ব্রিটিশ শাসন আমলে পত্র পত্রিকা তালিকা ও সংবাদপত্র আইন
ভূমিকা:
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে সংবাদপত্র ও সাময়িকীর বিকাশ ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে এবং জনমত গঠনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সংবাদপত্রগুলি একদিকে যেমন জনগণের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করেছিল, তেমনি অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য শুরু থেকেই সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে বিভিন্ন কঠোর আইন প্রণয়ন করেছিল, যা ভারতীয় সাংবাদিকতা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
I. সংবাদপত্রের উত্থান ও গুরুত্ব
গণমাধ্যমের ভূমিকা: সংবাদপত্র ছিল ব্রিটিশ আমলের প্রধান গণমাধ্যম। এটি শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক ধারণা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে সাহায্য করেছিল।
জনমত গঠন: সংবাদপত্রগুলি ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করে এবং ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলেছিল।
সংস্কার আন্দোলন: ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনগুলি (যেমন ব্রাহ্মসমাজ, আর্যসমাজ) তাদের আদর্শ প্রচারে সংবাদপত্রের সাহায্য নিত।
সংযুক্তিকরণ: এটি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে একই প্ল্যাটফর্মে এনেছিল এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।
II. প্রাথমিক সংবাদপত্র ও সাময়িকী (অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ)
১. বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র (ইংরেজিতে):
বেঙ্গল গেজেট (Bengal Gazette):
প্রতিষ্ঠাতা: জেমস অগাস্টাস হিকি (James Augustus Hicky)
প্রকাশকাল: ১৭৮০ সাল
বিশেষত্ব: এটি ছিল ভারতের প্রথম সংবাদপত্র। এর প্রকাশক ব্রিটিশ সরকারের সমালোচক ছিলেন, যার ফলে এটি শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যায়।
২. বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র ও সাময়িকী:
দিগদর্শন (Digdarshan):
প্রকাশক: শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন
প্রকাশকাল: ১৮১৮ সাল
বিশেষত্ব: এটি বাংলা ভাষার প্রথম মাসিক সাময়িকী।
সমাচার দর্পণ (Samachar Darpan):
প্রতিষ্ঠাতা: শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন (মার্শম্যান-এর উদ্যোগে)
প্রকাশকাল: ১৮১৮ সাল
বিশেষত্ব: এটি ছিল বাংলা ভাষার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। এটি মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করত।
সংবাদ কৌমুদী (Sambad Kaumudi):
প্রতিষ্ঠাতা: রাজা রামমোহন রায়
প্রকাশকাল: ১৮২১ সাল
বিশেষত্ব: এটি ছিল রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনের মুখপত্র। সতীদাহ প্রথা রদ ও নারী শিক্ষা প্রসারে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
মিরাত-উল-আখবার (Mirat-ul-Akhbar):
প্রতিষ্ঠাতা: রাজা রামমোহন রায়
প্রকাশকাল: ১৮২২ সাল
বিশেষত্ব: এটি ছিল রাজা রামমোহন রায়ের ফারসি ভাষার সংবাদপত্র।
সংবাদ প্রভাকর (Sambad Prabhakar):
প্রতিষ্ঠাতা: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
প্রকাশকাল: ১৮৩১ সাল (প্রথম সাপ্তাহিক, পরে দৈনিক)
বিশেষত্ব: এটি বাংলা সাহিত্য ও সংবাদ জগতে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (Tatwabodhini Patrika):
প্রতিষ্ঠাতা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (তত্ত্ববোধিনী সভা)
প্রকাশকাল: ১৮৪৩ সাল
সম্পাদক: অক্ষয়কুমার দত্ত, পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিশেষত্ব: ব্রাহ্মধর্ম ও বাংলার নবজাগরণের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
III. জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে সংবাদপত্রের ভূমিকা (১৮৫৭ পরবর্তী যুগ)
