শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution) বলতে মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হওয়া সেই যুগান্তকারী পরিবর্তনকে বোঝায়, যখন হাতে তৈরি পণ্যের পরিবর্তে যন্ত্রের সাহায্যে বৃহৎ পরিমাণে উৎপাদন শুরু হয়। এটি কেবল শিল্প ও অর্থনীতির পরিবর্তন ছিল না, বরং সমাজ, রাজনীতি এবং জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ইংল্যান্ডে এর সূচনা হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তা বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
১. ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution in England)
ইংল্যান্ড ছিল শিল্প বিপ্লবের সূতিকাগার। এর কারণগুলি ছিল সুনির্দিষ্ট, প্রকৃতি ছিল বৈপ্লবিক এবং এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
১.১. শিল্প বিপ্লবের কারণ:
* রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীর গৌরবময় বিপ্লবের (Glorious Revolution, ১৬৮৮) পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছিল। অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বা সংঘাতের অনুপস্থিতি শিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল।
* পুঁজি ও বিনিয়োগ: ইংল্যান্ডের বণিক ও অভিজাতদের হাতে প্রচুর পুঁজি জমা হয়েছিল দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি এবং ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে (যেমন, দাস ব্যবসা)। এই পুঁজি শিল্পে বিনিয়োগ করা সহজ হয়েছিল শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থার (যেমন, Bank of England) উপস্থিতির কারণে।
* প্রাকৃতিক সম্পদ:
* কয়লা ও লোহা: শিল্প বিপ্লবের প্রধান জ্বালানি কয়লা এবং প্রধান কাঁচামাল লোহা ইংল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। ডার্বিশায়ার, ইয়র্কশায়ার ও ল্যাঙ্কাশায়ার ছিল কয়লা ও লোহার প্রধান কেন্দ্র।
* জলপথ: নদী ও খালগুলি পণ্য পরিবহনের জন্য প্রাকৃতিক জলপথের সুবিধা দিত।
* কাঁচামালের সহজলভ্যতা ও বাজার: ইংল্যান্ডের বিশাল উপনিবেশগুলি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল (যেমন, ভারত ও আমেরিকা থেকে তুলা) সরবরাহ করত এবং উৎপাদিত পণ্যের জন্য নিশ্চিত বাজার হিসেবে কাজ করত।
* কৃষি বিপ্লব:
* অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। নতুন পদ্ধতি (যেমন, শস্যাবর্তন, সার ব্যবহার) এবং যন্ত্রপাতির (যেমন, জেথ্রো টুলের সিড ড্রিল) ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
* বেষ্টনী প্রথা (Enclosure Movement): এর ফলে ছোট কৃষকদের জমি বড় জমিদারদের হাতে চলে যায় এবং তারা কর্মহীন হয়ে শহরে শিল্পে শ্রমিকের কাজ খুঁজতে আসে। এটি শিল্পগুলির জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিকের যোগান নিশ্চিত করে।
* পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি: ক্যানাল (খাল) নির্মাণ (যেমন, ব্রিজলির ক্যানাল), উন্নত সড়ক ব্যবস্থা এবং পরবর্তীতে রেলপথের প্রসার (স্টিফেনসনের রকেট ইঞ্জিন) পণ্য ও কাঁচামাল পরিবহনে বিপ্লব ঘটায়।
* শ্রমিক সরবরাহ: কৃষি বিপ্লব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শহরে প্রচুর শ্রমিকের আগমন ঘটে, যারা স্বল্প মজুরিতে কাজ করতে রাজি ছিল।
* বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন:
* বস্ত্র শিল্প: জন কে-র উড়ন্ত মাকু (Flying Shuttle, ১৭৩৩), জেমস হারগ্রিভসের স্পিনিং জেনি (Spinning Jenny, ১৭৬৪), রিচার্ড আর্করাইটের ওয়াটার ফ্রেম (Water Frame, ১৭৬৯), স্যামুয়েল ক্রম্পটনের মিউল (Mule, ১৭৭৯), এডমন্ড কার্টরাইটের পাওয়ার লুম (Power Loom, ১৭৮৫) বস্ত্র উৎপাদনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
* বাষ্পীয় ইঞ্জিন: জেমস ওয়াটের উন্নত বাষ্পীয় ইঞ্জিন (১৭৬৯) শুধু খনিজ শিল্পেই নয়, পরিবহন, বস্ত্র শিল্প সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়। টমাস নিউকমেন প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করলেও ওয়াটের ইঞ্জিন ছিল অধিক কার্যকর।
