All MCQ

প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার উৎপত্তি ও অগ্রগতি আলোচনা কর।

Origin and Progress of Feudalism in Ancient India

 প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার উৎপত্তি ও অগ্রগতি

মধ্যযুগের ইউরোপের মত প্রাচীন ভারতে সামস্ত প্রথা ছিল কিনা এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। মধ্যযুগের ইউরোপের সামন্ত প্রথার মতো আক্ষরিক ছবি ভারতে দেখতে পাওয়া না গেলেও সামন্ত প্রথার কয়েকটি নিজস্ব চরিত্র ৩০০ খ্রীঃ ভারতে দেখা গিয়েছিল। এই সামন্ত প্রথার দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল যথা, 

  • ১। ভূমির স্বত্ব। 
  • ২। ভূম্যাধিকারীদের রাজ্য শাসনের ক্ষমতা। 

মৌর্য উত্তর যুগে সামন্ত প্রথা

মৌর্য পরবর্তী যুগ থেকে কয়েকটি ভূমি পট্টলী দেখা যায় যাতে জমি দান করার পাশাপাশি অঞ্চলটির শাসনের অধিকারও দান করা হয়। ফলে দান গ্রহীতা জমিদারীর সঙ্গে সঙ্গে শাসন ক্ষমতা লাভ করে। এভাবে সামন্ত প্রভুর ব্যক্তিগত শাসনের ক্ষমতা গড়ে ওঠে। 

দ্বিতীয় খ্রীঃ সাতবাহন রাজারা বৌদ্ধ শ্রমণদের শাসনের ক্ষমতাসহ ভূমি দান করেন। এই জমিতে রাজকীয় সেনা, কর্মচারী, পুলিশ ঢুকবে না বলে ঘোষনা করা হয়। এইভাবে রাজার রাজস্ব আদায়, শাসনের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রবরসেন বাকাটকও অনুরূপ শর্তে ভূমি পট্টলী দান করেন। এই অর্থে খ্রীঃ দুই - তিন শতকে সামন্ত প্রথার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় তা প্রমানিত।

গুপ্তযুগের সামন্ত প্রথা

গুপ্ত যুগের ব্রহ্মদেয় ভূমি পট্টলীগুলিতে সামন্ত প্রথার লক্ষণ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

  • ১। দান করা জমিতে যে কৃষক, কারিগররা ছিল তাদের আনুগত্য ছিল দান গ্রহীতা ব্রাহ্মণের প্রতি।
  • ২। রাজকীয় কর্মচারী, সেনা, ছত্রধারীরা ব্রাহ্মণ দানগ্রহীতার ওপর কোন প্রভাব খাটাতে পারত না।
  • ৩। গ্রহীতা ব্রাহ্মণকে তার সম্পত্তিতে কোন অপরাধ অনুষ্ঠিত হলে শাস্তি দিতে পারত।
  • ৪। রাজার সাতটি অধিকারের মধ্যে কর আদায় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ছিল প্রধান। এই দুটি অধিকার এই ভূমি পট্টলীতে ব্রাহ্মণকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

 বুদ্ধ ঘোষের পালি গ্রন্থে ব্রহ্মদেয় ভূমি বলতে জমি গ্রহীতার জমির ওপর শাসন, কর ও বিচারের অধিকার বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এই প্রথার ফলে ব্যক্তিগত শাসনের অধিকার, যা হল সামন্ত প্রথার অন্যতম প্রধান লক্ষণ তা স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে।

মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর কর্তৃত্ত্ব

সামন্ত প্রথার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, প্রধান সামন্ত কর্তৃক আনুগত্যের ভিত্তিতে অধীনস্থ সামন্তকে ভূমি বন্দোবস্ত দান। যার দ্বারা মধ্যস্বত্ব প্রথার উদ্ভব ঘটে।

  • ১। ৩৯৭ খ্রীঃ স্বামীদাস লিপিতে দেখা যায় যে, মধ্যপ্রদেশে তিনি এক বণিককে তার জমি দান করার অনুমতি দিচ্ছেন।
  • 2। গুপ্ত যুগে রাজকর্মচারীদের বেতনের বদলে জায়গীর দেওয়ার প্রথা চালু হয়েছিল। জাগীর থেকে কর আদায় করে তাদের প্রাপ্য বেতন মেটাত। এরফলে ক্রমে কর আদায়ের দায়িত্ব জাগীরদার ও জমিদারদের হাতে অনেকটা চলে যায়।
  • ৩। রাজা সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে কর আদায় করতেন। ফা-হিয়েন বলেছেন যে, সাধারণ লোকেদের ঘরবাড়ী সরকারী খাতায় নথিবদ্ধ করতে হত না। এর থেকে জমি ও কৃষকের ওপর রাজার অধিকার শ্লথ হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সপ্তম খ্রীঃ হিউয়েন সাংও এটা লক্ষ্য করেন।

ভারতে জাগীর প্রথার উদ্ভব

গুপ্ত যুগের পর বেতনের পরিবর্তে জাগীর দানের প্রথা খুব বেড়ে যায়। অষ্টম খ্রীঃ আশরফপুর ফলক থেকে এটা জানা যায় একথা। মুদ্রার পরিমাণ যতই কমতে থাকে ততই জমি বেতনের পরিবর্তে দেওয়া জাগীর প্রথা বাড়তে থাকে। এই সকল জমি গ্রহীতার নাম ছিল ভোগপটিকা বা ভোগীকা। এর অর্থ হল এরা জমি ভোগ করত। ডঃ আর এস- শর্মা বলেছেন যে, কখনও কখনও একাদিক্রমে তিন পুরুষ ধরে জমি ভোগ করার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। কোন কোন ভোগ পটিকা গ্রামীণ কৃষকদের ওপর অত্যাচার করত। বাণভট্টের রচনায় একথা জানা যায়। সপ্তম খ্রীঃ মহাভোগী নামে এক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। এরা ছিল সম্ভবতঃ বড় সামন্ত।


এরপর ধীরে ধীরে জমি বংশানুক্রমে বন্দোবস্তের অধীনে চলে যায়। এই সঙ্গে শাসন ও বিচারের ক্ষমতাও বংশানুক্রমিকভাবে চলে যায়। এভাবে সামন্ত প্রথার উদ্ভব হয়। 

ভারতে সামন্ত প্রথার বৈশিষ্ট্য

  • ১। এই সময় সামন্ত প্রথার অন্যান্য লক্ষণও ক্রমে দেখা দেয়। তার মধ্যে একটি হল আনুগত্য প্রথা। ক্ষুদ্র সামন্ত তার ঊর্ধ্বতন সামন্তকে আনুগত্য, কর ও সামরিক সাহায্য দিত। সমুদ্র গুপ্ত তাঁর ধর্মবিজয় নীতির মাধ্যমে সামন্তদের নিকট এরূপ বশ্যতা নেন। 
  • ২। ষষ্ঠ শতকে সামন্ত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। পল্লব রাজারা 'সামন্ত-সুধামণি' শব্দটি ব্যবহার করতেন। মৌখরী ও মান্দাসর লিপিতেও 'সামন্ত' শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। বলভীর ষষ্ঠ খ্রীঃ লিপিতে সামন্ত মহারাজ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। 
  • ৩। বাণের কাদম্বরী নামক রচনায় অনুগত সামন্তের প্রভুকে একরকম প্রণাম দ্বারা আনুগত্য প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে মাথা নীচু করে প্রণাম জানান ছিল সর্ব প্রধান ও সর্ব প্রচলিত প্রথা; তার পর পদধূলি গ্রহণ ছিল আর একটি স্বীকৃত প্রথা। এছাড়া প্রভুর ছত্রধারণ অথবা প্রহরীর কাজ প্রভৃতিও করতে হত।
  • ৪। বিদ্রোহের পর গলায় তরবারি বা কুঠার বেঁধে প্রভুর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা ছিল আর এক ধরনের আনুগত্য জ্ঞাপন। প্রভুর সঙ্গে সামন্তের সম্পর্কের ওপরে আনুগত্যের ধরণ নির্ভর করত।