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই সময় বহু প্রভাবশালী সংবাদপত্র ও সাময়িকী আত্মপ্রকাশ করে, যা সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।
উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র ও সম্পাদকবৃন্দ:
১. বাংলা সংবাদপত্র:
হিন্দু প্যাট্রিয়ট (Hindoo Patriot):
প্রতিষ্ঠাতা: মধুসূদন রায় (পরে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়)
প্রকাশকাল: ১৮৫৩ সাল
বিশেষত্ব: এটি ছিল নীল বিদ্রোহের অন্যতম সমর্থক এবং ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর এটি কালীপ্রসন্ন সিংহ ও পরে কৃষ্ণদাস পাল দ্বারা পরিচালিত হয়।
সোমপ্রকাশ (Somprakash):
প্রতিষ্ঠাতা: দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণায়)
প্রকাশকাল: ১৮৫৮ সাল
বিশেষত্ব: এটিই প্রথম বাংলা সংবাদপত্র যা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সম্পাদকীয় লিখত। এটি ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টের শিকার হয়েছিল।
অমৃতবাজার পত্রিকা (Amrita Bazar Patrika):
প্রতিষ্ঠাতা: শিশিরকুমার ঘোষ ও মতিলাল ঘোষ
প্রকাশকাল: ১৮৬৮ সাল (প্রথম বাংলা, পরে ইংরেজিতেও)
বিশেষত্ব: ১৮৭৮ সালের ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট থেকে বাঁচতে রাতারাতি এটি বাংলা থেকে ইংরেজি সংবাদপত্র হয়ে যায়।
বেঙ্গলি (Bengalee):
প্রতিষ্ঠাতা: গিরিশচন্দ্র ঘোষ (পরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)
প্রকাশকাল: ১৮৬২ সাল
বিশেষত্ব: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখপত্র হয়ে ওঠে।
সঞ্জীবনী (Sanjibani):
প্রতিষ্ঠাতা: কৃষ্ণকুমার মিত্র
প্রকাশকাল: ১৮৮৩ সাল
বিশেষত্ব: বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যুগান্তর (Yugantar):
প্রতিষ্ঠাতা: বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (যুগান্তর দল)
প্রকাশকাল: ১৯০৬ সাল
বিশেষত্ব: এটি ছিল বিপ্লবী ভাবধারার অন্যতম শক্তিশালী মুখপত্র।
সন্ধ্যা (Sandhya):
প্রতিষ্ঠাতা: ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়
প্রকাশকাল: ১৯০৬ সাল
বিশেষত্ব: এটিও বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রচার করত।
বন্দেমাতরম্ (Vande Mataram):
প্রতিষ্ঠাতা: অরবিন্দ ঘোষ
প্রকাশকাল: ১৯০৫ সাল (ইংরেজি)
বিশেষত্ব: চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের প্রচার ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা।
২. মারাঠা সংবাদপত্র:
কেশরী (Kesari):
প্রতিষ্ঠাতা: বাল গঙ্গাধর তিলক
প্রকাশকাল: ১৮৮১ সাল (মারাঠি ভাষায়)
বিশেষত্ব: তিলকের উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচারক এবং মারাঠা অঞ্চলে জনপ্রিয়।
মারাঠা (Mahratta):
প্রতিষ্ঠাতা: বাল গঙ্গাধর তিলক
প্রকাশকাল: ১৮৮১ সাল (ইংরেজি ভাষায়)
বিশেষত্ব: কেশরীর পাশাপাশি তিলকের রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করত।
৩. অন্যান্য অঞ্চলের সংবাদপত্র:
ইন্ডিয়ান মিরর (Indian Mirror):
প্রতিষ্ঠাতা: কেশবচন্দ্র সেন (পরে নরেন্দ্রনাথ সেন)
প্রকাশকাল: ১৮৬১ সাল (ইংরেজি)
বিশেষত্ব: উদারপন্থী জাতীয়তাবাদের প্রচারক।
নিউ ইন্ডিয়া (New India) ও কমনওয়েল (Commonweal):
প্রতিষ্ঠাতা: অ্যানি বেসান্ত
প্রকাশকাল: ১৯১৪ সাল
বিশেষত্ব: হোমরুল আন্দোলনের মুখপত্র।
আল-হিলাল (Al-Hilal):
প্রতিষ্ঠাতা: মাওলানা আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশকাল: ১৯১২ সাল (উর্দু)
বিশেষত্ব: জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম ঐক্যের প্রচারক।
ইয়ং ইন্ডিয়া (Young India):
প্রতিষ্ঠাতা: মহাত্মা গান্ধী
প্রকাশকাল: ১৯১৯ সাল (ইংরেজি)
বিশেষত্ব: গান্ধীর অহিংস অসহযোগ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বার্তা প্রচার করত।
