জ্ঞানালোক ও আধুনিক ধারণা: জ্ঞানালোকের প্রধান ধারণা ও এর প্রভাব, ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৮১৫) ও এর পরবর্তী ঘটনা, আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬), আমেরিকান গৃহযুদ্ধ
### A. জ্ঞানালোক (Enlightenment): প্রধান ধারণা ও এর প্রভাব
জ্ঞানালোক ছিল ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত ইউরোপে প্রসারিত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তি, বিজ্ঞান ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি ও ধর্মীয় চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনা।
* সংজ্ঞা: যুক্তি ও বুদ্ধিবাদের ওপর নির্ভর করে প্রচলিত বিশ্বাস, কুসংস্কার ও স্বৈরাচারী শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং মানবজাতির প্রগতি ও সুখের পথ উন্মোচন করা। এটি ছিল মূলত এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব।
* মুখ্য ধারণাসমূহ:
* যুক্তি ও কারণ (Reason and Rationalism): জ্ঞানালোকের মূল ভিত্তি ছিল যুক্তি ও বুদ্ধিবাদের ওপর বিশ্বাস। যেকোনো বিষয়কে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করার কথা বলা হয়।
* ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার (Individual Liberty and Rights): প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Rights) – জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের ওপর জোর দেওয়া হয়। সরকার মানুষের এই মৌলিক অধিকার রক্ষা করবে।
* সহনশীলতা (Tolerance): ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহনশীলতার গুরুত্ব স্বীকৃত হয়। গির্জার গোঁড়ামি ও ধর্মীয় নিপীড়নের সমালোচনা করা হয়।
* প্রগতি (Progress): বিশ্বাস করা হয় যে মানবজাতি যুক্তি ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে উন্নত হতে পারে।
* গণতন্ত্র ও জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব (Democracy and Popular Sovereignty): ক্ষমতার উৎস জনগণ, রাজা বা ঈশ্বরের ইচ্ছানয় – এই ধারণা জনপ্রিয় হয়।
* ক্ষমতার বিভাজন (Separation of Powers): সরকারের ক্ষমতা আইনসভা, কার্যনির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিভাজনের ধারণা প্রবর্তিত হয়, যাতে কোনো এক বিভাগ একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী না হয়।
* প্রধান চিন্তাবিদগণ ও তাঁদের অবদান:
* জন লক (John Locke, ১৬৩২-১৭০৪, ইংল্যান্ড): 'Two Treatises of Government' গ্রন্থে প্রাকৃতিক অধিকার (জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তি) এবং সরকারের সাথে জনগণের সামাজিক চুক্তির (Social Contract) ধারণার প্রবক্তা। তাঁর মতে, সরকার জনগণের সম্মতিতেই পরিচালিত হওয়া উচিত।
* ভলতেয়ার (Voltaire, ১৬৯৪-১৭৭৮, ফ্রান্স): ফরাসি চিন্তাবিদ। মুক্তচিন্তা, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বাকস্বাধীনতার (Freedom of Speech) ঘোর সমর্থক ছিলেন। তিনি স্বৈরাচারী শাসন ও গির্জার গোঁড়ামির তীব্র সমালোচনা করেন।
* মন্টেস্কিউ (Montesquieu, ১৬৮৯-১৭৫৫, ফ্রান্স): 'The Spirit of the Laws' গ্রন্থে ক্ষমতার বিভাজন নীতির (Separation of Powers - আইন, শাসন, বিচার) প্রস্তাব করেন। এই ধারণা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানের ভিত্তি।
* জ্যাঁ-জ্যাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau, ১৭১২-১৭৭৮, ফ্রান্স): 'The Social Contract' গ্রন্থে "সাধারণ ইচ্ছা" (General Will) এবং জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের (Popular Sovereignty) ধারণা দেন। তাঁর মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে নিহিত এবং সরকার জনগণের সাধারণ ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হবে।
* দেনিস দিদেরো (Denis Diderot, ১৭১৩-১৭৮৪, ফ্রান্স): 'এনসাইক্লোপিডিয়া' (Encyclopédie) সংকলনের প্রধান সম্পাদক। এই কোষগ্রন্থ জ্ঞানালোকের ধারণাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
* প্রভাব:
* রাজনৈতিক প্রভাব: আমেরিকান ও ফরাসি বিপ্লবের মতো বিভিন্ন বিপ্লবের মূল অনুপ্রেরণা ছিল জ্ঞানালোকের ধারণা। এটি আধুনিক গণতন্ত্র, সংবিধানবাদ ও মানবাধিকার ধারণার জন্ম দেয়।
* সামাজিক প্রভাব: সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা ও সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ধারণার প্রসার ঘটে। দাসপ্রথা বিলোপ, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের দিকে নজর দেওয়া হয়।