* ধাতু শিল্প: আব্রাহাম ডার্বি কোক কয়লার ব্যবহার করে লোহা উৎপাদনে উন্নতি ঘটান (১৭০৯), হেনরি কর্ট পুডলিং ও রোলিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নত মানের লোহা তৈরি করেন (১৭৮৪)।
* উদার বাণিজ্য নীতি (Laissez-faire): সরকারের অবাধ বাণিজ্য নীতি শিল্পপতিদের বিনিয়োগ ও মুনাফা অর্জনে উৎসাহিত করে।
১.২. শিল্প বিপ্লবের প্রকৃতি (বৈশিষ্ট্য):
* গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে শিল্প অর্থনীতিতে রূপান্তর: কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ থেকে শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক শহুরে সমাজে পরিবর্তন।
* হস্তশিল্প থেকে যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন: হাতে বোনা কাপড়, হাতে তৈরি যন্ত্রপাতির বদলে যন্ত্রের সাহায্যে বৃহৎ পরিমাণে উৎপাদন।
* কুটির শিল্প থেকে কারখানা প্রথায় রূপান্তর: পারিবারিক পরিবেশে উৎপাদনের বদলে কারখানায় শ্রমিকদের সম্মিলিত উৎপাদন।
* বাষ্প শক্তির ব্যবহার: বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও কয়লা ছিল শিল্প উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি।
* শ্রমের বিভাজন ও বিশেষীকরণ: একই শ্রমিক একটি নির্দিষ্ট কাজ বারবার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।
* নগরায়ন: শিল্পাঞ্চলের আশেপাশে প্রচুর জনসংখ্যা জড়ো হওয়ায় শহরগুলির দ্রুত বৃদ্ধি।
* পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ: মুনাফা অর্জনই ছিল শিল্পের মূল লক্ষ্য, যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল ভিত্তি স্থাপন করে।
* নতুন সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব: বুর্জোয়া (পুঁজিবাদী/শিল্পপতি) ও প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণী) এই দুটি প্রধান শ্রেণীর উদ্ভব হয়।
১.৩. শিল্প বিপ্লবের প্রভাব:
* অর্থনৈতিক প্রভাব:
* উৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রসার: উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ইংল্যান্ড বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
* পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিকাশ: বিশাল আকারের শিল্প কারখানা এবং মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা পুঁজিবাদের ভিত্তি মজবুত করে।
* অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি: ধনী শিল্পপতি ও দরিদ্র শ্রমিকের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।
* ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থার প্রসার: ক্রমবর্ধমান ব্যবসা ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটে।
* সামাজিক প্রভাব:
* নগরায়ন ও বস্তি সমস্যা: শিল্পাঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে অপরিকল্পিত নগরায়ন হয় এবং শ্রমিকদের জন্য অস্বাস্থ্যকর বস্তি গড়ে ওঠে।
* শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব ও শোষণ: শ্রমিকদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, স্বল্প মজুরি, নিরাপত্তাহীনতা, নারী ও শিশু শ্রমিকের ব্যাপক ব্যবহার ছিল একটি প্রধান সমস্যা।
* মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ: শিল্পপতি, ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার, কারিগর, শিক্ষক, চিকিৎসক প্রমুখ নিয়ে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়।
* পরিবারের কাঠামো পরিবর্তন: গ্রামীণ যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের প্রবণতা বাড়ে।
* সামাজিক অস্থিরতা: শ্রমিক শোষণ ও বৈষম্যের প্রতিবাদে লুডাইট আন্দোলন (যন্ত্র ভাঙা) ও চার্টিস্ট আন্দোলন (রাজনৈতিক অধিকারের দাবি) এর মতো আন্দোলন গড়ে ওঠে।
* রাজনৈতিক প্রভাব:
