Dog 🐶 2048 Brainstorming Game চরৈবেতি - বাংলা ব্লগ Bangla Age Calculator

প্রাচীন ভারতের তিন শক্তিশালী রাজবংশ: কুষাণ, সাতবাহন এবং বাকাটক

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রাচীন ভারতে এক রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে বেশ কিছু আঞ্চলিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যারা ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এদের মধ্যে তিনটি প্রধান রাজবংশ হলো – কুষাণ, সাতবাহন এবং বাকাটক। এই তিনটি রাজবংশ প্রায় একই সময়ে (খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক থেকে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতক পর্যন্ত) ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিল এবং তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, শাসনপ্রণালী, অর্থনীতি, ধর্ম এবং শিল্পকলায় তাদের অবদান ভারতীয় ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায় রচনা করে। এই নিবন্ধে আমরা প্রতিটি রাজবংশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করব।

১. কুষাণ রাজবংশ

কুষাণরা ছিল মধ্য এশিয়ার ইউচি (Yuezhi) উপজাতির একটি শাখা, যারা প্রথমে উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং পরে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

* উৎপত্তি ও বিস্তার:

  • কুষাণরা মধ্য এশিয়ার ইউচি উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা মূলত চীনের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে এসে Bactria (আধুনিক আফগানিস্তান) অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
  • খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে তারা ভারতে প্রবেশ করে।

* গুরুত্বপূর্ণ শাসক:

  • কুজুল কদফিসেস (Kujula Kadphises): কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই প্রথম কুষাণ শাসক যিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।
  • বিম কদফিসেস (Vima Kadphises): কুজুল কদফিসেসের পুত্র। তিনিই প্রথম কুষাণ শাসক যিনি ভারতে সোনা ও তামার মুদ্রা প্রচলন করেন এবং তাঁর সাম্রাজ্য সিন্ধু নদের পূর্ব দিকে প্রসারিত করেন।
  • কনিষ্ক (Kanishka): কুষাণ সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর রাজত্বকাল (প্রায় ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০ খ্রিস্টাব্দ) কুষাণ শাসনের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত।
  • তাঁর সাম্রাজ্য উত্তর ভারত, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া এবং কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
  • তিনি বৌদ্ধধর্মের এক মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতির (Council) আয়োজন করেন কাশ্মীরের কুণ্ডলবনে
  • তাঁর সময়ে বৌদ্ধধর্ম মহাযান শাখায় বিভক্ত হয় এবং ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
  • কনিষ্কের রাজসভায় চরক (আয়ুর্বেদের পণ্ডিত), অশ্বঘোষ (বৌদ্ধ দার্শনিক ও কবি) এবং নাগার্জুন (দার্শনিক) এর মতো জ্ঞানী ব্যক্তিরা ছিলেন।

* গুরুত্বপূর্ণ অবদান:

* অর্থনীতি ও বাণিজ্য:

  • কুষাণরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে 'রেশম পথ' (Silk Road) এর মাধ্যমে চীন, রোম এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
  • প্রথমবারের মতো বড় আকারে নিয়মিত সোনা ও তামার মুদ্রা প্রচলন করেন, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্দেশ করে।

* শিল্পকলা ও স্থাপত্য:

  • গান্ধার শিল্পকলা: গ্রিকো-রোমান ও ভারতীয় শিল্পের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই শিল্পকলায় মূলত বৌদ্ধ প্রতিমা নির্মাণ করা হতো (বুদ্ধের মানবিক রূপ)।
  • মথুরা শিল্পকলা: এটি মূলত ভারতীয় শৈলীতে বিকশিত হয়, যেখানে স্থানীয় লাল বেলেপাথর ব্যবহার করা হতো। এখানে হিন্দু ও জৈন দেব-দেবী এবং বৌদ্ধ মূর্তি নির্মিত হতো।

* ধর্ম:

  • কুষাণরা, বিশেষ করে কনিষ্ক, বৌদ্ধধর্মের (মহাযান শাখা) পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তবে তারা ধর্মীয় সহনশীলতা বজায় রেখেছিলেন এবং হিন্দু দেব-দেবী ও স্থানীয় ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

* সাহিত্য:

  • সংস্কৃত ভাষার বিকাশ ঘটে। অশ্বঘোষের 'বুদ্ধচরিত' এই সময়েই রচিত হয়।

* পতন:

* কনিষ্কের উত্তরসূরিরা দুর্বল ছিলেন।

  • তৃতীয় শতকের মধ্যে কুষাণ সাম্রাজ্য ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পারস্যের সাসানীয়দের আক্রমণে তাদের পতন ঘটে।

২. সাতবাহন রাজবংশ

সাতবাহনরা ছিল দাক্ষিণাত্যের একটি শক্তিশালী রাজবংশ, যারা মূলত বর্তমান মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটকের কিছু অংশে শাসনকার্য পরিচালনা করত।

* উৎপত্তি ও বিস্তার:

  • খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজবংশের উত্থান হয়।
  • তাদের মূল কেন্দ্র ছিল প্রতিস্থান (আধুনিক মহারাষ্ট্রের পাইঠান)।

* তারা নিজেদের "অন্ধ্র" নামেও পরিচয় দিত।

* গুরুত্বপূর্ণ শাসক:

