ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক প্রতিরোধ: ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ

ইতিহাস সিলেবাসের "ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক প্রতিরোধ: ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ" অংশটির উপর বিস্তারিত নোট দেওয়া হলো।

### ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক প্রতিরোধ: ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ || Early resistance to the British rule: Wahabi and Farazi movements, Santal Rebellion, The Revolt of 1857


ভূমিকা:

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তার ও অর্থনৈতিক শোষণের ফলে উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন অংশে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই প্রতিরোধগুলি কখনও ছিল ধর্মীয় সংস্কারের মোড়কে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, কখনও কৃষক ও আদিবাসীদের বিদ্রোহ, আবার কখনও তা সিপাহি বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই আন্দোলনগুলি পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।


#### ১. ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement)

* উৎপত্তি ও আদর্শ:

    * ইসলাম ধর্মের সংস্কার ও শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্যে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। এর আদর্শ ছিল আরবের আবদুল ওয়াহাবের (Abdul Wahab) প্রচারিত মতবাদ এবং ভারতের শাহ ওয়ালিউল্লাহর (Shah Waliullah) চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত।

    * মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির সৈয়দ আহমেদ (Syed Ahmed of Rai Bareilly)। তিনি নিজেকে "আমির-উল-মুমিনিন" (বিশ্বাসীদের নেতা) ঘোষণা করেন।

    * লক্ষ্য ছিল ইসলামের কুসংস্কার দূর করে তার আদি শুদ্ধ রূপ ফিরিয়ে আনা এবং বিদেশি শাসনের অবসান ঘটিয়ে 'দার-উল-ইসলাম' (ইসলামের ভূমি) প্রতিষ্ঠা করা।


* বিস্তার:

    * সৈয়দ আহমেদ প্রথমে পাঞ্জাবে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন, কারণ শিখরা মুসলিমদের উপর অত্যাচার করত বলে তাঁর অভিযোগ ছিল।

    * তাঁর মৃত্যুর পর আন্দোলনটি বাংলায় ব্যাপক প্রসার লাভ করে।

    * বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন: বাংলায় এই আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমীর (Titu Mir) বা মীর নিসার আলী।

    * তিতুমীর প্রাথমিকভাবে নারকেলবেড়িয়া অঞ্চলে জমিদার ও নীলকরদের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করেন। তিনি জমিদারদের ইজারা নেওয়া ভূমির খাজনা বন্ধের ডাক দেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন।

    * বাঁশের কেল্লা (Bamboo Fort): ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিতুমীর নারকেলবেড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ব্রিটিশ বাহিনী কামানের সাহায্যে এই কেল্লা ধ্বংস করে এবং তিতুমীর নিহত হন।


* গুরুত্ব:

    * ধর্মীয় আন্দোলন হলেও এর একটি শক্তিশালী কৃষক-বিদ্রোহের চরিত্র ছিল, যা জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে প্রকাশ করেছিল।

    * এটি পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থানে পরোক্ষ প্রভাব ফেলেছিল।


#### ২. ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement)

* উৎপত্তি ও আদর্শ:

    * ফরাজি আন্দোলনের সূচনা হয় পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজী শরিয়তউল্লাহ (Haji Shariatullah)।

    * 'ফরাজি' শব্দটি 'ফরজ' (ইসলামের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) থেকে এসেছে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের প্রকৃত আদর্শে ফিরে আসা এবং মুসলিম সমাজে প্রচলিত শিরক ও বিদ'আত (আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করা বা প্রচলিত কুসংস্কার) দূর করা।

    * তারা ইসলামি আইনের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চেয়েছিল।


* বিস্তার ও চরিত্র:

    * হাজী শরিয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিয়াঁ (Dudu Mian) বা মুহম্মদ মহসিন এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

    * দুদু মিয়াঁ আন্দোলনকে কৃষক বিদ্রোহের দিকে নিয়ে যান। তিনি ঘোষণা করেন "জমিন আল্লাহর" (Land belongs to God), অর্থাৎ জমি আল্লাহর সম্পত্তি, তাই এর উপর কারো জমিদারির অধিকার নেই এবং খাজনা নেওয়া অবৈধ।