হরিজন (Harijan):
প্রতিষ্ঠাতা: মহাত্মা গান্ধী
প্রকাশকাল: ১৯৩৩ সাল (ইংরেজি)
বিশেষত্ব: দলিতদের অধিকার ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের বার্তা প্রচার করত।
ন্যাশনাল হেরাল্ড (National Herald):
প্রতিষ্ঠাতা: জওহরলাল নেহরু
প্রকাশকাল: ১৯৩৮ সাল
বিশেষত্ব: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুখপত্র।
IV. ব্রিটিশ সংবাদপত্র আইনসমূহ
ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব উপলব্ধি করে এবং তাদের ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপ দমনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে।
১. সেন্সরশিপ অব প্রেস অ্যাক্ট, ১৭৯৯ (Censorship of Press Act, 1799):
প্রণেতা: লর্ড ওয়েলেসলি
মূল ধারা: এই আইন অনুসারে, সংবাদপত্র প্রকাশ করার আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো এবং কোনো খবর প্রকাশের আগে তা সরকারের দ্বারা যাচাই (pre-censorship) করা আবশ্যক ছিল। এটি মূলত ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব ভারতে আটকাতে প্রণীত হয়েছিল।
২. লাইসেন্সিং রেগুলেশনস, ১৮২৩ (Licensing Regulations, 1823):
প্রণেতা: জন অ্যাডামস (ভারপ্রাপ্ত গভর্নর-জেনারেল)
মূল ধারা: এই আইন অনুযায়ী, কোনো মুদ্রণালয় স্থাপনের জন্য বা সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। লাইসেন্স ছাড়া কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ করলে ৫০০ টাকা জরিমানা ও যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করার বিধান ছিল। রাজা রামমোহন রায় এই আইনের প্রতিবাদে তার ফারসি সংবাদপত্র 'মিরাত-উল-আখবার' প্রকাশ বন্ধ করে দেন।
৩. প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৩৫ (Press Act, 1835) / মেটকাফের আইন:
প্রণেতা: চার্লস মেটকাফ (গভর্নর-জেনারেল)
মূল ধারা: মেটকাফ ১৮২৩ সালের কঠোর লাইসেন্সিং রেগুলেশনস বাতিল করে সংবাদপত্রের ওপর থেকে অনেক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
বিশেষত্ব: তার উদারনীতির জন্য মেটকাফকে "ভারতীয় সংবাদপত্রের মুক্তিদাতা" (Liberator of the Indian Press) বলা হয়। এই আইন সংবাদপত্রের বিকাশে সাহায্য করে।
৪. লাইসেন্সিং অ্যাক্ট, ১৮৫৭ (Licensing Act, 1857):
প্রণেতা: লর্ড ক্যানিং
মূল ধারা: সিপাহী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এটি একটি জরুরি আইন ছিল। এতে লাইসেন্স ছাড়া সংবাদপত্র প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং সরকার যেকোনো সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা লাভ করে। এটি এক বছরের জন্য বলবৎ ছিল।
৫. রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৬৭ (Registration Act, 1867):
প্রণেতা: লর্ড লরেন্স
মূল ধারা: এটি পূর্ববর্তী লাইসেন্সিং অ্যাক্টের তুলনায় কম কঠোর ছিল। এই আইনে প্রতিটি বই ও সংবাদপত্রের মুদ্রক, প্রকাশক ও প্রকাশনার স্থান উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এটি মূলত তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল, দমনমূলক ছিল না।
৬. ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৭৮ (Vernacular Press Act, 1878):
প্রণেতা: লর্ড লিটন
মূল ধারা: এটি ছিল ভারতীয় (ভার্নাকুলার) ভাষার সংবাদপত্রগুলিকে দমনের জন্য ব্রিটিশদের সবচেয়ে কঠোর আইন। এটিকে "গ্যাগিং অ্যাক্ট" (Gagging Act) বা মুখ বন্ধ করার আইন বলা হত।
আইন অনুযায়ী, কোনো দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র যদি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা বিদ্বেষ প্রচার করে, তবে সরকার তার সম্পত্তি ও মুদ্রণালয় বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
ম্যাজিস্ট্রেটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে, এর বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না।
