পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার: রামমোহন রায়, ইয়ং বেঙ্গল ও বিদ্যাসাগর, আর্য সমাজ, বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন

ইতিহাস সিলেবাসের অন্তর্গত "পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার: রামমোহন রায়, ইয়ং বেঙ্গল ও বিদ্যাসাগর, আর্য সমাজ, বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন" বিষয়ে ...

পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার: রামমোহন রায়, ইয়ং বেঙ্গল ও বিদ্যাসাগর, আর্য সমাজ, বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন (Western Education and social reform: Rammohan Ray, Young Bengal & Vidyasagar, Arya Samaj, Vivekananda and Ramkrishna Mission)


### পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার

উনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ভারতীয় সমাজে এক নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এই শিক্ষা একদিকে যেমন যুক্তিবাদের উন্মোচন করে, তেমনই ভারতীয় সমাজের কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও পশ্চাদপদতা সম্পর্কে শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে সচেতন করে তোলে। এর ফলস্বরূপ, বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনের সূচনা হয়, যা ভারতীয় নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করে।


#### ১. রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও ব্রাহ্মসমাজ

* ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায়কে ‘ভারতীয় নবজাগরণের জনক’, ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানব’ এবং ‘আধুনিক ভারতের জনক’ বলা হয়। তিনি একাধারে ধর্মীয়, সামাজিক, শিক্ষামূলক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পথিকৃৎ ছিলেন।

* ধর্মীয় সংস্কার:

    * একেশ্বরবাদ ও ব্রাহ্মসমাজ: তিনি পৌত্তলিকতা ও বহুদেববাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল একেশ্বরবাদের প্রচার এবং বেদান্তের যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে এটি ‘ব্রাহ্মসভা’ এবং পরে ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এ রূপান্তরিত হয়। ব্রাহ্মসমাজের মূলনীতি ছিল নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা এবং জাতিভেদ ও মূর্তিপূজার বিরোধিতা।

    * গ্রন্থ ও পত্রিকা: তিনি 'তুহফাত-উল-মুয়াহহিদিন' (Gift to Monotheists) এবং 'বেদান্ত গ্রন্থ' রচনা করেন। 'সংবাদ কৌমুদী' (বাংলা) ও 'মিরাৎ-উল-আখবার' (ফারসি) পত্রিকা প্রকাশ করে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।

* সামাজিক সংস্কার:

    * সতীদাহ প্রথা বিলোপ: রামমোহন রায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তিনি যুক্তি ও ধর্মশাস্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে সতীদাহ প্রথা অশাস্ত্রীয় ও অমানবিক। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নং রেগুলেশন দ্বারা এই প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

    * নারী অধিকার: তিনি বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, কৌলীন্য প্রথার বিরোধিতা করেন এবং নারীর সম্পত্তির অধিকার ও বিধবাবিবাহের পক্ষে সওয়াল করেন।

    * জাতিভেদ প্রথা: জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতারও তিনি বিরোধী ছিলেন।

* শিক্ষামূলক সংস্কার:

    * পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি মনে করতেন, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও আধুনিক জ্ঞান ভারতের উন্নতির চাবিকাঠি।

    * ডেভিড হেয়ার ও আলেকজান্ডার ডাফের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তিনি ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন (যদিও রক্ষণশীলদের আপত্তিতে তিনি সরাসরি যুক্ত থাকতে পারেননি)।

    * ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষাই প্রদান করা হতো।

* তাৎপর্য: রামমোহন রায় ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও দর্শনের এক অসাধারণ সমন্বয়কারী। তাঁর সংস্কার আন্দোলন ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে এক নতুন যুগের সূচনা করে, যা পরবর্তীকালে অন্যান্য সংস্কারকদের অনুপ্রাণিত করে।


#### ২. ইয়ং বেঙ্গল (Young Bengal)

* ভূমিকা: উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যুক্তি, তর্ক ও স্বাধীন চিন্তার এক নতুন স্পৃহা জাগিয়ে তোলেন, যা 'ইয়ং বেঙ্গল' নামে পরিচিত।

* নেতা ও অনুগামী: ডিরোজিও এই আন্দোলনের প্রধান মুখ ছিলেন। তাঁর অনুগামীরা 'ডিরোজিয়ান' নামে পরিচিত ছিল। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারিচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ।

* আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য:

    * ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উগ্র যুক্তিবাদ ও সংশয়বাদের জন্ম দেন। তাঁরা প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা এবং সামাজিক রীতিনীতির তীব্র সমালোচনা করেন।

    * তাঁরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, কৃষকদের অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং সরকারি চাকরিতে ভারতীয়দের নিয়োগের দাবি তোলেন।

    * তাঁরা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সমাজের সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন চাইতেন।

* কার্যকলাপ:

    * ডিরোজিওর নেতৃত্বে 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' (Academic Association) নামক একটি বিতর্ক সভার জন্ম হয়, যেখানে ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা চলত।

    * তাঁরা 'পার্থেনন', 'এনকোয়াইরার', 'জ্ঞানান্বেষণ' ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশ করেন।

* সীমাবদ্ধতা ও তাৎপর্য:

    * ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন সমাজের উচ্চবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। তাদের উগ্রপন্থী মনোভাব অনেক সময় সমাজের মূল স্রোত থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

    * ডিরোজিওকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং একই বছর তাঁর অকাল মৃত্যুতে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

    * তবে, এই আন্দোলন ভারতীয় বুদ্ধিজীবী সমাজে যুক্তিবাদ, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বাধীন চিন্তার বীজ বপন করে, যা পরবর্তীকালের সংস্কার আন্দোলনের পথ দেখায়।


#### ৩. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)

* ভূমিকা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর এক প্রবাদপ্রতিম বাঙালি সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলায় নারীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহের আন্দোলনে নতুন দিশা আসে।

* শিক্ষামূলক সংস্কার:

    * নারীশিক্ষা: বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার অগ্রগতির জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। তিনি মনে করতেন, নারী সমাজের উন্নতি ছাড়া সামগ্রিক সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

        * তিনি জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন প্রতিষ্ঠিত 'বেথুন স্কুল'-এর (১৮৪৯) পরিচালনভার গ্রহণ করেন এবং এটিকে একটি আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে পরিণত করেন।

        * তিনি নিজের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন জেলায় (বিশেষ করে হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর) ৩০টির বেশি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

    * গণশিক্ষা ও vernacular শিক্ষা: তিনি গণশিক্ষার প্রসারে জোর দেন এবং সহজবোধ্য বাংলা বর্ণমালা ও গদ্যের প্রচলনে বিপ্লব আনেন। তাঁর রচিত 'বর্ণপরিচয়' (১৮৫৫) আজও বাংলা ভাষা শিক্ষার এক মাইলফলক।

    * সংস্কৃত কলেজের সংস্কার: তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন (১৮৫১-১৮৫৮) অনেক সংস্কারমূলক কাজ করেন। তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের জন্য কলেজের দরজা খুলে দেন, যা ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শন শিক্ষার প্রচলন করেন।

    * বিদ্যালয় পরিদর্শক: তিনি বাংলার বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে বহু মডেল স্কুল স্থাপন করেন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে অবদান রাখেন।

* সামাজিক সংস্কার:

    * বিধবাবিবাহ আন্দোলন: বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড় সামাজিক অবদান ছিল বিধবাবিবাহের পক্ষে আন্দোলন। তিনি শাস্ত্রের যুক্তির (পরাশর সংহিতা) মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ও ব্যক্তিগত ত্যাগের ফলস্বরূপ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডালহৌসি এবং লর্ড ক্যানিং-এর সহায়তায় 'বিধবাবিবাহ আইন' (Act XV of 1856) পাস হয়। তিনি নিজের পুত্র নারায়ণকে একজন বিধবার সাথে বিবাহ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

    * বহুবিবাহের বিরোধিতা: তিনি বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন এবং এই প্রথা নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। যদিও এক্ষেত্রে তিনি সফল হননি।

    * বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: তিনি বাল্যবিবাহেরও বিরোধী ছিলেন।

* সাহিত্যকর্ম: তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলির মধ্যে রয়েছে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'শকুন্তলা', 'সীতার বনবাস', 'কথামালা', 'ভ্রান্তিবিলাস' ইত্যাদি। বাংলা গদ্যের জনক হিসেবেও তিনি পরিচিত।

* তাৎপর্য: বিদ্যাসাগর ছিলেন একাধারে পাণ্ডিত্য, মানবতাবোধ ও কর্মনিষ্ঠার প্রতীক। তিনি শুধু সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন দেখেননি, বরং বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁর অবদান আধুনিক বাঙালি সমাজ গঠনে অপরিহার্য।


#### ৪. আর্য সমাজ (Arya Samaj)

* ভূমিকা: আর্য সমাজ ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর এক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু সংস্কার আন্দোলন, যা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে নয়, বরং বৈদিক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