* অর্থনৈতিক প্রভাব: অ্যাডাম স্মিথের 'Wealth of Nations' (১৭৭৬) জ্ঞানালোকের অর্থনীতি বিষয়ক চিন্তাধারার ফসল। তিনি 'লেসে-ফেয়ার' (Laissez-faire) নীতি অর্থাৎ মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে মত দেন।
* ধর্মীয় প্রভাব: ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী সমালোচনার জন্ম দেয়।
### B. আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ (American War of Independence - ১৭৭৬)
আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ব্রিটেনের ১৩টি উত্তর আমেরিকান উপনিবেশ এবং গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে একটি সামরিক ও রাজনৈতিক সংঘাত, যার ফলস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হয়।
* প্রেক্ষাপট ও কারণ:
* উপনিবেশবাদ (Mercantilism): ব্রিটেন বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য উপনিবেশগুলির উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে (যেমন: নেভিগেশন অ্যাক্টস)।
* নতুন কর আইন: ১৭৬৩ সালের পর ব্রিটেন উপনিবেশগুলির উপর নতুন কর (যেমন: স্ট্যাম্প অ্যাক্ট ১৭৬৫, টাউনশেন্ড অ্যাক্টস ১৭৬৭) আরোপ করে, যা উপনিবেশবাদীরা "প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর নয়" (No taxation without representation) এই স্লোগান তুলে প্রত্যাখ্যান করে।
* বস্টন হত্যাকাণ্ড (Boston Massacre, ১৭৭০): ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে কয়েকজন উপনিবেশবাদীর মৃত্যু।
* বস্টন টি পার্টি (Boston Tea Party, ১৭৭৩): চা আইনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একচেটিয়া অধিকার দেওয়ায় উপনিবেশবাদীরা এর প্রতিবাদে চা বোঝাই জাহাজ থেকে চা ফেলে দেয়।
* জ্ঞানালোকের প্রভাব: জন লক ও মন্টেস্কিউ-এর ধারণা উপনিবেশবাদীদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তোলে।
* গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব:
* প্রথম মহাদেশীয় কংগ্রেস (First Continental Congress, ১৭৭৪): উপনিবেশগুলির প্রতিনিধিরা ফিলাডেলফিয়ায় একত্রিত হয়ে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ জানায়।
* লেক্সিংটন ও কনকর্ডের যুদ্ধ (Battles of Lexington and Concord, ১৭৭৫): যুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র সংঘাত।
* দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস (Second Continental Congress, ১৭৭৫): জজ ওয়াশিংটনকে কন্টিনেন্টাল আর্মির প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
* স্বাধীনতার ঘোষণা (Declaration of Independence, ৪ জুলাই ১৭৭৬): টমাস জেফারসন কর্তৃক রচিত এই ঘোষণাপত্রে ব্রিটেনের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়।
* সারাতোগার যুদ্ধ (Battle of Saratoga, ১৭৭৭): আমেরিকানদের এই বিজয় ফ্রান্সকে আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতে উৎসাহিত করে। এটি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
* ইয়র্কটাউনের যুদ্ধ (Battle of Yorktown, ১৭৮১): জজ ওয়াশিংটন ও ফরাসি সহায়তায় ব্রিটিশ বাহিনী কর্নওয়ালিসের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমেরিকানদের চূড়ান্ত বিজয়।
* ফলাফল ও তাৎপর্য:
* মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম: ১৭৮৩ সালের প্যারিসের চুক্তি (Treaty of Paris) দ্বারা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
* প্রথম লিখিত সংবিধান: ১৭৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান গৃহীত হয়, যা বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান।
* গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ইউরোপের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য এক অনুপ্রেরণা ছিল।
* ফরাসি বিপ্লবের অনুপ্রেরণা: আমেরিকান বিপ্লবের সাফল্য ফরাসি বিপ্লব সহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়।
### C. ফরাসি বিপ্লব (French Revolution - ১৭৮৯-১৮১৫) ও এর পরবর্তী ঘটনা
ফরাসি বিপ্লব ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা, যা ফ্রান্সে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়।
* প্রেক্ষাপট ও কারণ:
* রাজনৈতিক কারণ: বুঁরবো রাজবংশের স্বৈরাচারী শাসন (ষোড়শ লুই ও মারি আতোঁয়ানেত), অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা, জনগণের মৌলিক অধিকারের অভাব।
