ঠান্ডা যুদ্ধ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি: উৎপত্তি ও বৃদ্ধি, জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক বিরোধ, তৃতীয় বিশ্বের উত্থান ও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন || Cold War & Global scenario: Origins and Growth of Cold War, UNO and global disputes (Korea, Congo, Cuban crisis), Emergence of Third World and NAM, Collapse of Soviet Union
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) পর বিশ্ব রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়, তারই ফলশ্রুতি হলো ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold War)। এই যুদ্ধ কোনো প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘাত ছিল না, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (পুঁজিবাদী গণতন্ত্র) ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র) এর নেতৃত্বে দুটি বিপরীত মতাদর্শ ও ক্ষমতা ব্লকের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শগত ও প্রক্সি যুদ্ধ (proxy war) ছিল।
#### ১. ঠান্ডা যুদ্ধের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি (Origins and Growth of Cold War)
ক. উৎপত্তি ও কারণসমূহ:
* আদর্শগত সংঘাত: পুঁজিবাদ ও গণতান্ত্রিক আদর্শ বনাম সাম্যবাদ ও একদলীয় শাসন। উভয় পক্ষই নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিল।
* ক্ষমতার শূন্যতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি, জাপান ও ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় শক্তিগুলোর দুর্বল হয়ে পড়ায় সৃষ্ট ক্ষমতার শূন্যতা পূরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসে।
* পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়া (১৯৪৫) এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়নেরও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়া (১৯৪৯) উভয় পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস ও অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বাড়ায়। (আর্মস রেস)।
* যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর পুনর্বিন্যাস: মিত্রশক্তির মধ্যে জার্মানি, কোরিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে মতভেদ।
* চার্চিলের 'লৌহ যবনিকা' বক্তৃতা (Iron Curtain Speech): ১৯৪৬ সালের ৫ মার্চ উইনস্টন চার্চিল তার বক্তৃতায় ইউরোপকে দুটি ব্লকে ভাগ করার কথা বলেন, যা বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়।
খ. ঠান্ডা যুদ্ধের মূল ঘটনাসমূহ ও বৃদ্ধি:
1. ট্রুম্যান নীতি (Truman Doctrine, ১৯৪৭): মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান ঘোষণা করেন যে, বিশ্বের যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সাম্যবাদী আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করবে। এটি ছিল সোভিয়েত প্রভাব প্রতিরোধের (Containment Policy) প্রথম পদক্ষেপ। গ্রীস ও তুরস্কে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠানো হয়।
2. মার্শাল পরিকল্পনা (Marshall Plan, ১৯৪৭): মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ মার্শাল ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বিশাল আর্থিক সাহায্য প্রস্তাব করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপে সাম্যবাদের প্রসার রোধ করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগামীরা এই সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে।
3. কমিনফর্ম (Cominform, ১৯৪৭): মার্শাল পরিকল্পনার বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অনুগামী কমিউনিস্ট দলগুলোকে নিয়ে 'কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরো' বা কমিনফর্ম গঠন করে।
4. বার্লিন অবরোধ (Berlin Blockade, ১৯৪৮-৪৯): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি চারটি মিত্রশক্তির অধীনে বিভক্ত হয়। বার্লিনও একইভাবে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম বার্লিনের সাথে সমস্ত স্থল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বিমানপথে রসদ সরবরাহ করে (Berlin Airlift)। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়। এটি ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের প্রথম বড় সংঘাত।
5. ন্যাটো (NATO - North Atlantic Treaty Organization, ১৯৪৯): সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ১২টি দেশ নিয়ে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়।
6. ওয়ারশ চুক্তি (Warsaw Pact, ১৯৫৫): ন্যাটোর পাল্টা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের আটটি সমাজতান্ত্রিক দেশ এই সামরিক জোট গঠন করে।
7. পারমাণবিক প্রতিবন্ধকতা (Nuclear Deterrence): উভয় পক্ষই নিজেদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপুল মজুত গড়ে তোলে, এই ধারণায় যে প্রতিপক্ষ আক্রমণ করলে তারাও ধ্বংসাত্মক পাল্টা আক্রমণ করবে। এর ফলে কোনো পক্ষই সরাসরি যুদ্ধ করার সাহস দেখায়নি (Mutual Assured Destruction - MAD)।
8. স্পুটনিক উৎক্ষেপণ (Sputnik, ১৯৫৭): সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক উৎক্ষেপণ মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন প্রতিযোগিতা (Space Race) শুরু করে।
9. বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ (Berlin Wall, ১৯৬১): পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের পশ্চিমে অভিবাসন ঠেকাতে সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট পূর্ব জার্মানি সরকার বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ করে, যা ঠান্ডা যুদ্ধের অন্যতম প্রতীক হয়ে ওঠে।
