (কারণ এটি বিপুল সংখ্যক অ-মুসলিমকে অন্তর্ভুক্ত করত এবং পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন প্রয়োজন হত)।
* একটি সংযুক্ত ভারত গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয় যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করবে।
* প্রদেশগুলিকে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করা হবে: গ্রুপ A (হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ), গ্রুপ B (উত্তর-পশ্চিম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ), এবং গ্রুপ C (উত্তর-পূর্ব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ)। প্রতিটি গ্রুপের নিজস্ব সংবিধান ও স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
* একটি সংবিধান সভার মাধ্যমে নতুন সংবিধান তৈরি করা হবে।
* ব্যর্থতার কারণ:
* প্রাথমিকভাবে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
* কিন্তু কংগ্রেসের নেতা জওহরলাল নেহরু গণপরিষদের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায়, মুসলিম লীগ এটিকে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করে এবং পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে।
* মুসলিম লীগ এবার সরাসরি পাকিস্তান দাবির পক্ষে চলে যায়।
5. প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস (Direct Action Day) – ১৯৪৬:
* তারিখ: ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট।
* উদ্দেশ্য: ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর এবং মুসলিম লীগ কর্তৃক পাকিস্তান দাবির পক্ষে অনড় অবস্থানের অংশ হিসেবে জিন্নাহ এই দিনটিকে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' হিসেবে ঘোষণা করেন।
* ফল: কলকাতায় ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়, যা 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' নামে পরিচিত। এই দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ভারত বিভাজনকে অনিবার্য করে তোলে।
6. অন্তর্বর্তী সরকার (Interim Government) – ১৯৪৬:
* দাঙ্গার পর লর্ড ওয়েভেল জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন।
* প্রাথমিকভাবে মুসলিম লীগ এতে যোগ দিতে অস্বীকার করলেও, পরে অক্টোবরে যোগ দেয়, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের মধ্যে থেকেই পাকিস্তানের দাবিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
7. অ্যাটলির ঘোষণা (১৯৪৭):
* ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি ঘোষণা করেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন প্রত্যাহার করা হবে।
* এই ঘোষণা ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
8. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (১৯৪৭):
* প্রেক্ষাপট: লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করে পাঠানো হয় দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য। তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর ১৯৪৭ সালের ৩ জুন তাঁর পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।
* মূল প্রস্তাবনা:
* ভারতকে দুটি ডোমিনিয়নে বিভক্ত করা হবে: ভারত এবং পাকিস্তান।
* পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করা হবে।
* উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসামের সিলেট জেলায় গণভোটের আয়োজন করা হবে।
* দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগদানের অথবা স্বাধীন থাকার স্বাধীনতা দেওয়া হবে (যদিও পরে এটি কার্যকর হয়নি)।
* ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ এগিয়ে আনা হয়: ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭।
* তাৎপর্য: এই পরিকল্পনা কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং শিখ নেতারা মেনে নেন। এটিই ভারত বিভাজনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ ছিল।
V. ভারত বিভাজন ও স্বাধীনতা
* ভারতীয় স্বাধীনতা আইন (Indian Independence Act), ১৯৪৭: মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই আইন পাস হয়। এর ফলে ব্রিটিশ ভারতের সমাপ্তি ঘটে এবং দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়ন – ভারত ও পাকিস্তান – গঠিত হয়।
* স্বাধীনতা লাভ:
* ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭: পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
* ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭: ভারত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
* দেশভাগের পরিণতি:
* সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: দেশভাগের সময় এবং পরে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও বাংলায়।
* জনসংখ্যার স্থানান্তর: প্রায় ১.৫ কোটি মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে সীমান্তের ওপারে চলে যায়। এটি মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম অভিবাসন।
* শরণার্থী সংকট: ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই বিশাল শরণার্থী সংকটের সম্মুখীন হতে হয়।
* সম্পত্তির ক্ষতি: ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং সম্পত্তির ক্ষতি হয়।
* অর্থনৈতিক অস্থিরতা: শিল্প, কৃষি এবং পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
* দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তি: প্রায় ৫৫০টি দেশীয় রাজ্যকে ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করার চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। কাশ্মীর সমস্যা এর অন্যতম উদাহরণ।
VI. দেশভাগের কারণ
ভারত বিভাজন একটি জটিল প্রক্রিয়া ছিল, যার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল:
1. ব্রিটিশ 'বিভাজন ও শাসন' নীতি (Divide and Rule Policy): ব্রিটিশরা শুরু থেকেই হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। পৃথক নির্বাচন মণ্ডলী প্রবর্তন (১৯০৯), বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ইত্যাদি এর উদাহরণ।
2. সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও দ্বি-জাতি তত্ত্ব: মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রচারিত দ্বি-জাতি তত্ত্ব (হিন্দু ও মুসলিম দুটি ভিন্ন জাতি) বিভাজনের মূল রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। জিন্নাহর অবিচল অবস্থান মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
3. মুসলিম লীগের অনমনীয়তা: মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালের পর থেকে পাকিস্তান দাবিতে অনড় ছিল এবং কোনো বিকল্পকে (যেমন ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা) মেনে নিতে রাজি ছিল না, যদি তাতে পাকিস্তান গঠনের স্পষ্ট নিশ্চয়তা না থাকে।
4. কংগ্রেসের কিছু ভুল পদক্ষেপ:
* ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন না করা।
* ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার কিছু শর্ত নিয়ে নেহরুর বিতর্কিত মন্তব্য, যা মুসলিম লীগকে ক্ষুব্ধ করে।
* সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবিলায় প্রাথমিক ব্যর্থতা এবং বিভাজনের অনিবার্যতা মেনে নেওয়া।
5. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা: ১৯৪৬ সালের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস থেকে শুরু হওয়া ব্যাপক দাঙ্গা ও সহিংসতা পরিস্থিতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে দেশভাগই একমাত্র সমাধান বলে মনে হয়।
6. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের চাপ: যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন, যা বিভাজনকে ত্বরান্বিত করে।
7. মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রসার: ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে পিছিয়ে পড়া, এবং হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার আশঙ্কায় মুসলিমদের মধ্যে একটি অংশ পৃথক পরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
VII. গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (এক নজরে)
* মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা: ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ঢাকা।
* প্রথম সভাপতি: নবাব সলিমুল্লাহ (তবে প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ভিকার-উল-মুলক)। আগা খান তৃতীয় ছিলেন মুসলিম লীগের প্রথম স্থায়ী সভাপতি।
* লাহোর প্রস্তাব: ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ।
* লাহোর প্রস্তাবের প্রস্তাবক: এ. কে. ফজলুল হক।
* 'পাকিস্তান' নামের জনক: চৌধুরী রহমত আলী (১৯৩৩)।
* ক্যাবিনেট মিশন: ১৯৪৬ (সদস্য: পেথিক-লরেন্স, ক্রিপস, আলেকজান্ডার)।
* প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস: ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট।
* মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা: ১৯৪৭ সালের ৩ জুন।
* ভারতীয় স্বাধীনতা আইন: ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস।
* পাকিস্তানের স্বাধীনতা: ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।
* ভারতের স্বাধীনতা: ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট।