বক্তিয়ার খলজীর বাংলা বিজয় সংক্ষেপে আলোচনা করো৷

★★★★★
লক্ষ্মণ সেন খালি পায়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বজরায় চেপে বিনাযুদ্ধে নদীয়া থেকে পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান।
বক্তিয়ার খলজীর বাংলা জয় সম্পর্কে মিনহাজ-উদ্-দিন সিরাজের তরকৎ-ই-নাসিরি গ্রন্থ থেকে পুরো বিবরণ পাওয়া যায়। মিনহাজ বাংলা জয়ের প্রায় অর্ধশতক পরে সামসুদ্দিন নামে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী সেনার কাছ থেকে বক্তিয়ার খলজীর বাংলা জয়ের বিবরণ সংগ্রহ করেন। এছাড়া তারিখ-ই-ফিরিস্তা ও হাসান নিজামীর তাজ-উল-মাসির থেকেও কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। ডঃ মজুমদার মিনহাজের বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ মিনহাজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকে এই বিবরণ দেননি। তবে ফিরিস্তার বিবরণ হতে মিনহাজ মোটামুটি সমর্থিত হন। ইসামীর রচনা থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

বক্তিয়ার খলজীর উত্থান

বক্তিয়ার খলজীর পূর্ব জীবন সম্পর্কে জানা যায় যে, তাঁর পুরো নাম ছিল মালিক ইজ্জ্-উদ-দিন-মুহাম্মদ-বক্তিয়ার খলজী। তিনি ছিলেন গরমশীরের অধিবাসী। তিনি ছিলেন কদাকার এবং উচ্চাকাঙ্খী। ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে গজনী, দিল্লী হয়ে তিনি বাদাউনের মাক্তাদারের অধীনে সৈনিকের চাক্রীতে যোগ দেন। পরে তিনি অযোধ্যার শাসনকর্তার অধীনে ইক্তাদার নিযুক্ত হন। এই স্থান থেকে তিনি প্রতিবেশী বিহারের দিকে দৃষ্টি দেন। সেই সময় বিহার ছিল সেন রাজাদের অধীনে।

বক্তিয়ার খলজীর বিহার অভিযান

বক্তিয়ার প্রথমে বিহারে অভিযান চালিয়ে বহু ধনরত্ন লুঠ করেন। এই অর্থের দ্বারা তিনিএক শক্তিশালী সেনাদল গড়েন। বহু তুর্কী, খলজী সেনা তাঁর অধীনে যোগ দেয়। এই আক্রমণের সময় বক্তিয়ার দুর্গ বলে ভ্রমবশতঃ একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেন ও বহু ভিক্ষুকে হত্যা করেন। লামা তারানাথের মতে, বক্তিয়ার বিক্রমশীলা বিহার ধ্বংস করেন। তিনি ওদন্তপুরী বিহার ধ্বংস করে সেই স্থলে একটি দুর্গ স্থাপন করেন। এর পর তিনি ১২০৩ খ্রীঃ প্রচুর উপঢৌকনসহ কুতবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলা অভিযানের অনুমতি লাভ করেন।

বাংলার সেন শাসক লক্ষ্মণ সেনের অপদার্থতা

১২০৩-৫ খ্রীঃ মধ্যে বক্তিয়ার খলজী বিহার জয় করে বাংলার সীমান্তে এসে পড়েন। ৮০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন বা রায় লখমনিয়া তাঁর ধর্ম-কর্ম ও জ্যোতিষচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় প্রকৃতভাবে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি করতে অবহেলা করেন। তিনি বক্তিয়ারের আক্রমণের সম্মুখে তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্যোতিষীদের কাছে জানতে চাইলে জ্যোতিষীরা তাঁকে “তুর্কীদের অত্যাচার ও নির্যাতন” হতে। রক্ষা পাওয়ার জন্যে রাজধানী ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জ্যোতিষীরা বলেন যে, শাস্ত্রে লেখা আছে যে, তুর্কীদের হাতে তাঁর রাজ্য বিজিত হবে। তাঁরা জানান যে, “যে ব্যক্তির দুই বাহু এত বড় হবে যে তা সেই ব্যক্তির হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে থাকবে, সেই ব্যক্তিই শাস্ত্র মতে বাংলা জয় করবে।” লক্ষ্মণ সেন খোজ নিয়ে জানতে পারেন যে, বক্তিয়ার খলজীর দুই হাত এরূপ লম্বা। সুতরাং রাজা লক্ষ্মণ সেন মনোবল হারিয়ে ফেলেন। তিনি “ঐন্দ্রি মহাশান্তি” যজ্ঞ করে ভাগ্য ফেরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। পুরুষাকারের পরিবর্তে তিনি অদৃষ্টবাদকে আশ্রয় করেন।