* প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠা: ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-১৮৮৩) বোম্বাইয়ে (মুম্বাই) আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এর প্রধান কার্যালয় লাহোরে স্থানান্তরিত হয়।

* আদর্শ ও নীতি:

    * বেদের অভ্রান্ততা: দয়ানন্দ সরস্বতীর মূলমন্ত্র ছিল 'বেদে ফিরে চলো' ('Go back to Vedas')। তিনি বেদকে সকল জ্ঞান ও ধর্মের উৎস বলে মনে করতেন।

    * একেশ্বরবাদ: আর্য সমাজ পৌত্তলিকতা, অবতারবাদ, বহুদেববাদ ও মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিল। তারা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনায় বিশ্বাসী ছিল।

    * সংস্কারের মূলনীতি: জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করে আর্য সমাজ। তারা বিধবাবিবাহ ও নারীশিক্ষার পক্ষে ছিল।

    * শুদ্ধি আন্দোলন: আর্য সমাজ 'শুদ্ধি আন্দোলন' শুরু করে, যার মাধ্যমে যেসব হিন্দু অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তাদের পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা হতো।

* শিক্ষা ও সামাজিক অবদান:

    * আর্য সমাজ শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দয়ানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা 'দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক (DAV) কলেজ' ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার পাশাপাশি বৈদিক মূল্যবোধের উপর জোর দেওয়া হতো।

    * লালা হংসরাজ ও লালা লাজপত রাই DAV কলেজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

    * গুরুকুল পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের জন্য স্বামী শ্রদ্ধানন্দ ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারের কাছে 'গুরুকুল কাংরি' প্রতিষ্ঠা করেন।

* গ্রন্থ: স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো 'সত্যার্থ প্রকাশ' (১৮৭৫)।

* তাৎপর্য: আর্য সমাজ ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে এক নতুন আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। এটি হিন্দুদের মধ্যে একতা ও জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নে কাজ করে। এর সংস্কারমূলক কার্যক্রম উত্তর ভারতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।


#### ৫. বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন

* স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২):

    * ভূমিকা: স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন উনিশ শতকের শেষার্ধের একজন অন্যতম প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা এবং সমাজ সংস্কারক। তাঁর আসল নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর গুরু ছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।

    * দর্শন ও আদর্শ:

        * ব্যবহারিক বেদান্ত: বিবেকানন্দ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক মুক্তি নয়, বরং মানব সেবাকেই জীবনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দেখেন। তিনি 'শিব জ্ঞানে জীব সেবা' অর্থাৎ 'জীবের সেবার মাধ্যমেই শিবের সেবা' এই দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন।

        * সার্বজনীন ধর্ম: তিনি ঘোষণা করেন যে সকল ধর্মের পথ ভিন্ন হলেও তাদের লক্ষ্য এক। তিনি ধর্মকে মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম হিসেবে দেখতেন।

        * আত্মবিশ্বাস ও শক্তি: তিনি যুবসমাজকে শারীরিক ও মানসিক শক্তি অর্জনের আহ্বান জানান। তিনি মনে করতেন, শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়।

    * শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসভা (১৮৯৩): স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসভায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর বক্তব্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিক মিলন এবং ভারতীয় দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে।

    * গ্রন্থ ও রচনা: তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে 'পরিব্রাজক', 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য', 'বর্তমান ভারত', 'কর্মযোগ', 'রাজযোগ', 'জ্ঞানযোগ', 'ভক্তিযোগ' ইত্যাদি।

* রামকৃষ্ণ মিশন (Ramakrishna Mission):

    * প্রতিষ্ঠা: ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গুরু রামকৃষ্ণের আদর্শ প্রচারে ও মানবসেবার উদ্দেশ্যে কলকাতার বেলুড় মঠে 'রামকৃষ্ণ মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন।

    * উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম:

        * রামকৃষ্ণ মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মিক উন্নতি এবং মানবসেবার মাধ্যমে মুক্তিলাভ।

        * মিশন শিক্ষা (স্কুল, কলেজ), স্বাস্থ্যসেবা (হাসপাতাল, ডিসপেনসারি), ত্রাণকার্য (দুর্গতদের সাহায্য), গ্রামীণ উন্নয়ন এবং শ্রী রামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের বাণী প্রচারের কাজ করে।

        * এর শাখা দেশ-বিদেশে বিস্তৃত হয়।

* তাৎপর্য: বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির পুনরুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিবেকানন্দের বাণী যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করে এবং পরোক্ষভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রভাব ফেলে। রামকৃষ্ণ মিশন এখনও মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করছে।