তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার কী কী উদ্যোগ নিয়েছিল?

Question: তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার কী কী উদ্যোগ নিয়েছিল?

উত্তর: তম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা, রাজস্ব সংগ্রহ, ত্রাণকার্য, বিদ্যুৎ বাহিনী গঠন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মতো একাধিক জনকল্যাণমূলক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নিয়েছিল।

ব্যাখ্যা: ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে মেদিনীপুরের তমলুকে তম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২ সালে গঠিত এই সরকার প্রায় দু'বছর ধরে (১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ব্রিটিশ প্রশাসনের সমান্তরালভাবে কাজ করে। সতীশচন্দ্র সামন্ত ছিলেন এর সর্বাধিনায়ক। এই সরকার ব্রিটিশ ভারতের অভ্যন্তরে একটি সম্পূর্ণ স্বশাসিত ব্যবস্থার উদাহরণ স্থাপন করেছিল এবং অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল:

১. আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা: সরকার নিজস্ব পুলিশ বাহিনী গঠন করেছিল এবং গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটি তৈরি করেছিল। 'বিদ্যুৎ বাহিনী' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়েছিল, যা ব্রিটিশ বাহিনীকে প্রতিহত করতে এবং তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা (যেমন টেলিফোন লাইন, রাস্তা, সেতু) বিচ্ছিন্ন করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। এই বাহিনী তমলুকের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখত।

২. বিচার ব্যবস্থা: তম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা চালু করেছিল। 'ন্যায় পঞ্চায়েত' বা গ্রাম আদালত স্থাপন করা হয়েছিল, যেখানে স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তি করা হতো এবং বিচার প্রদান করা হতো, যা স্থানীয় মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা বাড়িয়েছিল।

৩. রাজস্ব ও অর্থসংস্থান: সরকার স্থানীয় কর আদায় করে নিজস্ব রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই রাজস্ব দিয়েই সরকারের প্রশাসনিক ব্যয় এবং জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির অর্থসংস্থান করা হতো।

৪. ত্রাণ ও জনকল্যাণ: ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালের বিধ্বংসী বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় তম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ব্যাপক ত্রাণকার্য পরিচালনা করেছিল। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করেছিল। অনাথ শিশুদের জন্য অনাথ আশ্রমও স্থাপন করা হয়েছিল। এই মানবিক উদ্যোগগুলি ব্রিটিশ প্রশাসনের ব্যর্থতার বিপরীতে সরকারের সক্ষমতা প্রমাণ করেছিল।

৫. শিক্ষা: জাতীয় সরকার একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিল, যা ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত স্বদেশী শিক্ষার প্রসারে সহায়ক ছিল।

৬. যোগাযোগ ব্যবস্থা: ব্রিটিশ প্রশাসনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি তম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার নিজস্ব ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিল। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে এবং জনগণের সাথে কার্যকর যোগাযোগ বজায় রাখত।

৭. গ্রাম স্বায়ত্তশাসন: সরকার বিভিন্ন স্তরে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা করত, যা গ্রাম স্বায়ত্তশাসনের এক অনন্য উদাহরণ ছিল। এর ফলে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়েছিল।

এই উদ্যোগগুলি দেখায় যে তম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার কেবল একটি প্রতিবাদী আন্দোলন ছিল না, বরং এটি একটি কার্যকর সমান্তরাল সরকার হিসেবে কাজ করেছিল, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

Post a Comment