* সামাজিক কারণ: ফরাসি সমাজে 'তিনটি এস্টেট'-এর উপর ভিত্তি করে তীব্র বৈষম্য ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট (যাজক ও অভিজাত) সমস্ত সুবিধা ভোগ করত, যখন তৃতীয় এস্টেট (সাধারণ মানুষ) করের বোঝা ও অধিকারহীনতার শিকার ছিল।
* অর্থনৈতিক কারণ: দীর্ঘদিনের যুদ্ধ (যেমন: সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ, আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ) এবং রাজকীয় বিলাসিতা ফ্রান্সের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে তুলেছিল। শস্যহানি ও খাদ্য সংকট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।
* জ্ঞানালোকের প্রভাব: লক, রুশো, ভলতেয়ার, মন্টেস্কিউ প্রমুখ চিন্তাবিদদের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ধারণা ফরাসি জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।
* বিপ্লবের প্রধান পর্যায়সমূহ:
* এস্টেটস-জেনারেলের অধিবেশন (১৭৮৯): আর্থিক সংকট মোকাবিলায় ষোড়শ লুই এস্টেটস-জেনারেলের অধিবেশন ডাকলে তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা নিজেদের জাতীয় সভা (National Assembly) হিসেবে ঘোষণা করে।
* টেনিস কোর্টের শপথ (Tennis Court Oath, ২০ জুন ১৭৮৯): জাতীয় সভার সদস্যরা ফ্রান্সের জন্য একটি সংবিধান না তৈরি করা পর্যন্ত একত্রিত থাকার শপথ নেয়।
* বাস্টিল দুর্গের পতন (Fall of Bastille, ১৪ জুলাই ১৭৮৯): প্যারিসের মানুষ বাস্তিল দুর্গ দখল করে, যা বিপ্লবের প্রতীকী সূচনা ছিল।
* মানুষ ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা (Declaration of the Rights of Man and of the Citizen, ২৬ আগস্ট ১৭৮৯): এই ঘোষণাপত্রে সাম্য, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের কথা বলা হয়।
* রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ও প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা (১৭৯২): রাজা ষোড়শ লুই-এর ক্ষমতা খর্ব করা হয় এবং পরে তাঁকে ও মারি আতোঁয়ানেতকে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফ্রান্স একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
* সন্ত্রাসের রাজত্ব (Reign of Terror, ১৭৯৩-১৭৯৪): জ্যাকোবিন নেতা রবেসপিয়েরের নেতৃত্বে গণনিরাপত্তা কমিটি (Committee of Public Safety) হাজার হাজার 'বিপ্লব বিরোধী' মানুষকে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে রবেসপিয়ের নিজেও গিলোটিনে নিহত হন।
* ডিরেক্টরির শাসন (The Directory, ১৭৯৫-১৭৯৯): পাঁচ সদস্যের একটি কার্যনির্বাহী পরিষদ ফ্রান্স শাসন করে, কিন্তু এটি ছিল দুর্বল ও অস্থিতিশীল।
* নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান (Rise of Napoleon Bonaparte, ১৭৯৯-১৮১৫):
* কনস্যুলেট (১৭৯৯-১৮০৪): নেপোলিয়ন ডিরেক্টরিকে উৎখাত করে কনস্যুলেটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।
* সম্রাট নেপোলিয়ন (১৮০৪): তিনি নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন।
* নেপোলিয়নিক কোড (Napoleonic Code): আইনের সংস্কার করে সকলের জন্য সমান অধিকার ও সম্পত্তির অধিকারের নিশ্চয়তা দেন।
* নেপোলিয়নিক যুদ্ধসমূহ: ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধ বিস্তার করেন, মহাদেশীয় অবরোধ (Continental System) দ্বারা ব্রিটেনকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করেন।
* ওয়াটারলুর যুদ্ধ (Battle of Waterloo, ১৮১৫): চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে এবং সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হন।
* ফলাফল ও তাৎপর্য:
* সামন্ততন্ত্রের অবসান: ফ্রান্সে দীর্ঘদিনের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।
* জাতীয়তাবাদের জন্ম: ফরাসি বিপ্লব ইউরোপে জাতীয়তাবাদের ধারণার জন্ম ও প্রসারে সাহায্য করে।
* প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ধারণা: এটি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলে।
* মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি: সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
* ভিয়েনা কংগ্রেস (Congress of Vienna, ১৮১৫): নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপের শক্তিগুলো (অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন) একত্রিত হয়ে ইউরোপের মানচিত্র পুনর্গঠন করে এবং রক্ষণশীল রাজতন্ত্রগুলো পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে। এটি বিপ্লব পরবর্তী ইউরোপের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