বক্তিয়ার খলজীর নদীয়া আক্রমণ

মিনহাজের মতে, ১২০৫-৬ খ্রীঃ বক্তিয়ার তাঁর বাহিনী নিয়ে বাংলার রাজধানী নদীয়া বা নবদ্বীপের দিকে এগিয়ে চলেন। তিনি এত দ্রুত ঘোড়া ছুটান যে, মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী তাঁর সঙ্গে একতালে চলতে পারে। তার পিছনে মূল বাহিনী আসতে থাকে। নদীয়ার নগর দরজায় এসে তিনি কাহাকেও আক্রমণ না করে ১৮ জন সহচর সহ রাজপ্রাসাদের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। লোকে তাঁদের ঘোড়া বিক্রেতা বলে মনে করে। রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটক পার হয়ে তিনি রক্ষীদের আক্রমণ করেন। এই সময় রায় লছমনিয়া মধ্যাহ্ন ভোজনে বসেছিলেন। গোলমালের শব্দে তিনি জানতে পারেন যে, তুর্কী সেনা প্রাসাদ আক্রমণ করেছে। লখমনিয়া বা লক্ষ্মণ সেন খালি পায়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বজরায় চেপে বিনাযুদ্ধে নদীয়া থেকে পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান। লক্ষ্মণ সেনের ধন সম্পদ, তাঁর প্রজাবর্গ ও পরিজন এবং দাসদাসীদের বক্তিয়ার অধিকার করেন। তুর্কী সেনাদল নদীয়া লুঠ করে বহু ধনরত্ন পায়। বক্তিয়ার নদীয়াকে তাঁর নব বিজিত রাজ্যের রাজধানীর উপযুক্ত মনে না করে, লক্ষ্মণাবতীকে তাঁর রাজধানী হিসেবে মনোনয়ন করেন। বক্তিয়ার উত্তর বাংলায় তাঁর আধিপত্যকে অপেক্ষাকৃত দৃঢ় করেন। নদীমাতৃক দক্ষিণ বাংলা ছিল তাঁর কাছে অনেকটা অপরিচিত, অসুবিধাজনক স্থান।

বক্তিয়ার খলজীর তীব্বত অভিযান

বক্তিয়ার খলজী এর পর তিব্বত অভিযানের জন্যে প্রস্তুত হন। বক্তিয়ার খলজীর তিব্বত অভিযানের কারণ মিনহাজ উল্লেখ করেননি। ডঃ নিজামীর মতে, সম্ভবতঃ বক্তিয়ার তিব্বতের মধ্য দিয়ে তুর্কীস্থানের সঙ্গে যোগাযোগের সংক্ষিপ্ত ও সোজা পথ বের করার চেষ্টা করেন। তুর্কীস্থানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সম্ভবতঃ তিনি তুর্কীস্থান থেকে নুতন সেনা এনে বাংলার অন্যান্য অঞ্চল জয় করার পরিকল্পনা করেন। তাছাড়া দিল্লীর অধীনতা মুক্ত হয়ে স্বাধীন সুলতান হওয়ার উচ্চাকাঙ্খা হয়ত তাঁর ছিল।

বক্তিয়ার খলজীর মৃত্যু

মিনহাজের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বাগমতী নদী পার হয়ে, কোচ, মেচ্ প্রভৃতিদের দেশ পার হয়ে তিনি হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে ঢুকে পড়েন। কিন্তু প্রবল বাধার আশঙ্কায় তিনি ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে বাগমতী নদীর পুলটি শত্রুরা ধ্বংস করায় নদী পারাপারের সময় শত্রুর আক্রমণে তাঁর বহু সেনা নিহত হয়। সম্পূর্ণ * হজ্বল হয়ে তিনি রাজধানীতে ফিরে আসেন। এর ফলে বক্তিয়ার দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় আলিমর্দান খলজী নামে এক ব্যক্তি তাঁকে নিহত করেন।
Tags:
Next Post Previous Post

You May Also Like

Editor
ইতিহাস পাঠশালা

যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু অতীত তাই হল ইতিহাস৷ ইতিহাস পাঠশালা হল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত, উত্তরধর্মী, প্রবন্ধ মূলক পাঠ সহায়ক একটি ব্লগ৷ মূলত ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরাই এই ব্লগের প্রধান লক্ষ্য৷