    * তিনি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং তাদের খাজনা বন্ধের নির্দেশ দেন। তিনি নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা ও সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন।

    * ফরাজিরা মূলত নিম্নবর্গের মুসলিম কৃষক ও তাঁতিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে।


* গুরুত্ব:

    * এটি ছিল একটি শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন যা জমিদারী প্রথা ও ব্রিটিশ শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।

    * কৃষকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে এটি সাহায্য করে।

    * ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ছিল এই আন্দোলন।


#### ৩. সাঁওতাল বিদ্রোহ (Santal Rebellion / Santal Hul)

* সময়কাল: ১৮৫৫-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ।

* অঞ্চল: বিহারের ভাগলপুর থেকে উড়িষ্যার কটক পর্যন্ত বিস্তৃত দামিন-ই-কোহ (রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশ)।

* কারণসমূহ:

    * ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা: ব্রিটিশদের প্রবর্তিত নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সাঁওতালদের চিরাচরিত গোষ্ঠীভিত্তিক জীবনযাত্রা ও জমির অধিকার কেড়ে নেয়। তাদের উপর উচ্চহারে খাজনা ধার্য করা হয়।

    * শোষক শ্রেণী ('দিকু'): বহিরাগত মহাজন, ব্যবসায়ী, জমিদার, পুলিশ এবং সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা সাঁওতালরা চরমভাবে শোষিত হত। এদেরকে সাঁওতালরা 'দিকু' (বহিরাগত শোষক) বলত।

    * দাদন প্রথা ও উচ্চ সুদ: মহাজনরা চড়া সুদে (কখনও কখনও সুদের হার ৫০০%-এর বেশি) সাঁওতালদের ঋণ দিত এবং ঋণ পরিশোধ না হলে তাদের জমি ও সম্পত্তি কেড়ে নিত।

    * বেগার শ্রম: রেললাইন নির্মাণ, রাস্তা তৈরি ইত্যাদির জন্য সাঁওতালদের জোর করে বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা হত।

    * বিচারহীনতা: ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থা সাঁওতালদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করত। পুলিশ ও প্রশাসনের মদতে 'দিকু'দের অত্যাচার বাড়ত।


* নেতৃত্ব: সিধু, কানু, চাঁদ এবং ভৈরব - এই চার ভাই ছিলেন বিদ্রোহের প্রধান নেতা।

* বিদ্রোহের গতিপথ:

    * ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন ভাগনাডিহিতে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল একত্রিত হয়ে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে এবং সিধু নিজেকে 'ঠাকুরের নির্দেশপ্রাপ্ত' বলে দাবি করেন।

    * বিদ্রোহ দ্রুত গতিতে দামিন-ই-কোহ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারা মহাজন, জমিদার, পুলিশ স্টেশন, রেল স্টেশন ও নীলকুঠি আক্রমণ করে।

    * ব্রিটিশ সরকার প্রথমে স্থানীয় পুলিশ দিয়ে দমন করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। পরে বিপুল সংখ্যক সেনা ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহ দমন করা হয়।

    * ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়। সিধু ও কানু সহ হাজার হাজার সাঁওতাল নিহত হয়।


* গুরুত্ব ও ফলাফল:

    * বিদ্রোহ দমন হলেও ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের অসন্তোষের কারণ উপলব্ধি করে।

    * সাঁওতালদের জন্য একটি পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল সাঁওতাল পরগনা (Santal Parganas) গঠিত হয় (১৮৫৫)।

    * সাঁওতালদের জমি বিক্রি ও হস্তান্তর সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যাতে 'দিকু'রা তাদের জমি দখল করতে না পারে।

    * এটি ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।


#### ৪. ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ (The Revolt of 1857)

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ভারতীয় ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ব্যাপক ও সংগঠিত সশস্ত্র প্রতিরোধ হিসেবে চিহ্নিত।


* ক. উৎপত্তি (Genesis / Causes):

    ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের কারণগুলি ছিল সুদূরপ্রসারী এবং বহুমাত্রিক।


    * রাজনৈতিক কারণ:

        * স্বত্ববিলোপ নীতি (Doctrine of Lapse): লর্ড ডালহৌসি এই নীতির মাধ্যমে সাতারা, সম্বলপুর, ঝাঁসি, নাগপুর, উদয়পুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যগুলিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এটি দেশীয় রাজাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

        * অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি (Subsidiary Alliance): লর্ড ওয়েলেসলি কর্তৃক প্রবর্তিত এই নীতির মাধ্যমে বহু রাজ্য তাদের স্বাধীনতা হারায়।

        * বাংলা ও অযোধ্যা দখল: নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা (আওধ) দখল (১৮৫৬) স্থানীয় অভিজাত, সিপাহি ও জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

        * পেনশন বন্ধ: পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর দত্তক পুত্র নানা সাহেবের পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পর বংশধরদের 'সম্রাট' উপাধি ব্যবহারের অধিকার বাতিল করা হয়।

        * মুঘলদের মর্যাদা খর্ব: ব্রিটিশরা মুঘল সম্রাটকে শুধুমাত্র দিল্লির লালকেল্লার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তাঁর সম্মান ক্ষুণ্ন করে।


    * অর্থনৈতিক কারণ:

        * ভূমি রাজস্ব নীতি: ব্রিটিশদের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি, মহালওয়ারি বন্দোবস্ত কৃষকদের উপর ব্যাপক করের বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং তাদের দারিদ্র্য বাড়ায়।

        * ভারতীয় শিল্পের অবক্ষয়: ব্রিটিশ পণ্য ভারতীয় বাজার দখল করায় স্থানীয় তাঁত, হস্তশিল্প, কারুশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ শিল্পী ও কারিগর বেকার হয়ে পড়ে।

        * সম্পদের নিষ্কাশন (Drain of Wealth): দাদাভাই নৌরজি এই তত্বের মাধ্যমে দেখান যে ভারত থেকে সম্পদ ব্রিটেনে পাচার হচ্ছে, যার ফলে ভারতের দারিদ্র্য বাড়ছে।

        * বেকারত্ব ও দুর্ভিক্ষ: ব্রিটিশ নীতিগুলির কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয় এবং ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।


    * সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ:

        * ধর্মীয় সংস্কার: সতীদাহ প্রথা রদ (১৮২৯), বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬) পাশ ইত্যাদি সংস্কারগুলি রক্ষণশীল ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।

        * খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ: মিশনারিদের ধর্মীয় প্রচার, দরিদ্রদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা এবং সরকারি স্কুলে বাইবেল পাঠের উদ্যোগ ভারতীয়দের মনে ভয়ের সঞ্চার করে।

        * পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব: রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জীবনযাত্রার প্রচলন ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়।

        * জাতিগত বৈষম্য: ব্রিটিশরা ভারতীয়দের প্রতি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব পোষণ করত এবং তাদের "কালা" বলে অভিহিত করত।


    * সামরিক কারণ:

        * সিপাহিদের অসন্তোষ: সিপাহিদের বেতন, ভাতা ও পদোন্নতিতে বৈষম্য ছিল। ভারতীয় সিপাহিদের তুলনায় ইউরোপীয় সিপাহিদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি ছিল।

        * "পগারি" প্রথা: শিখ সিপাহিদের দাড়ি-গোঁফ কাটতে বলা, যা তাদের ধর্মীয় অনুভূতির পরিপন্থী ছিল।

        * জেনারেল সার্ভিস এনলিস্টমেন্ট অ্যাক্ট (General Service Enlistment Act), ১৮৫৬: এই আইন অনুযায়ী সিপাহিদের প্রয়োজনে সমুদ্রপথেও যুদ্ধ করতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, যা হিন্দু ধর্মানুসারে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ ছিল।

        * রাজনৈতিক পদমর্যাদাচ্যুতি: সিপাহিরা পূর্বে নবাব ও রাজাদের বাহিনীতে উচ্চ পদে কাজ করতে পারত, কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে তাদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত ছিল।


    * প্রত্যক্ষ কারণ:

        * এনফিল্ড রাইফেলের টোটা: নতুন এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই কার্তুজ মুখে কেটে রাইফেলের লোড করতে হত, যা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সিপাহিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে।

        * মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহ: ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে নামক এক সিপাহি এই কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে এবং ব্রিটিশ অফিসারকে গুলি করে। তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই ঘটনা বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেয়।