এই আইন থেকে বাঁচার জন্য 'অমৃতবাজার পত্রিকা' রাতারাতি বাংলা থেকে ইংরেজিতে প্রকাশ করা শুরু করে।
বিশেষত্ব: শুধুমাত্র দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রগুলির ওপরই এই আইন প্রযোজ্য ছিল, ইংরেজি সংবাদপত্রের ওপর নয়। এটি লিটনের সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফসল ছিল।
৭. ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট বাতিল, ১৮৮২ (Repeal of Vernacular Press Act, 1882):
প্রণেতা: লর্ড রিপন
মূল ধারা: লর্ড রিপন ১৮৭৮ সালের বিতর্কিত ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট বাতিল করেন, যা ভারতীয়দের মধ্যে ব্যাপক স্বস্তি এনে দেয়।
৮. নিউজপেপার্স (ইনসাইটমেন্ট টু অফেন্সেস) অ্যাক্ট, ১৯০৮ (Newspapers (Incitement to Offences) Act, 1908):
প্রণেতা: লর্ড মিন্টো
মূল ধারা: বিপ্লবী কার্যকলাপ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় এই আইন প্রণীত হয়। এই আইনে যেকোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত আপত্তিকর বা উস্কানিমূলক লেখার জন্য মুদ্রণালয় বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়।
৯. ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট, ১৯১০ (Indian Press Act, 1910):
প্রণেতা: লর্ড মিন্টো
মূল ধারা: এটি ১৯০৮ সালের আইনের পরিপূরক ছিল এবং আরও কঠোর ছিল। এই আইনে সংবাদপত্রগুলিকে জামানত (security deposit) জমা দিতে হতো এবং সরকারের নির্দেশ অমান্য করলে সেই জামানত বাজেয়াপ্ত করার বিধান ছিল।
১০. প্রেস এনকোয়ারি কমিটি, ১৯২১ (Press Enquiry Committee, 1921):
প্রণেতা: তেজবাহাদুর সাপ্রুর নেতৃত্বে গঠিত
মূল ধারা: এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯০৮ ও ১৯১০ সালের আইনগুলি বাতিল করা হয়।
১১. প্রেস (ইমার্জেন্সি পাওয়ার্স) অ্যাক্ট, ১৯৩১ (Press (Emergency Powers) Act, 1931):
প্রণেতা: লর্ড উইলিংডন
মূল ধারা: আইন অমান্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এটি একটি জরুরি আইন ছিল। এতে সংবাদপত্রগুলির বিরুদ্ধে ব্যাপক দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়, যার মধ্যে জামানত বাজেয়াপ্ত করা এবং মুদ্রণালয় বন্ধ করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি ১৯১০ সালের আইনের অনেক ধারা ফিরিয়ে এনেছিল।
V. সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও প্রভাব
জাতীয় চেতনার বিকাশ: সংবাদপত্রগুলি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী ধারণা ও ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
রাজনৈতিক শিক্ষা: এটি সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃতি, অর্থনৈতিক শোষণ এবং ভারতীয়দের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করে।
সামাজিক সংস্কার: বহু সংবাদপত্র সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, অস্পৃশ্যতার মতো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে।
সংগঠন ও সমন্বয়: এটি জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে এবং বিভিন্ন আন্দোলনকে সংগঠিত করতে সহায়ক ছিল।
সরকারের সমালোচনা: সংবাদপত্রগুলি ব্রিটিশ সরকারের নীতির কঠোর সমালোচনা করত এবং জনগণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরত।
উপসংহার:
ব্রিটিশ শাসনকালে সংবাদপত্রগুলি কেবল তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল না, বরং ভারতীয়দের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল। ব্রিটিশ সরকারের দমনমূলক আইন থাকা সত্ত্বেও, ভারতীয় সাংবাদিকরা সাহসিকতার সাথে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, যা শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। সংবাদপত্রগুলি ছিল ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে 'চতুর্থ স্তম্ভ'স্বরূপ।
Post a Comment