Question: ছাত্রী সংঘ কি?
উত্তর: ছাত্রী সংঘ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের জন্য গঠিত একটি বিপ্লবী সংগঠন, যা লীলা নাগ (রায়) কর্তৃক ১৯২৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিপ্লবী কার্যকলাপের পাশাপাশি নারী শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নেও কাজ করতো।
ব্যাখ্যা: ছাত্রী সংঘ ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী নারী সংগঠন, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম এবং নারী জাগরণের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। এটি ১৯২৮ সালে ঢাকার ইডেন কলেজে লীলা নাগ (রায়) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। লীলা নাগ এর আগে দীপালি সংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যা নারী শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করত। ছাত্রী সংঘ মূলত দীপালি সংঘেরই একটি রাজনৈতিক ও বিপ্লবী শাখা হিসেবে গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ: প্রাথমিকভাবে ছাত্রী সংঘের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি মেয়েদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, তাদের সংগঠিত করা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্রোতে নিয়ে আসা। সংগঠনটি কেবল বিপ্লবী কার্যকলাপে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং নারী শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা এবং সমাজসেবার মতো কাজও করত। তবে এর মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী কার্যকলাপে মেয়েদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বিপ্লবী ভূমিকা: ছাত্রী সংঘের সদস্যরা বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তারা অস্ত্র বহন করা, গোপন বার্তা আদান-প্রদান করা, বিপ্লবী সভা-সমাবেশের আয়োজন করা, অর্থ সংগ্রহ করা এবং বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতেন। এই সংগঠনের অনেক সদস্য সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী প্রমুখের মতো অসংখ্য সাহসী নারী এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের আত্মত্যাগ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যদিও শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী 'ছাত্রী সংঘ' এর সরাসরি সদস্য ছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে নারী বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ছাত্রী সংঘের অনুপ্রেরণা ও প্রভাব অনস্বীকার্য। বীণা দাস ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে খ্যাতি অর্জন করেন। কল্পনা দত্ত মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
যোগাযোগ ও প্রভাব: ছাত্রী সংঘ বাংলার অন্যান্য প্রধান বিপ্লবী দল, যেমন যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখত। তারা এই পুরুষতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগঠনগুলোর নারী শাখা হিসেবেও কাজ করত এবং তাদের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করত। ছাত্রী সংঘের মাধ্যমে নারী সমাজের মধ্যে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের এক নতুন স্পৃহা তৈরি হয়েছিল, যা সে সময়কার রক্ষণশীল সমাজে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য: ছাত্রী সংঘ কেবল একটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল না, এটি ছিল নারী মুক্তি আন্দোলনের একটি প্রতীক। এটি প্রমাণ করেছিল যে নারীরা কেবল গৃহকর্মে আবদ্ধ থাকার জন্য নয়, বরং দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেও সক্ষম। এই সংগঠনটি নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ঐতিহাসিক অবদানকে সুদৃঢ় করে। ব্রিটিশ সরকার এই সংগঠনটিকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখত এবং এর কার্যকলাপ দমনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ছাত্রী সংঘের সদস্যরা তাদের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন।
Post a Comment