Class 7 History Chapter 2 | হর্ষবর্ধন-শশাঙ্ক সম্পর্ক, কর্ণসুবর্ণ, ও মাৎস্যন্যায়

★★★★★
Class 7 History Chapter 2 : ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের কয়েকটি ধারা
Class 7 History Chapter 2 : ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের কয়েকটি ধারা

শশাঙ্ক ছিলেন এক গুপ্ত সম্রাটের মহাসামন্ত। ৬০৬-০৭ খ্রিস্টাব্দের কিছু কাল আগে তিনি গৌড়ের শাসক হন। শশাঙ্কের শাসনের ষাট-সত্তর বছর আগে থেকেই গৌড় ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। শশাঙ্কের আমলে গৌড়ের ক্ষমতা আরও বেড়েছিল। ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন শাসক ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ

শশাঙ্কের শাসনকালে উত্তর ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি (মালব, কনৌজ, স্থানীশ্বর বা থানেসর, কামরূপ, গৌড় প্রভৃতি) নিজ-নিজ স্বার্থে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখত। শশাঙ্ক সেই দ্বন্দ্বে অংশ নেন। সেভাবে উত্তর-পশ্চিম বারাণসী পর্যন্ত তাঁর রাজত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল। শশাঙ্ক সমগ্র গৌড় দেশ, মগধ-বুদ্ধগয়া অঞ্চল এবং ওড়িশার একাংশ নিজের অধিকারে আনতে পেরেছিলেন। উত্তর ভারতের ক্ষমতাধর রাজ্যগুলির সঙ্গে লড়াই করে শশাঙ্ক গৌড়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। এই ঘটনা তাঁর বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয়।

শশাঙ্কের রাজনৈতিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্থানীশ্বরের পুষ্যভূতি বংশীয় শাসক হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব। সকলোত্তরপথনাথ উপাধিধারী হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে হারাতে পারেননি।

শশাঙ্ক ধর্মীয় বিশ্বাসে ছিলেন শৈব বা শিবের উপাসক। আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকর নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে এবং সুয়ান জাং-এর ভ্রমণ বিবরণীতে তাঁকে ‘বৌদ্ধবিদ্বেষী বলা হয়েছে। শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের হত্যা করেছিলেন এবং বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মীয় স্মারক ধ্বংস করেছিলেন। হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের রচনা হর্ষচরিত এ শশাঙ্ককে নিন্দা করা হয়েছে।

অন্যদিকে শশাঙ্কের শাসনকালের কয়েক বছর পরে সুয়ান জাং কর্ণসুবর্ণ নগরের উপকণ্ঠে রক্তমৃত্তিকা বৌদ্ধবিহারের সমৃদ্ধি লক্ষ করেছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর চিনা পর্যটক ইৎ সিং-এরও নজরে পড়েছিল বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতি। শশাঙ্ক নির্বিচারে বৌদ্ধবিদ্বেষী হলে তা হতো না। বলা যায় যে, শশাঙ্কের প্রতি সব লেখকরা পুরোপুরি বিদ্বেষমুক্ত ছিলেন না। সুতরাং, শশাঙ্ক সম্পর্কে তাঁদের মতামত কিছুটা অতিরঞ্জিত ছিল বলে মনে করা যেতে পারে।

শশাঙ্কের শাসনকালে গৌড়ে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে বলা যায় গৌড়তন্ত্র। এই ব্যবস্থায় রাজ্যের কর্মচারী বা আমলারা একটা নির্দিষ্ট শাসনপ্রণালী গড়ে তুলেছিল। আগে যা ছিল গ্রামের স্থানীয় লোকের কাজ, শশাঙ্কের সময় সেই কাজে প্রশাসনও হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। অর্থাৎ, ঐ আমলের গৌড় রাজ্যে কেন্দ্রীয় ভাবে সরকার পরিচালনা করা হতো।

