Question: পুনা চুক্তি (১৯৩২)-এর শর্ত কী ছিল?
উত্তর: পুনা চুক্তির মূল শর্ত ছিল যে, দলিত শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করা হবে এবং যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থার অধীনে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভাগুলিতে তাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হবে, যা ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রদায়িক পুরস্কারে প্রস্তাবিত আসনের চেয়ে অনেক বেশি ছিল (প্রাদেশিক আইনসভায় ৭১টির বদলে ১৪৮টি আসন)।
ব্যাখ্যা: পুনা চুক্তি (১৯৩২) ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পটভূমি ছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড কর্তৃক ঘোষিত 'সাম্প্রদায়িক পুরস্কার' (Communal Award), ১৯৩২। এই পুরস্কারের মাধ্যমে মুসলমান, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং ইউরোপীয়দের মতো বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সবচেয়ে বিতর্কিত দিক ছিল, 'অনুন্নত শ্রেণি' (Depressed Classes), যা পরে দলিত নামে পরিচিত হয়, তাদের জন্যও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব।মহাত্মা গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা হিন্দু সমাজকে বিভক্ত করবে এবং অনুন্নত শ্রেণিগুলিকে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এর প্রতিবাদে তিনি ইয়েরওয়াড়া জেলে আমরণ অনশন শুরু করেন। তার জীবন বাঁচাতে এবং হিন্দু সমাজের ঐক্য বজায় রাখতে, মদন মোহন মালব্য, তেজ বাহাদুর সপ্রু, এম.আর. জয়াকার-এর মতো নেতারা বি.আর. আম্বেদকরের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেন। আম্বেদকর ছিলেন দলিতদের প্রধান প্রতিনিধি এবং তিনি তাদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবল সমর্থক ছিলেন, কারণ তার মতে এটিই তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার একমাত্র পথ।
দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৩২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর গান্ধী এবং আম্বেদকরের মধ্যে 'পুনা চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি নিম্নরূপ ছিল:
১. পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিলুপ্তি: দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। পরিবর্তে, তাদের জন্য যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা (Joint Electorates) চালু করা হয়। এর অর্থ হল, সাধারণ ভোটারদের সাথে দলিতরাও ভোট দিতে পারবে এবং দলিত প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবে।
২. সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি: ব্রিটিশ সরকারের 'সাম্প্রদায়িক পুরস্কার'-এ দলিতদের জন্য প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে ৭১টি আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব ছিল। পুনা চুক্তির মাধ্যমে এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১৪৮ করা হয়। অর্থাৎ, মোট ১৯৩২টি প্রাদেশিক আইনসভার আসনের প্রায় ১৮% দলিতদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়।
৩. কেন্দ্রীয় আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব: কেন্দ্রীয় আইনসভাতেও দলিতদের জন্য মোট ব্রিটিশ ভারতীয় আসনের ১৮% আসন সংরক্ষিত করা হয়।
৪. ভোটাধিকার ও নির্বাচন পদ্ধতি: চুক্তিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক নির্বাচনের একটি পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছিল যেখানে সংরক্ষিত আসন পূরণের জন্য দলিত ভোটাররা একটি প্রাথমিক নির্বাচনের মাধ্যমে ৪ জন প্রার্থীর একটি প্যানেল নির্বাচন করবে এবং এরপর সাধারণ ভোটাররা সেই ৪ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে একজন চূড়ান্ত প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে।
৫. সরকারি চাকরিতে প্রতিনিধিত্ব: সরকারি চাকরিতে দলিতদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা শিক্ষাগত অনুদানের মাধ্যমে সমর্থিত হবে।
পুনা চুক্তি ছিল একটি ঐতিহাসিক সমঝোতা। এটি একদিকে যেমন দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা ও সম্প্রসারণ করেছিল, তেমনি অন্যদিকে হিন্দু সমাজের ঐক্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। যদিও আম্বেদকর প্রাথমিকভাবে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন, তিনি গান্ধীর অনশনের কারণে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তির ফলে দলিতদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এর কার্যকারিতা নিয়ে পরবর্তীকালে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
Post a Comment