ইক্তা ব্যবস্থা কি? দিল্লির সুলতানি আমলে ইক্তা প্রথার বৈশিষ্ট্য ও বিবর্তন আলোচনা কর৷

Iqta system

ইক্তা ব্যবস্থা কি? দিল্লির সুলতানি আমলে ইক্তা প্রথার বৈশিষ্ট্য ও বিবর্তন আলোচনা কর৷

'ইক্তা' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল একটি অংশ বা এলাকা। রাজস্ব ব্যবস্থার বিচারে ইক্তা শব্দের সহজ অর্থ হল ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্যের উপর বিশেষ কোনো ব্যক্তিবর্গকে সরকার কর্তৃক অধিকারদান। ইক্তা প্রথাটিকে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগের ইউরোপের ফিফ (fief) বলে উল্লেখ করেছেন।
বৈশিষ্ট্য দিল্লির সুলতানি আমলে ইক্তা প্রথার বৈশিষ্ট্য ও বিবর্তন
১. ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ইক্তা ব্যবস্থা সেনাপতি বা সামরিক অফিসারদের পরিচালনা ও সেবার বিনিময়ে ভূমি দেয়া হতো।
২. প্রশাসনিক গঠন প্রাথমিক দিল্লির সুলতানি আমলে, ইক্তা ধারকরা একইসাথে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক কর্মকান্ড দায়িত্ব পালন করতেন এবং রাজস্ব আদায় ও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন।
৩. স্বশাসিত ক্ষমতা প্রাথমিকভাবে, ইক্তা ধারকরা অপরাধ এবং কানুন-শাস্ত্র পালনের জন্য উচ্চ স্বাধীনতা অর্জন করতেন, কিন্তু পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ তাদের কর্তব্য নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করেন।
৪. ঐতিহ্যগত স্বভাব প্রাথমিকভাবে ঐতিহ্যগতভাবে ইক্তা ব্যবস্থা অঐতিহ্যগএ ক্ষমতা দ্বারা বিপুল ক্ষতিপূরণের কারণে ইক্তা ধারকদের মধ্যে শক্তিশালী রাজপরিবার গঠন হয়ে উঠতে পারে।


সুলতানি আমলে ইক্তা প্রথার বিবরণ

দিল্লির সুলতানি শাসনকালে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ইক্তাদারদের দ্বারা পরিচালিত ইক্তাপ্রথা। এ ইকতা গ্রহণকারীরা মুকতি বা ইক্তাদার নামে পরিচিত ছিল। তুর্কি লেখকদের ধারণা অনুযায়ী ইক্তাদারগণ ছিলেন একাধারে রাজস্ব সংগ্রহকারী, সেনাদলের বেতন প্রদানকারী ও সেনাধ্যক্ষ।

ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন

ভারতে ইক্‌তা ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে থেকেই মধ্য এশিয়াতে ‘ইকতা’প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথাই দিল্লির তুর্কি শাসকরা অনুকরণ করেন। কে. এম. আশরফের ধারণায় সম্ভবত খলিফা মুক্তাদি ইক্তা ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটান। একাদশ শতকে নিজাম-উল-তুসি নামে এক সেলজুক তুর্কি ঐতিহাসিক তাঁর ‘সিয়াসৎ নামা' গ্রন্থে ইকতাপ্রথার প্রচলনের কথা উল্লেখ করেন। ভারতে ত্রয়োদশ শতকের সূচনা পর্বে অর্থাৎ দিল্লিতে সুলতানি শাসন কায়েম হবার পর ইক্তা প্রথা চালু হয়। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ইকতাপ্রথার প্রবর্তন করেন।

ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য

ইকতা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা কয়েকটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেয়েছিলেন। যেমন—
  1. সুলতানগণ ইতা প্রদানের মধ্যে দিয়ে আসলে আমির ওমরাহদেরই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। 
  2. সুলতানি সাম্রাজ্যসীমা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় দূরবর্তী অঞ্চলগুলির উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং যোগাযোগে অসুবিধা দেখা দেয়। ইকতাদারদের নিয়োগের মধ্যে দিয়ে এই অসুবিধা দূর করার চেষ্টা শুরু হয়। 
  3. নতুন নতুন কটি বিজিত অঞ্চলগুলি থেকে রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই কটি অনিশ্চয়তা দূরীকরণের লক্ষ্যে ইক্তাদারদের নিয়োগ করা হয়।
  4. দিল্লি সুলতানিকে সুরক্ষিত ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সামন্ততন্ত্রের সিস, ধ্বংসসাধন প্রয়োজন ছিল।


ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

একাদশ শতকের তুর্কি লেখক নিজাম-উল-তুসির লেখা ‘সিয়াসৎ নামা’ গ্রন্থ থেকে ইকতা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি জানা যায়— 
  1. 'ইক্তা' গ্রহীতাগণ পরিচিত ছিলেন মুকতি বা মুক্তি বা ইক্তাদার নামে। 
  2. ইক্তাদাররা কৃষকদের কাছ থেকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় করতেন।
  3. রাজস্ব পরিশোধকারী প্রজাদের জীবন, সম্পত্তি ও পরিবারের উপর ইক্তাদারদের কোনো অধিকার ছিল না।
  4. ইক্তাদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখতে হত। প্রয়োজনে সুলতানকে সেই সেনা সরবরাহ করতে হত।

ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন

  • ইলতুৎমিসের আমলে বিবর্তন: ইক্তাপ্রথা প্রবর্তনের পর সুলতান ইলতুৎমিস তাকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে উদ্যোগী হন। কোনো ইক্তার উপর বংশানুক্রমিক অধিকার যাতে গড়ে না ওঠে, তার জন্য তিনি ইকতাদারদের বদলির নীতি নেন। 
  • বলবনের আমলে বিবর্তন: যে সমস্ত ইকতাদার ভাতা ও জমি ভোগদখল করলেও প্রয়োজেনের সময় সামরিক সাহায্য দিতেন না, বলবন তাদের তালিকা তৈরি করান। ইক্তাদাররা যাতে সুলতানের প্রাপ্য রাজস্ব ফাঁকি দিতে না পারে, তার জন্য বলবন প্রতিটি ইক্তায় ‘খোয়াজা’ নামে এক ধরনের হিসাবপরীক্ষক নিয়োগ করেন।
  • আলাউদ্দিন খলজির আমলে বিবর্তন: সুলতান আলাউদ্দিন খলজি সেনাদের ইক্তাদানের পরিবর্তে নগদ বেতনদানের প্রথা চালু করেন (যদিও সেনাপতিদের ইতাদানের রীতি চালু থাকে)।
  •  ফিরোজশাহ তুঘলকের আমলে বিবর্তন: ফিরোজশাহ তুঘলক ব্যাপকভাবে ইক্তা বিতরণ করলে খালিসা জমির পরিমাণ কমে। তিনি ইক্তা ব্যবস্থাকে বংশানুক্রমিক করে দেন। সেনাদলকে নগদ বেতনের পরিবর্তে ইতা দানের রীতি পুনঃপ্রবর্তিত হয়।

আরো বিস্তারিত জানতে: ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো।

ইক্তা ব্যবস্থার গুরুত্ব

ইক্তাপ্রথা প্রবর্তনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

  • শহরের শ্রীবৃদ্ধি: ইক্তাদারদের অনেকেই তাদের উদ্‌বৃত্ত অর্থ শহরে ব্যাবসাবাণিজ্যে বিনিয়োগ করত। ব্যাবসাবাণিজ্যের সুবাদে শহরের অর্থনীতি সুদৃঢ় হলে, শহরগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। 

  • কৃষক শ্রেণির দুর্দশা বৃদ্ধি: অনেক সময় অতিরিক্ত অর্থের লোভে ইক্তাদাররা নিজের নির্দিষ্ট ইক্তাটি অপরকে ইজারা দিত। ইজারাদাররা অধিক মুনাফার লক্ষ্যে কৃষক সমাজের উপর আর্থিক শোষণ চালাত। এই অতিরিক্ত অর্থের বোঝা বইতে গিয়ে কৃষক শ্রেণির দুর্দশা বাড়ে।

  • পূর্ববর্তী শাসকদের মর্যাদা হ্রাস: ইক্তা ব্যবস্থা পূর্ববর্তী গ্রামীণ শাসকশ্রেণির সামাজিক মর্যাদা হ্রাস করে। তাই গ্রামের নিম্নতর অভিজাতরা কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়।

মূল্যায়ন

ইক্তাদারদের দ্বারা পরিচালিত ইক্তা প্রথা সুলতানি রাজত্বে ভূসম্পত্তির প্রধান মানদণ্ডে পরিণত হয়। দিল্লি সুলতানির শেষদিকে ইতাদাররা অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক মোরল্যান্ডের বক্তব্য থেকে জানা যায়, লোদি আমলে সুলতানির অধিকাংশ অঞ্চলে, ইক্তাদার, জমিদার, জায়গিরদার অর্থাৎ ভূস্বামীরাই প্রকৃত শাসক হয়ে ওঠে।

Next Post Previous Post