        * মিরাটের বিদ্রোহ: ১৮৫৭ সালের ১০ই মে মিরাটের সিপাহিরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তাদের অফিসারদের হত্যা করে। তারা দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করে।


* খ. গতিপথ (Course):

    মিরাটের বিদ্রোহীরা ১১ই মে দিল্লিতে পৌঁছে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে তাদের নেতা ঘোষণা করে। বিদ্রোহ দ্রুত ভারতের উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।


    * দিল্লি: নামমাত্র নেতা - দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ; প্রকৃত নেতা - বখত খান। ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লি পুনরুদ্ধার করে।

    * কানপুর: নেতা - নানা সাহেব (পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র) ও তাঁর সেনাপতি তাঁতিয়া টোপি। ১৮৫৭ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশরা কানপুর পুনরুদ্ধার করে।

    * লখনউ (আওধ): নেতা - বেগম হজরত মহল (আওধের নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের স্ত্রী)। ব্রিটিশরা ১৮৫৮ সালের মার্চে লখনউ পুনরুদ্ধার করে।

    * ঝাঁসি: নেতা - রানি লক্ষ্মীবাঈ। তিনি বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং গোয়ালিয়রের পতনের পর ব্রিটিশ সেনাপতি হিউ রোজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৮৫৮ সালের জুনে নিহত হন।

    * ফৈজাবাদ: নেতা - মৌলভী আহমদুল্লাহ।

    * বিহার (জগদীশপুর): নেতা - কুনওয়ার সিং (একজন বয়স্ক জমিদার)।


    ব্রিটিশরা নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। লর্ড ক্যানিং ছিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেল। ব্রিটিশ সেনাপতিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - হিউ রোজ, জন নিকলসন, স্যার কলিন ক্যাম্পবেল, হেনরি হ্যাভলক, জেমস আউটরাম, জন লরেন্স।


* গ. চরিত্র (Character):

    ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।


    * সিপাহি বিদ্রোহ (Sepoy Mutiny):

        * জন লরেন্স, সীলি, রবার্টস, মালিসন, জেমস আউটরাম প্রমুখ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা এটিকে শুধুমাত্র সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।

        * যুক্তি: বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহিদের দ্বারা শুরু হয়েছিল এবং এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক অসন্তোষ দূর করা। এতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা সাধারণ জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল না। এটি ভারতের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল (উত্তর ভারত) জুড়ে সীমাবদ্ধ ছিল।


    * সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া (Feudal Reaction):

        * রজনী পাম দত্ত, আর. সি. মজুমদার (প্রথমদিকে), এস. এন. সেন প্রমুখের মতে, এটি মূলত ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক শক্তির একটি প্রচেষ্টা ছিল তাদের ক্ষমতা ও বিশেষাধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য।

        * যুক্তি: বিদ্রোহের নেতারা (নানা সাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, কুনওয়ার সিং) নিজ নিজ হারানো রাজ্য বা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করেছিলেন। এর পেছনে কোনো সুসংগঠিত জাতীয়তাবাদী আদর্শ ছিল না।


    * প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ (First War of Independence):

        * বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর "The Indian War of Independence, 1857" গ্রন্থে এটিকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন।

        * যুক্তি: বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল। এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সম্মিলিত প্রতিরোধ। এর উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা। এটি ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক উন্মেষ ঘটায়।

        * আর্থার ডাফ, বেঞ্জামিন ডিজরেলিও এই মত সমর্থন করেন।


    * জাতীয় বিদ্রোহ (National Revolt):

        * কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, ডিজরেলি প্রমুখ এটিকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।

        * যুক্তি: যদিও বিদ্রোহের প্রকৃতি ছিল স্থানীয় ও আঞ্চলিক, তবুও এর পেছনে জনগণের ব্যাপক অসন্তোষ কাজ করেছিল এবং এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক গণবিক্ষোভের রূপ নিয়েছিল।


    * মিশ্র প্রকৃতি: আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই বিদ্রোহকে একটি জটিল ও মিশ্র প্রকৃতির ঘটনা হিসেবে দেখেন। এটি শুধুমাত্র সিপাহি বিদ্রোহ ছিল না, আবার এটি সম্পূর্ণরূপে সংগঠিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও ছিল না। এতে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এটি ছিল একটি গণবিদ্রোহ যেখানে সিপাহিরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল এবং যার পেছনে বিভিন্ন স্তরের মানুষের ক্ষোভ কাজ করেছিল।