#### ২. জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক বিরোধ (UNO and Global Disputes)
জাতিসংঘ (United Nations Organization - UNO) ১৯৪৫ সালে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এর কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা পরিষদে দুই পরাশক্তির ভেটো ক্ষমতা প্রায়শই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিত। তবে কিছু ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বিবাদ মীমাংসা বা মানবিক সহায়তা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ক. কোরীয় যুদ্ধ (Korean War, ১৯৫০-১৯৫৩):
* কারণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়াকে ৩৮তম অক্ষরেখা বরাবর উত্তর (সোভিয়েত সমর্থিত কমিউনিস্ট) ও দক্ষিণ (মার্কিন সমর্থিত গণতান্ত্রিক) কোরিয়ায় ভাগ করা হয়। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
* ঘটনা:
* উত্তর কোরিয়ার আক্রমণের পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দ্রুত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্যের আহ্বান জানায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসময় নিরাপত্তা পরিষদে অনুপস্থিত থাকায় ভেটো প্রয়োগ করতে পারেনি।
* মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জাতিসংঘের বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থনে যুদ্ধ শুরু করে। জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান।
* জাতিসংঘ বাহিনী উত্তর কোরিয়াকে প্রায় পরাজিত করে চীন সীমান্তে পৌঁছালে চীন উত্তর কোরিয়ার সমর্থনে যুদ্ধে অংশ নেয়।
* যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ৩৮তম অক্ষরেখা বরাবর এক অচলাবস্থায় পৌঁছে।
* ফলাফল ও তাৎপর্য:
* ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়, কিন্তু কোনো শান্তি চুক্তি হয়নি। কোরিয়া আজও বিভক্ত।
* ঠান্ডা যুদ্ধের প্রথম বড় "প্রক্সি যুদ্ধ" (Proxy War)।
* জাতিসংঘের কার্যকারিতা প্রদর্শিত হয়, যদিও চীনের হস্তক্ষেপ যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়।
* পূর্ব এশিয়ায় ঠান্ডা যুদ্ধের বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়।
খ. কঙ্গো সংকট (Congo Crisis, ১৯৬০-১৯৬৫):
* কারণ: ১৯৬০ সালে বেলজিয়ামের উপনিবেশ কঙ্গো স্বাধীনতা লাভ করার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল (বিশেষত খনিজ-সমৃদ্ধ কাটানগা প্রদেশ) বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে এক গুরুতর রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা ও রাষ্ট্রপতি ক্যাসাবুভুর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
* ঘটনা:
* লুমুম্বা বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে জাতিসংঘের সাহায্য চান। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন (ONUC) কঙ্গোতে পাঠানো হয়।
* ঠান্ডা যুদ্ধের দুই পরাশক্তি এই সংকটে জড়িয়ে পড়ে। লুমুম্বা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিরা তার বিরোধিতা করে।
* লুমুম্বা সেনাবাহিনী প্রধান মোবুতু সেসে সেকোর হাতে ক্ষমতাচ্যুত ও পরে খুন হন (১৯৬১)।
* মোবুতু পশ্চিমা সমর্থন নিয়ে কঙ্গোর নিয়ন্ত্রণ নেন এবং দীর্ঘকাল কঙ্গোর শাসক হিসেবে টিকে থাকেন।
* ফলাফল ও তাৎপর্য:
* নতুন স্বাধীন দেশগুলিতে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব ও পরাশক্তির হস্তক্ষেপের উদাহরণ।
* জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা কার্যক্রমের জটিলতা ও সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পায়।
* আফ্রিকার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উপনিবেশমুক্ত দেশগুলিতে ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতীক।
গ. কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকট (Cuban Missile Crisis, ১৯৬২):
* কারণ: ১৯৫৯ সালের কিউবান বিপ্লবের পর ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে কমিউনিস্ট প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করে (যেমন: বে অফ পিগস আক্রমণ, ১৯৬১)। এর প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে।
* ঘটনা:
* ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন গোয়েন্দা বিমান কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণের ছবি প্রকাশ করে।
* মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি কিউবা অবরোধের (Naval Blockade) নির্দেশ দেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিতে চরমপত্র দেন।
* ১৩ দিন ধরে বিশ্বের ইতিহাসে পারমাণবিক যুদ্ধের সবচেয়ে কাছাকাছি পরিস্থিতি তৈরি হয়।
* সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ শেষ পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিতে রাজি হন, বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা আক্রমণ না করার এবং তুরস্ক থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার গোপন প্রতিশ্রুতি দেয়।
* ফলাফল ও তাৎপর্য:
* ঠান্ডা যুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত, যা প্রায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা পারমাণবিক যুদ্ধের জন্ম দিতে পারত।
* উভয় পরাশক্তির মধ্যে সরাসরি আলোচনার (হটলাইন) প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
* ভবিষ্যতে সরাসরি সংঘাত এড়াতে "ডেটঁত" (Détente) বা উত্তেজনা প্রশমনের নীতির সূচনা হয়।