শশাঙ্কের আমলে সোনার মুদ্রা প্রচলিত ছিল। কিন্তু তার মান পড়ে গিয়েছিল। নকল সোনার মুদ্রাও দেখা যেত। রুপোর মুদ্রা ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই যুগে সম্ভবত মন্দা দেখা দিয়েছিল। সমাজে জমির চাহিদা বাড়তে থাকে। অর্থনীতি হয়ে পড়ে কৃষিনির্ভর। বাণিজ্যের গুরুত্ব কমে যাওয়ার ফলে নগরের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। আবার কৃষির গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় সমাজ ক্রমশ গ্রামকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল সমাজে মহত্তর বা স্থানীয় প্রধানদের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। শ্রেষ্ঠী বা বণিকদের গুরুত্ব ও ক্ষমতা আগেকার যুগের থেকে কমে এসেছিল। স্থানীয় প্রধানরা এ যুগে শ্রেষ্ঠীদের মতোই ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল।

এ যুগে বঙ্গ এবং সমতটের শাসকরা প্রায় সকলেই ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরাগী বিষ্ণু, কৃষ্ণ এবং শিব পুজোর প্রথা ছিল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকের অধিকাংশ সময় জুড়ে বৌদ্ধধর্ম বাংলার রাজাদের সমর্থন পায়নি। পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে পাল আমলে বৌদ্ধধর্ম আবার রাজার সমর্থন পেয়েছিল।

শশাঙ্ক কোনো স্থায়ী রাজবংশ তৈরি করে যেতে পারেননি। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর গৌড়ের ক্ষমতা নষ্ট হয়। বাংলায় নানা বিশৃঙ্খলা দেখা গিয়েছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর বছর দশেক পরে হর্ষবর্ধনও মারা যান। বাংলার নানা অংশ প্রথমে কামরূপের রাজা এবং পরে নাগ সম্প্রদায়ের জয়নাগ এবং তিব্বতের শাসকরা অধিকার করেন। অষ্টম শতকে কনৌজ এবং কাশ্মীরের শাসকরা বাংলা আক্রমণ করেছিলেন। বাংলার ইতিহাসে এই বিশৃঙ্খল সময়কে বলা হয় মাৎস্যন্যায়ের যুগ।

কর্ণসুবর্ণ : প্রাচীন বাংলার নগর


পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার চিরুটি (বর্তমান নাম কর্ণসুবর্ণ) রেলস্টেশনের কাছে রাজবাড়িডাঙায় প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা (রাঙামাটি) বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। চিনা বৌদ্ধ পর্যটক হিউয়েন সাতের বিবরণীতে এর উল্লেখ আছে। এর কাছেই ছিল সেকালের গৌড়ের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণ। চিনা ভাষায় এই বৌদ্ধবিহারের নাম লো-টো-মো-চিহ্ন। সুয়ান জাং তাম্রলিপ্ত (আধুনিক তমলুক) থেকে এখানে এসেছিলেন। কর্ণসুবর্ণ স্থানীয় ভাবে রাজা কর্ণের প্রাসাদ নামে পরিচিত।

সুয়ান জাং লিখেছেন যে, এই দেশটি জনবহুল এবং এখানকার মানুষেরা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে জমি নীচু ও আর্দ্র, নিয়মিত কৃষিকাজ হয়, অঢেল ফুল-ফল পাওয়া যায়, জলবায়ু নাতিশীতোষ এবং এখানকার মানুষজনের চরিত্র ভালো ও তাঁরা শিক্ষাদীক্ষার পৃষ্ঠপোষক। কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধ এবং শৈব উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই বসবাস করত।

কর্ণসুবর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। আশ-পাশের গ্রাম থেকে এখানকার নাগরিকদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসত। শশাঙ্কের আমলের অনেক আগে থেকেই সম্ভবত এই অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। রক্তমৃত্তিকা থেকে জনৈক বণিক জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় অঞ্চলে বাণিজ্য করতে গিয়েছিল এমন নিদর্শনও পাওয়া গেছে। এর থেকে কর্ণসুবর্ণের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

কর্ণসুবর্ণের রাজনীতিতে পালাবদল ঘটেছে বারবার। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে এই শহর অল্প সময়ের জন্য কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মার হাতে চলে যায়। এর পর কিছু কাল এটি জয়নাগের রাজধানী ছিল। তবে সপ্তম শতকের পরে এই শহরের কথা আর বিশেষ জানা যায় না। পাল এবং সেন যুগের ইতিহাসের উপাদানগুলিতে এর কোনো উল্লেখ নেই।

মাৎস্যন্যায়


মাৎস্যন্যায় বলতে দেশে অরাজকতা বা স্থায়ী রাজার অভাবকে বোঝানো হয়। পুকুরের বড়ো মাছ যেমন ছোটো মাছকে খেয়ে ফেলে, অরাজকতার সময়ে তেমনি শক্তিশালী লোক দুর্বল লোকের ওপর অত্যাচার করে।

শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের মধ্যভাগ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত একশো বছর ছিল বাংলার ইতিহাসে একটা পরিবর্তনের যুগ। । ঐ যুগে প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত লোক, ব্রাহ্মণ এবং বণিক ইচ্ছামতো নিজের নিজের এলাকা শাসন করত। বাংলায় কোনো কেন্দ্ৰীয় শাসক ছিল না।

বছরের পর বছর এই অবস্থা চলার পরে বাংলার প্রভাবশালী লোকেরা মিলে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের মধ্যভাগে গোপাল নামে একজনকে রাজা নির্বাচন করে (আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ)। ঐ সময় থেকে বাংলায় পাল বংশের রাজত্ব শুরু হয়।


আজকের আলোচ্য বিষয় : হর্ষবর্ধন-শশাঙ্ক সম্পর্ক, কর্ণসুবর্ণ, ও মাৎস্যন্যায়

আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর 👉

কে কবে ও কেন হর্ষাব্দ প্রবর্তন করেন ?

সম্রাট হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষাব্দ প্রবর্তন করেন। ৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে হর্ষবর্ধন সিংহাসন আরোহণ করেন। তাঁর এই সিংহাসন আরোহণের কালতে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ঐ বছরে তিনি হর্ষাব্দ নামে নতুন অব্দের প্রবর্তন করেন। যা হষাব্দ নামে পরিচিত।

কিভাবে হর্ষবর্ধন থানেশ্বর ও কনৌজের এর উপর যুগ্ম কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ?

নিঃসন্তান গ্রহবর্মার মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন সিংহাসনের ওপর দাবিদার সুর সেনকে পরাজিত করে কনৌজের সিংহাসনে দখল করেন। অপরদিকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকার হিসাবে হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন। এইভাবে হর্ষবর্ধন থানেশ্বর ও কনৌজের সিংহাসনের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

কাকে কেন ‘সকলোত্তর পথনাথ' বলা হয? 

কনৌজরাজ হর্ষবর্ধনকে 'সকলোত্তর পথনাথ' বলা হয়। চালুক্য বংশীয় দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল শিলালিপি থেকে জানা যায় হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তর ভারতের রাজাদের নিজের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেছিলেন। তাই সমগ্র উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে তাকে সকলোত্তর পথনাথ বলা হয়।

পঞ্চভারত বলতে কি বোঝ?

হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের মতে, হর্ষবর্ধন ‘পঞ্চভারত' এর অধীশ্বর ছিলেন। এই পঞ্চভারত হল—পাঞ্জাব, কনৌজ, বিহার, বাংলা, ও উড়িষ্যা। এই পাঁচটি অঞ্চল একত্রে ‘পঞ্চ ভারত' নামে পরিচিত।

কাকে কেন মহোদয়শ্রী বলা হয়?

হর্ষবর্ধন ছিলেন অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন একজন সমরকুশলী নরপতি। গুপ্তবংশের পতনের সমগ্র উত্তর ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়লে হর্ষবর্ধন অন্তত কিছু কালের জন্য কনৌজকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ও শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কেন্দ্র হিসাবে কনৌজ ‘মহোদয়শ্রী' অভিধায় ভূষিত হয়ে ছিলো।

হর্ষবর্ধনের সংস্কৃতি মনস্কপকার পরিচয় দাও?

শুধুমাত্র একজন দক্ষ সমরকুশলী রাজা নয়—হর্ষবর্ধন ছিলেন একজন সুপণ্ডিত। এবং শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তিনি নিজে একজন কবি ও নাট্যকার ছিলেন। তাঁর রচিত ‘নাগানন্দ' ‘রত্নাবলী’, ‘প্রিয়দর্শিকা’, প্রভৃতি সংস্কৃত সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ, এছাড়াও বাণভট্ট, হিউয়েন সাঙ, জয়সেন প্রমুখ গুণি ব্যক্তি তাঁর সভা অলঙ্কৃত করেছিলেন।

