হরপ্পা সভ্যতা যা সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে উন্নত সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ১৯০০ অব্দের মধ্যে এর বিস্তার ছিল। এই সভ্যতা মূলত সিন্ধু নদ এবং তার উপনদীগুলির অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল। ১৯২০-এর দশকে এর আবিষ্কার বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল, কারণ এর আগে মনে করা হত যে ভারতে এত প্রাচীন কোনো নগর সভ্যতা ছিল না। এই প্রবন্ধে আমরা হরপ্পা সভ্যতার প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলি, সেগুলির আবিষ্কারক, আবিষ্কারের সাল এবং সংশ্লিষ্ট নদীগুলির তৎকালীন ও বর্তমান নাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হরপ্পা সভ্যতা পরিচিতি
হরপ্পা সভ্যতা ছিল একটি সুপরিকল্পিত নগর সভ্যতা। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
- নগর পরিকল্পনা: সুপরিকল্পিত রাস্তা, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং দুর্গ ও নিম্ননগরীর বিভাজন।
- স্থাপত্য: পোড়া ইঁটের ব্যবহার, বিশাল শস্যাগার এবং জন স্নানাগার (যেমন মহেঞ্জোদারোর বৃহৎ স্নানাগার)।
- অর্থনীতি: কৃষি (গম, বার্লি, ডাল), পশুপালন (গরু, মহিষ, ভেড়া), এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য (মেসোপটেমিয়ার সাথে)।
- শিল্পকলা: পোড়ামাটির মূর্তি, সিলমোহর (যার উপর বিভিন্ন প্রাণী ও লিপির চিত্র খোদাই করা থাকত), মৃৎশিল্প, ধাতুবিদ্যা (তামা, ব্রোঞ্জ)।
- লিপি: একটি চিত্রলিপি ব্যবহার করত যা আজও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এই সভ্যতা হঠাৎ করেই খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০ অব্দের আশেপাশে বিলুপ্ত হয়ে যায়, যার কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে (যেমন: জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, আর্য আক্রমণ ইত্যাদি)।
হরপ্পা সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র, আবিষ্কারক, সাল ও নদীর তালিকা
হরপ্পা সভ্যতার অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে কিছু প্রধান কেন্দ্রের তথ্য নিচে সারণী আকারে দেওয়া হলো:
| হরপ্পা | দয়ারাম সাহানি | ১৯২১ | ইরাবতী (রাভি) / বর্তমান রাভি | সিন্ধু সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত স্থান। এটি 'আধা-শহুরে' বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিল। এখানে শস্যাগার, দুর্গ, ও কর্মী আবাসনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। |
| মহেঞ্জোদারো | রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৯২২ | সিন্ধু / সিন্ধু | সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সুপরিকল্পিত নগরী। 'মৃতের স্তূপ' নামে পরিচিত। এখানে সুবিশাল স্নানাগার ('Great Bath'), শস্যাগার, অ্যাসেম্বলি হল, এবং ব্রোঞ্জের নর্তকী মূর্তি পাওয়া গেছে। |
| লোথাল | এস. আর. রাও | ১৯৫৪ | ভোগাবো (সাতাবরমতি নদীর উপনদী) / বর্তমান ভোগাবো | গুজরাটে অবস্থিত। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী। এখানে একটি কৃত্রিম পোতাশ্রয় (ডকইয়ার্ড) এবং ধান চাষের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অগ্নিকুণ্ডের (Fire Altar) নিদর্শনও মেলে। |
| কালিবঙ্গান | বি. বি. লাল ও বি. কে. থাপার | ১৯৫৩ | ঘাগর-হাকরা (প্রাচীন সরস্বতী নদীর শুষ্ক খাত) / বর্তমান ঘাগর | রাজস্থানে অবস্থিত। 'কালো চুড়ি' নামে পরিচিত। এখানে কর্ষিত জমির প্রাচীনতম প্রমাণ, অগ্নিকুণ্ড, এবং উটের হাড়ের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দুটি ভিন্ন সভ্যতার স্তরের প্রমাণ মেলে। |
| রোপার | ওয়াই. ডি. শর্মা | ১৯৫৩ | শতদ্রু (সুতলেজ) / বর্তমান সুতলেজ | পাঞ্জাবে অবস্থিত। এখানে একটি কবরের মধ্যে কুকুরসহ মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যা পরবর্তীকালের নিওলিথিক বুর্জোম কেন্দ্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। |
| ধোলাভিরা | আর. এস. বিষ্ট | ১৯৬৭-৬৮ (খনন ১৯৯০ থেকে) | লুনি (মৌসুমি নদী) / বর্তমান লুনি | গুজরাটে অবস্থিত। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম বৃহত্তম কেন্দ্র। এখানে তিনটি ভাগে বিভক্ত নগরী (দুর্গ, মধ্যনগরী, নিম্ননগরী), একটি বিশাল জলাধার, এবং জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নত নিদর্শন পাওয়া গেছে। |
| বানাওয়ালি | আর. এস. বিষ্ট | ১৯৭৪ | ঘাগর-হাকরা (প্রাচীন সরস্বতী নদীর শুষ্ক খাত) / বর্তমান ঘাগর | হরিয়ানায় অবস্থিত। এখানে গোলাকার ও ওভাল আকৃতির বাড়ি এবং বার্লির চাষের প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাস্তাগুলি রেডিয়াল প্যাটার্নে তৈরি ছিল। |
| রাখিগাড়ি | সুরজ ভান (১৯৬৯), অমরেন্দ্র নাথ (১৯৯৭-২০০০) | ১৯৬৯ (প্রথম অনুসন্ধান) | ঘাগর-হাকরা (প্রাচীন সরস্বতী নদীর শুষ্ক খাত) / বর্তমান ঘাগর | হরিয়ানায় অবস্থিত। এটি সিন্ধু সভ্যতার ভারতীয় অংশের বৃহত্তম কেন্দ্র (কেউ কেউ মহেঞ্জোদারোকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন)। এখানে দুর্গ, বসতি, রাস্তা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এবং মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে। |
| চানহুদারো | এন. জি. মজুমদার (আবিষ্কার), ই. জে. এইচ. ম্যাকাই (খনন) | ১৯৩১ | সিন্ধু / সিন্ধু | সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত। এটি ছিল একমাত্র হরপ্পা শহর যেখানে কোনো দুর্গ ছিল না। এটি পুঁতি তৈরি এবং সীলের উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য বিখ্যাত ছিল। |