#### ৩. তৃতীয় বিশ্বের উত্থান ও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (Emergence of Third World and NAM)
ক. তৃতীয় বিশ্বের ধারণা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বা উন্নয়নশীল দেশগুলি কোনো পরাশক্তির ব্লকে (প্রথম বিশ্ব: মার্কিন ব্লক; দ্বিতীয় বিশ্ব: সোভিয়েত ব্লক) যোগ না দিয়ে নিজস্ব স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের চেষ্টা করে। এই দেশগুলি "তৃতীয় বিশ্ব" নামে পরিচিতি লাভ করে।
খ. জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-Aligned Movement - NAM):
* উৎপত্তি ও লক্ষ্য: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি ঠান্ডা যুদ্ধের বিভাজন থেকে নিজেদের দূরে রেখে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সম্মিলিত মঞ্চ তৈরি করে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল:
* পরাশক্তিগুলোর সামরিক জোটে যোগ না দেওয়া।
* ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা।
* বর্ণবৈষম্যবাদের নিন্দা করা।
* নিরস্ত্রীকরণ ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা।
* উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।
* প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দ:
* জওহরলাল নেহেরু (ভারত)
* গামাল আবদেল নাসের (মিশর)
* মার্শাল টিটো (যুগোস্লাভিয়া)
* সুকর্ণো (ইন্দোনেশিয়া)
* কোয়ামে নক্রুমা (ঘানা)
* গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন:
* বান্দুং সম্মেলন (Bandung Conference, ১৯৫৫): এই সম্মেলনকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর বলা হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশ এখানে মিলিত হয়ে পঞ্চশীল নীতির (শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান) উপর জোর দেয়।
* বেলগ্রেড সম্মেলন (Belgrade Conference, ১৯৬১): এই সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (NAM) গঠিত হয়।
* তাৎপর্য:
* ঠান্ডা যুদ্ধের মেরুকৃত বিশ্বে একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর তৈরি করে।
* জাতিসংঘে উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করে।
* উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামকে সমর্থন করে।
* যদিও এর অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তি ছিল না, এটি নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
#### ৪. সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন (Collapse of the Soviet Union)
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন (১৯৯১) ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি এবং বিশ্ব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।
ক. পতনের কারণসমূহ:
1. অর্থনৈতিক স্থবিরতা:
* কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি (কমান্ড ইকোনমি) অদক্ষ ছিল এবং জন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়।
* প্রতিরক্ষা খাতে অত্যধিক ব্যয় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ত্রের প্রতিযোগিতার কারণে)।
* প্রযুক্তিগত দিক থেকে পশ্চিমের তুলনায় পিছিয়ে পড়া।
* কৃষি উৎপাদন ছিল অপর্যাপ্ত।
2. রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও অসন্তোষ:
* একদলীয় শাসন, ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাব ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি করে।
* গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বৃদ্ধি।
3. জাতীয়তাবাদী উত্থান: সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে (যেমন: বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ, ইউক্রেন, জর্জিয়া) স্বাধীনতার দাবি জোরালো হয়।
4. আফগান যুদ্ধ (Soviet-Afghan War, ১৯৭৯-১৯৮৯): আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের দীর্ঘ সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল ব্যয়বহুল ও ব্যর্থ। এতে হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয় এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়।
5. মিখাইল গর্বাচেভের সংস্কার (Gorbachev's Reforms, ১৯৮৫-১৯৯১):
* গ্লাসনস্ত (Glasnost - Openness): রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অধিক স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতার নীতি।
* পেরেস্ত্রোইকা (Perestroika - Restructuring): অর্থনীতির সংস্কার ও বাজারমুখী করার চেষ্টা।
* এই সংস্কারগুলি শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলি প্রকাশ করে দেয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
6. পূর্ব ইউরোপের বিপ্লবসমূহ (১৯৮৯): পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে (যেমন: পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া) গণঅভ্যুত্থান হয় এবং কমিউনিস্ট শাসন ভেঙে পড়ে। বার্লিন প্রাচীরের পতন (১৯৮৯) এর একটি বড় প্রতীকী ঘটনা ছিল।
7. ১৯৯১ সালের অভ্যুত্থান ব্যর্থতা: রক্ষণশীল কমিউনিস্টরা গর্বাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
খ. পতনের ফলাফল:
* ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি: ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে গেলে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
* নতুন রাষ্ট্রের জন্ম: ১৫টি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের (যেমন: রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, কাজাখস্তান, লিথুয়ানিয়া ইত্যাদি) জন্ম হয়।
* একমেরু বিশ্ব: বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
* অর্থনৈতিক পরিবর্তন: অনেক দেশ বাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়।
* জাতিসংঘের ভূমিকা বৃদ্ধি: দুই পরাশক্তির ভেটোর কারণে এতদিন জাতিসংঘের ভূমিকা সীমিত থাকলেও, এখন বিশ্ব শান্তি রক্ষায় এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।