### D. আমেরিকান গৃহযুদ্ধ (American Civil War - ১৮৬১-১৮৬৫)
আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে একটি সশস্ত্র সংঘাত, যা দাসপ্রথা, রাজ্যগুলির অধিকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা নিয়ে বিরোধের কারণে ঘটেছিল।
* প্রেক্ষাপট ও কারণ:
* দাসপ্রথা: এটি ছিল গৃহযুদ্ধের মূল কারণ। দক্ষিণের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর (তুলা, তামাক), যা দাস শ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল। উত্তরের শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে দাসপ্রথার প্রয়োজনীয়তা ছিল না এবং নৈতিকভাবে এর বিরোধিতা করা হতো।
* রাজ্যগুলির অধিকার বনাম ফেডারেল ক্ষমতা: দক্ষিণ রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে রাজ্যগুলির অধিকার (States' Rights) বজায় রাখতে চেয়েছিল, বিশেষত দাসপ্রথা বজায় রাখার ক্ষেত্রে। উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়াতে চেয়েছিল।
* অর্থনৈতিক পার্থক্য: উত্তরের শিল্প অর্থনীতি এবং দক্ষিণের কৃষি অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য বিভেদ বাড়িয়েছিল।
* আব্রাহাম লিঙ্কনের নির্বাচন (১৮৬০): লিঙ্কন দাসপ্রথা বিরোধী রিপাবলিকান দলের নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে দক্ষিণের রাজ্যগুলি মনে করে তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি হুমকির মুখে পড়েছে এবং ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে।
* সংঘর্ষ ও ব্যক্তিত্ব:
* বিচ্ছিন্নতা ও কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা: লিঙ্কন নির্বাচিত হওয়ার পর ১১টি দক্ষিণের রাজ্য ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে 'কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা' গঠন করে, যার প্রেসিডেন্ট হন জেফারসন ডেভিস।
* যুদ্ধ শুরু: ১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে ফোর্ট সুমটারের (Fort Sumter) ওপর কনফেডারেট আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়।
* প্রধান ব্যক্তিত্ব:
* আব্রাহাম লিঙ্কন (Abraham Lincoln): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ইউনিয়নের পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
* ইউলিসিস এস গ্রান্ট (Ulysses S. Grant): ইউনিয়নের প্রধান সেনাপতি, পরে প্রেসিডেন্ট হন।
* রবার্ট ই লি (Robert E. Lee): কনফেডারেট বাহিনীর প্রধান সেনাপতি।
* গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধসমূহ:
* গেটিসবার্গের যুদ্ধ (Battle of Gettysburg, ১৮৬৩): উত্তরের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় ছিল, যা কনফেডারেটদের উত্তরাঞ্চলে অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়।
* ভিকসবার্গের যুদ্ধ (Siege of Vicksburg, ১৮৬৩): মিসিসিপি নদীর উপর ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে, যা কনফেডারেটদের দুটি অংশে বিভক্ত করে।
* মুক্তি ঘোষণা (Emancipation Proclamation, ১৮৬৩): লিঙ্কন কনফেডারেট রাজ্যগুলিতে দাসদের মুক্তির ঘোষণা করেন। এটি যুদ্ধের নৈতিক উদ্দেশ্যকে আরও জোরালো করে।
* ফলাফল ও তাৎপর্য:
* দাসপ্রথার বিলোপ: ১৮৬৫ সালে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। এটি আমেরিকান সমাজের এক মৌলিক পরিবর্তন ছিল।
* ইউনিয়নের অখণ্ডতা বজায়: গৃহযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্তি ঠেকিয়ে ইউনিয়নের অখণ্ডতা বজায় রাখে।
* ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব রাজ্যগুলির অধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
* পুনর্গঠন যুগ (Reconstruction Era): যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দাসদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে পুনরায় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি দীর্ঘ এবং জটিল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
* আর্থ-সামাজিক প্রভাব: যুদ্ধ দক্ষিণের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয় এবং দাসদের নতুন জীবন শুরু করার চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এটি আমেরিকায় আধুনিক শিল্পায়ন ও জাতীয়তাবাদের গতি বাড়ায়।
* রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভেদ: গৃহযুদ্ধ জাতিগত সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এবং দীর্ঘমেয়াদী জাতিগত বিভেদ ও বর্ণবৈষম্যের বীজ বপন করে।