* ঘ. ব্যর্থতার কারণ (Causes of Failure):

    * নেতৃত্বের অভাব ও বিভাজন: বিদ্রোহের কোনো একক, সুসংগঠিত ও দূরদর্শী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। বিভিন্ন নেতার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন (যেমন, নানা সাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, কুনওয়ার সিং প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থ পূরণের জন্য লড়েছিলেন)।

    * সীমিত বিস্তার: বিদ্রোহ মূলত উত্তর ভারত এবং মধ্য ভারতের কিছু অংশে সীমাবদ্ধ ছিল। দক্ষিণ ভারত, পাঞ্জাব, বাংলা ও মারাঠা অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এই বিদ্রোহে যোগ দেয়নি।

    * আধুনিক অস্ত্রের অভাব: বিদ্রোহীদের কাছে ব্রিটিশদের মতো উন্নত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। তাদের যুদ্ধ কৌশলও ছিল সেকেলে।

    * যোগাযোগের অভাব: বিদ্রোহীদের মধ্যে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তারা একযোগে ব্রিটিশদের আক্রমণ করতে পারেনি।

    * আর্থিক দুর্বলতা: বিদ্রোহীদের পর্যাপ্ত রসদ, গোলাবারুদ ও আর্থিক সংস্থান ছিল না।

    * ব্রিটিশদের উন্নত সামরিক শক্তি: ব্রিটিশদের সুসংগঠিত, সুপ্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনী ছিল। তাদের উন্নত পরিবহন (রেল) ও যোগাযোগ (টেলিগ্রাফ) ব্যবস্থা বিদ্রোহ দমনে সহায়ক হয়েছিল।

    * দেশীয় রাজাদের সহায়তা: গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া, হায়দ্রাবাদের নিজাম, ভোপালের নবাব, পাতিয়ালার শিখ রাজা, নেপালের শাসক প্রমুখ অনেক দেশীয় রাজা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিলেন এবং তাদের বিদ্রোহ দমনে সহায়তা করেছিলেন।

    * শিক্ষিত ভারতীয়দের সমর্থনহীনতা: তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি ও অন্যান্য ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। তারা মনে করত ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতে আধুনিকীকরণ সম্ভব।


* ঙ. প্রভাব (Impact):

    * কোম্পানি শাসনের অবসান: ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন (Government of India Act, 1858) দ্বারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের (মহারানির) হাতে চলে যায়।

    * ভাইসরয় পদ সৃষ্টি: গভর্নর জেনারেল পদটি বিলুপ্ত করে ভাইসরয় (Viceroy) পদ সৃষ্টি করা হয়। লর্ড ক্যানিং ছিলেন ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম ভাইসরয়।

    * মহারানির ঘোষণা (Queen Victoria's Proclamation), ১৮৫৮:

        * ব্রিটিশ সরকার আর নতুন করে কোনো ভারতীয় রাজ্য দখল করবে না বলে ঘোষণা করে।

        * দেশীয় রাজাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

        * ভারতীয়দের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

        * জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। (তবে বাস্তবে এর প্রয়োগ সীমিত ছিল)।

        * ক্ষমা প্রদর্শনের নীতি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু বিদ্রোহের মূল নেতাদের শাস্তি দেওয়া হয়।

    * সামরিক পুনর্গঠন: ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। ইউরোপীয় সিপাহিদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় এবং ভারতীয় সিপাহিদের অনুপাত কমানো হয়। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিভাগ, যেমন কামান বিভাগ, ইউরোপীয়দের হাতে রাখা হয়। "ভাগ করো ও শাসন করো" (Divide and Rule) নীতি অনুসরণ করে সৈন্যদের জাতিগত ও ধর্মীয় ভিত্তিতে ভাগ করা হয়।

    * জাতীয়তাবাদের উন্মেষ: বিদ্রোহ দমন হলেও এটি ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজ বপন করে। এটি পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণা জোগায়।

    * সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন: ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। তবে অর্থনৈতিক শোষণ আরও তীব্র হয়।