  • সিমুক (Simuka): সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
  • সাতকর্ণী প্রথম (Satakarni I): সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের মাধ্যমে নিজেকে শক্তিশালী রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন।
  • গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী (Gautamiputra Satakarni): সাতবাহনদের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক (রাজত্বকাল ১০৬-১৩০ খ্রিস্টাব্দ)।
  • তিনি শকদের পরাজিত করে সাতবাহনদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করেন।
  • তাঁর সম্পর্কে নাসিক প্রশস্তি থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
  • তাকে "একব্রাহ্মণ" এবং "ক্ষত্রিয় দর্প খণ্ডনকারী" বলা হয়।
  • বশিষ্টীপুত্র পুলুমাবী (Vasisthiputra Pulumavi): গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর পুত্র। তাঁর সময়ে সাতবাহন সাম্রাজ্য দাক্ষিণাত্য, অন্ধ্র এবং মহারাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

* গুরুত্বপূর্ণ অবদান:

* অর্থনীতি ও বাণিজ্য:

  • সাতবাহনরা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • তাদের সময়ে বহু বন্দর নগরী (যেমন - কল্যাণ, চাউল, ভড়োঁচ) গড়ে ওঠে।
  • রোমান সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্য অত্যন্ত লাভজনক ছিল।

* কৃষি ছিল অর্থনীতির মূল ভিত্তি।

* ধর্ম:

  • তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মেরই পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
  • নাসিকের মতো স্থানে অনেক বৌদ্ধ চৈত্য (প্রার্থনা কক্ষ) ও বিহার (মঠ) তৈরি হয়েছিল, যেমন কার্লে-র বিখ্যাত চৈত্য।

* ভাষা ও সাহিত্য:

* প্রাকৃত ভাষা ছিল তাদের দাপ্তরিক ভাষা।

  • তাদের সপ্তম শাসক রাজা হাল (Hala) প্রাকৃত ভাষায় 'গাথাসপ্তশতী' নামক একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।

* সমাজ:

  • মাতৃতান্ত্রিক উপাধি ব্যবহারের প্রচলন ছিল (যেমন - গৌতমীপুত্র, বশিষ্টীপুত্র), যদিও রাজতন্ত্র পিতৃতান্ত্রিকই ছিল।

* সাতবাহন সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বাস করত।

* পতন:

  • তৃতীয় শতকে সাতবাহনরা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়।
  • আবীরা (Abhiras) এবং ইক্ষ্বাকু (Ikshvakus) দের মতো স্থানীয় শক্তির উত্থানে তাদের পতন ঘটে।

৩. বাকাটক রাজবংশ

বাকাটক রাজবংশ ছিল দাক্ষিণাত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, যারা প্রধানত মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে শাসন করত। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

* উৎপত্তি ও বিস্তার:

  • খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে সাতবাহনদের পতনের পর বাকাটকদের উত্থান হয়।
  • তাদের মূল কেন্দ্র ছিল বিদর্ভ (আধুনিক মহারাষ্ট্র)।

* গুরুত্বপূর্ণ শাসক:

  • বিন্ধ্যশক্তি (Vindhyashakti): বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
  • প্রথম প্রবরসেন (Pravarasena I): বাকাটকদের প্রথম স্বাধীন ও শক্তিশালী শাসক। তিনিই একমাত্র বাকাটক রাজা যিনি 'সম্রাট' উপাধি ধারণ করেন।
  • দ্বিতীয় রুদ্রসেন (Rudrasena II): চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়ের কন্যা প্রভাবতীগুপ্তার (Prabhavatigupta) সাথে তার বিবাহ হয়, যা গুপ্ত-বাকাটক সম্পর্ককে মজবুত করে। এই বৈবাহিক সম্পর্ক বাকাটকদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বাড়িয়ে তোলে।
  • হরিষেণ (Harishena): বাকাটকদের শেষ উল্লেখযোগ্য শাসক। তাঁর সময়ে বাকাটক সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। অজন্তা গুহার কিছু চিত্রকর্ম তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই নির্মিত হয়েছিল।

* গুরুত্বপূর্ণ অবদান:

* রাজনৈতিক গুরুত্ব:

  • গুপ্ত সাম্রাজ্যের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তারা দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • তারা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি করে।

* শিল্পকলা ও স্থাপত্য:

  • বাকাটকদের শাসনকাল ছিল শিল্প ও স্থাপত্যের এক স্বর্ণযুগ।
  • অজন্তা গুহা: এই রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতাতেই অজন্তা গুহার অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য নির্মিত হয় (বিশেষ করে নবম, দশম, ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহা)। এই গুহাচিত্রগুলি বৌদ্ধ ধর্মীয় বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।

* ধর্ম:

  • তারা মূলত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং অনেক মন্দির নির্মাণ করেন।
  • তবে তারা বৌদ্ধ শিল্পকলাকেও সমানভাবে উৎসাহিত করেছিলেন, যার প্রমাণ অজন্তা গুহা।

* সাহিত্য:

  • সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। বাকাটক রাজারাও সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

* পতন:

  • ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চালুক্যদের উত্থানের ফলে বাকাটক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

উপসংহার

কুষাণ, সাতবাহন এবং বাকাটক – এই তিনটি রাজবংশ মৌর্য-পরবর্তী ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে। কুষাণরা উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর ভারতে বাণিজ্য, শিল্পকলা (গান্ধার ও মথুরা) এবং বৌদ্ধধর্মের প্রসারে অনবদ্য অবদান রাখে। সাতবাহনরা দাক্ষিণাত্যে স্থিতিশীল শাসন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার এবং প্রাকৃত সাহিত্যের বিকাশে পথ দেখায়। অন্যদিকে, বাকাটকরা মধ্য ভারতে গুপ্তদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং শিল্পকলা (বিশেষ করে অজন্তা গুহাচিত্র) ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের শাসনকাল ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, যা পরবর্তীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থানের ভিত্তি স্থাপন করে। তাদের রেখে যাওয়া স্থাপত্য, শিল্পকলা, মুদ্রা এবং সাহিত্য আজও তাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।

Tags:
Next Post Previous Post