টীকা লেখ : কনৌজের ধর্মসভা।

সভাপতি – হিউয়েন সাং
হিউয়েন সাঙ এর রচনায় কনৌজের ধর্মসভা সম্পর্কে ধর্মীয় বিবরণ পাওয়া যায়। মহাযান ও হীনযান বাদীদের মধ্যে ধর্মীয় বিবাদ দূর করার জন্য খৃষ্টধর্ম ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে কনৌজ এই ধর্মসভার আয়োজন করেন। এখানে প্রত্যহ সূর্যোদয়ের সময় স্বর্ণ নির্মিত বুদ্ধমূর্তি সহ এক শোভাযাত্রা বের হতো। যেখানে হর্ষ বর্ধন স্বয়ং বুদ্ধমূর্তিতে চামর দিয়ে বাতাস করতেন। এই অধিবেশন আঠারোদিন স্থায়ী ছিল। এখানে বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে আলোচনা হতো।

টীকা লেখ : প্রয়াগের মেলা বা মহামোর পরিষদ

মহামোর হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় প্রয়াগের মেলা সম্পর্কে বিষদ বিবরণ পাওয়া যায়। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থলে প্রয়াগে এক মেলা বসতো। এই মেলার অপর নাম ছিল 'মহামোক্ষ পরিষদ', এখানে হর্ষবর্ধন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে দান করতেন। এই স্থানটির নাম ছিল 'দানক্ষেত্র' বা 'সন্তোষক্ষেত্র'। দীর্ঘ তিনমাস ব্যাপী মেলা এই মেলায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ যোগদান করত।

‘লোকপাল' ও ‘বিষয়পতি' বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? 

হর্ষবর্ধনের শাসনকালে প্রাদেশিক শাসনকর্তা লোকপাল এবং বিষয়ের প্রধান বিষয়পতি নামে পরিচিত ছিলেন।

কুন্তল ও বলাধিকৃত বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে?

হর্ষবর্ধনের সময়ে অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান কুন্তল নামে পরিচিত। পদাতিক বাহিনীর উচ্চপদাধিকারী বলাধিকৃত বলা হয়।

চট, ও ভট নামে কারা পরিচিত?

হর্ষবর্ধনের সামরিক বাহিনীর সাধারণ সেনা বাহিনীরা চট ও ভট নামে পরিচিত ছিলেন।

হর্ষবর্ধনের আমলে কি কি কর আদায় করা হতো?

হর্ষবর্ধনের আমলে তিন ধরণের কর আদায় করা হতো এগুলি হল
  • (ক) ভাগ—ভাগ ছিল উগ্ন ফসলের সামনের এক ষষ্ঠাংশ।
  • (খ) হিরণ্য-হিরণ্য হল বাণিজ্য শুল্ক।
  • (গ) বলি-জরুরী অবস্থায় অতিরিক্ত ব্যয়নির্বাহের জন্য বলি আদায় করা হতো।

হর্ষবর্ধনের সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে ছিলেন? 

হর্ষবর্ধনের সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন শীলভদ্র।

বাংলার প্রথম সার্বভৌম শাসক কে? তাঁর রাজধানী কোথায় ছিল? 

বাংলার প্রথম সার্বভৌম শাসক হলেন শশাঙ্ক। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ।

হর্ষবর্ধনের সাথে শশাঙ্কের সম্পর্ক কেমন ছিল?

হিউয়েন সাঙ এর বিবরণ অনুযায়ী শশাঙ্কের কাছে পরাজিত ও নিহত রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। কিন্তু হর্ষ ও শশাঙ্কের যুদ্ধের কোন বিবরণ তাঁর রচনায় পাওয়া যায় না। তবে মেদিনীপুর লিপি থেকে জানা যায়। যুদ্ধে শশাঙ্কের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই তিনি 'মহারাজাধিরাজ' উপাধি ত্যাগ করেন কিন্তু তা সত্ত্বেও ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর পর্যন্ত তিনি গৌড়, মগধ, দণ্ডভুক্তি ও উৎকলের অধিপতি ছিলেন।

শশাঙ্ক কোন ধর্মানুসারী ছিলেন?

শশাঙ্ক শৈব ধর্মের অনুরাগী ছিলেন।

শশাঙ্ককে কেন বৌদ্ধ বিদ্বেষী বলা হয় ?

হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনা অনুসারে—
  • (ক) শশাঙ্ক বুদ্ধগয়ার পবিত্র বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন এবং বৃক্ষের শিকড় উৎপাটন করেন, 
  • (খ) তিনি পাটলিপুত্রে বুদ্ধের চরণ চিহ্ন অঙ্কিত প্রস্তর খণ্ড বিনষ্ট করে; 
  • (গ) কুশীনগর, বিহার থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিতাড়িত করেন। তাই বাণভট্ট শশাঙ্ককে ‘গৌড়ধর্ম', ও 'গৌড়ভুজঙ্গ' বলে অভিহিত করেছেন।

শশাঙ্ককে কে কি প্রকৃত বৌদ্ধ বিদ্বেষী বলা যায় ?

ডঃ মজুমদার, ডঃ এন. রায় প্রমুখের মতে, হর্ষের অনুগত হিউয়েন সাঙ ও বাণভট্ট শশাঙ্ক বিদ্বেষী ছিলেন। হিউয়েন সাঙ নিজেই স্বীকার করেছেন যে, শশাঙ্কের রাজত্বকালে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। রাজধানীতে বৌদ্ধভিক্ষুদের প্রতিপত্তি ছিল। এছাড়া তাম্রলিপ্ত ও কর্নসুবর্ণ প্রভৃতি স্থানে বহু বৌদ্ধ স্তুপ দেখেছেন। যা থেকে বলা যায় যে শশাঙ্ক বৌদ্ধ বিদ্বেষী ছিলেন না।

শশাঙ্কের রাজধানী কোথায় ছিল?

শশাঙ্কের রাজধানী নাম গৌড়।

শশাঙ্কের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

  • (ক) বাংলাকে সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারদান; 
  • (খ) আর্যাবর্তে বাঙালী রাজা হিসাবে কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

‘গৌড়তন্ত্র' বলতে কি বোঝায়?

এ বিষয়ে বিতর্ক আছে। ‘গৌড়তন্ত্র' শব্দটি ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প' নামক বৌদ্ধগ্রন্থে পাওয়া গেছে। এখানে বলা হয়েছে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হিংসা, বিদ্বেষ, বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি কারণে গৌড়তন্ত্র ভেঙে পড়ে। এই অর্থে শশাঙ্কের নেতৃত্বে গৌড়ের যে শাসন তন্ত্র ‘গৌড়তন্ত্র' নামে পরিচিত।

মাৎস্যন্যায় বলতে কি বোঝ?

ধর্মপালের ‘খালিমপুর তাম্রশাসন' থেকে জানা যায়, গৌড়রাধিপতি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় এক চমর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অন্তকলহ, গৃহযুদ্ধ, গুপ্তহত্যা, নৈরাজ্য ও অরাজকতা চরম আকার ধারণ করে। চলতে থাকে দুর্বলের উপর সকলের অত্যাচার অর্থাৎ পুকুরের বড় মাছ যেমন ছোটো মাছকে গিলে ফেলে। বাংলার মানুষেরও ঠিক একই অবস্থা দেখা দেয়। বাংলার এই অবস্থাকে বলা হয় 'মাৎস্যন্যায়'।

হর্ষবর্ধনের সময় আগত কয়েকজন চীনা পর্যটকের নাম লেখো?

হর্ষবর্ধনের সময় আগত দুজন চীনা পর্যটক হলেন—হিউয়েত সাঙ (৬২৯-৬৪৪) ও ফ্যাংচি।

বাণভট্ট কে ছিলেন?

পুষ্যভূতি বংশের সম্রাট হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বাণভট্ট। তিনি ‘হর্ষচরিত' ও ‘কাদম্বরী' নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে হর্ষবর্ধনের সিংহাসন আরোহণ ও তাঁর রাজ্যজয়ের বিভিন্ন ঘটনা জানা যায়। তবে তিনি হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করায় অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, তাঁর গ্রন্থে হর্ষবর্ধন সম্পর্কে অতিরঞ্জন করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও তাঁর এই দুটি গ্রন্থ গুপ্ত পরবর্তী যুগের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস বলে বিবেচিত।

Tags:
Next Post Previous Post

You May Also Like

Editor
ইতিহাস পাঠশালা

যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু অতীত তাই হল ইতিহাস৷ ইতিহাস পাঠশালা হল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত, উত্তরধর্মী, প্রবন্ধ মূলক পাঠ সহায়ক একটি ব্লগ৷ মূলত ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরাই এই ব্লগের প্রধান লক্ষ্য৷