সামন্তপ্রভুর ভৃত্যদের শর্তাবলী

সকল সেবার শর্ত পালনে অঙ্গীকার করতে হত সামন্তপ্রভুর ভৃত্যদের। যথা- 

  • ১। প্রভুর মাথায় ছাতা ধরা;
  • ২। হাতে লাঠি নিয়ে প্রভুর দরজায় প্রহরীর কাজ করা;
  • ৩। প্রভুর সম্মুখে মন্ত্র উচ্চারণ করে তাঁর শুভ কামনা করা;
  • ৪। নিজ কন্যা বা ভগিনীকে প্রভুর সঙ্গে বিবাহ দান;
  • ৫। নিজ শিশুপুত্রকে প্রভুর কাছে জামিন রাখা;
  • ৬। বাণের মতে, পরাজিত শত্রু মহাসামন্তকে আরও নানা প্রকার নিগ্রহমূলক সেবা করতে হত;
  • ৭। দরবারে যে সকল সামন্ত থাকত তাদের প্রভুর ছবি আঁকা, পাশাখেলা, বাঁশী বাজান প্রভৃতি কাজ করতে হত।

রাজার প্রতি সামন্তপ্রভুর কর্তব্য

সামন্ত প্রভু ঊর্ধ্বতন প্রভুকে কর ও রাজস্ব দিতে বাধ্য ছিল: 

  • (১) নিয়মিত ভূমি কর
  • (২) যুদ্ধের সময় সেনা সাহায্য
  • (৩) অন্যান্য সেবা

রোমিলা থাপার বলেছেন যে, সামন্তরা রাজাকে কর পাঠিয়ে বাকি অর্থে সেনা পুষত এবং রাজার প্রয়োজন হলে সেই সেনা পাঠাত। কিন্তু এই মন্তব্য সাধারণীকরণ দোষে দুষ্ট। সপ্তম খ্রীঃ আগে সামরিক সেবার প্রথা ছিল না। সপ্তম খ্রীঃ থেকে সামন্ত প্রভুকে তার পদমর্যাদা অনুযায়ী হাতী ও ঘোড়া রাখতে দেওয়া হত। ৭২৭ খ্রীঃ চীনা সূত্র থেকে জানা যায় যে, এক ভারতীয় রাজার ৯০০ হাতী এবং তার সামন্তের ২০০-৩০০ হাতী ছিল।

সামন্ত ব্যবস্থায় কৃষকের অবস্থা

রোমিলা থাপারের মতে, শূদ্ররাই জমি চাষ করত এবং ফসলের একাংশ প্রভুকে দিতে বাধ্য থাকত। এই অর্থে সামন্তরা সেনাদল পুষত। ডঃ আর কে শর্মা বলেছেন যে, এই মন্তব্যের দ্বারা সামন্ত প্রথার অধীনে কৃষকদের অবস্থা পরিষ্কার বোঝা যায় না। ডঃ শর্মার মতে, কৃষকরা সামন্ত প্রভুর সম্পূর্ণ অনুগত থাকতে বাধ্য হত। প্রভু ইচ্ছামত কৃষককে উচ্ছেদ করতেন ও নতুন কৃষক বসাতেন। গুপ্ত ভূমি পট্টল্লী হতে দেখা যায় যে, গুপ্ত কৃষকদের ভিত্তি বা শ্রম দিতে হত। প্রভুরা প্রথামত শ্রম বা বেগার আদায় করত। বলভীর লিপিগুলিও এই সাক্ষ্য দেয়। কারিগর শ্রেণীর ওপর বাধ্যতামূলক বেগার আরোপ করা হত। স্মৃতিশাস্ত্রে কারিগরদের মাসে এক দিন করে শ্রম দান করতে বলা হয়েছে। ৫৯২ খ্রীঃ একটি সনদে দেখা যাচ্ছে যে, জোর করে বাধ্যতামূলক শ্রমবণিক নিগমগুলি কারিগরদের কাছে কর আদায় করত।


মৌর্য যুগে দাস ও কর্মকারদের বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হত। সামন্ত প্রথার ফলে কৃষক, কারিগরশ্রেণীকে এই শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। বাধ্যতামূলক শ্রম বা বেগারকে বলা হত সভা "ভিস্তি"। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে চাষের কাজে ব্যাপক বেগার খাটানোর কথা জানা যায়। গ্রাম প্রধানরা তাদের স্বার্থে এই বেগার খাটাত। এমন কি কৃষক রমণীরাও সুতা কাটা, বাড়ীঘরের কাজে বেগার খাটাতে বাধ্য হত। ক্ষেত্রস্বামী বা কৃষক ও কারিগররা সামন্ত প্রথার ফলে ও ভূমিদাস প্রথার ফলে ভূমিদাস বা অর্ধ দাসে পরিণত হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

No risk, just do it! With Life Insurance & Car Insurance policies!