* সরকারের ভূমিকা পরিবর্তন: প্রথমে সরকার অবাধ বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করলেও, শ্রমিকদের অবস্থার অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাক্টরি আইন (Factory Acts, যেমন ১৮৩৩, ১৮৪২, ১৯৪৭ সালের আইন) প্রণয়ন করে শ্রমিকদের কল্যাণে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
* সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিকাশ: শ্রমিক শোষণ ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি সমাজতন্ত্র (Socialism) ও সাম্যবাদের (Communism) ধারণার জন্ম দেয় (যেমন, কার্ল মার্কসের তত্ত্ব)।
* সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ: শিল্প বিপ্লব উপনিবেশগুলিতে কাঁচামালের যোগান ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে দেয়, যা সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটায়।
* পরিবেশগত প্রভাব: শিল্পাঞ্চলগুলিতে বায়ু ও জল দূষণ বৃদ্ধি পায়।
* সাংস্কৃতিক প্রভাব: জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসে, কর্ম ও অবসর বিনোদনের নতুন ধারা তৈরি হয়।
২. অন্যান্য দেশে শিল্পায়ন
ইংল্যান্ডের দেখাদেখি ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও শিল্পায়ন শুরু হয়, তবে তাদের শিল্পায়নের গতিপথ ও প্রকৃতি ভিন্ন ছিল।
২.১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA):
* সময়কাল: ১৯শ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে শিল্পায়ন শুরু হলেও, ১৮৬৫ সালের গৃহযুদ্ধের পর এর গতি তীব্র হয়। ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ শিল্প শক্তিতে পরিণত হয়।
* বৈশিষ্ট্য ও কারণ:
* প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ: কয়লা, লোহা, তেল, গ্যাস – সমস্ত প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর ছিল।
* বৃহৎ অভ্যন্তরীণ বাজার: দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি (অভিবাসন সহ) এবং বিশাল ভৌগোলিক এলাকা একটি বৃহৎ অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করে।
* উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তি: স্যামুয়েল স্লেটারের স্পিনিং মিল (১৭৯০), এলি হুইটনির কটন জিন (১৭৯৩), সাইরাস ম্যাককর্মিকের রিপার (১৮৩১) এর মতো উদ্ভাবন উৎপাদন বৃদ্ধি করে। থমাস এডিসন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আবিষ্কার করে শিল্পে বিপ্লব আনেন।
* পরিবহন বিপ্লব: রেলপথের দ্রুত সম্প্রসারণ (ট্রান্সকন্টিনেন্টাল রেলওয়ে), স্টিমবোটের ব্যবহার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে গতি দেয়।
* উদ্যোক্তা মনোভাব ও সরকারি সমর্থন: বেসরকারি উদ্যোগ এবং সরকারের উদারনীতি শিল্পায়নকে উৎসাহিত করে। সংরক্ষণ শুল্কের (Protective Tariffs) মাধ্যমে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া হয়।
* পুঁজি ও শ্রমিকের প্রাচুর্য: ইউরোপ থেকে আসা পুঁজি ও শ্রমিকের যোগান শিল্পায়নে সহায়ক হয়।
* গুরুত্বপূর্ণ শিল্প: ইস্পাত (অ্যান্ড্রু কার্নেগি), তেল (জন ডি. রকফেলার), রেলপথ, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি (হেনরি ফোর্ড ও অ্যাসেম্বলি লাইন পদ্ধতি)।
* প্রভাব: বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে উত্থান, বৃহৎ কর্পোরেশন (ট্রাস্ট) ও একচেটিয়া কারবারের জন্ম, শ্রমিক আন্দোলন ও সামাজিক অস্থিরতা।
২.২. জার্মানি (Germany):
* সময়কাল: ১৯শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শিল্পায়ন শুরু হয়, কিন্তু ১৮৭০-৭১ সালের জার্মানির ঐক্যবদ্ধকরণের পর এর গতি প্রচণ্ড বৃদ্ধি পায়।
* বৈশিষ্ট্য ও কারণ:
* রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা: প্রাশিয়া এবং পরবর্তীতে ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র শিল্পায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সরকার রেলপথ নির্মাণ, শিল্প ব্যাংক স্থাপন এবং কারিগরি শিক্ষার প্রচলনে ব্যাপক বিনিয়োগ করে।
* Zollverein (শুল্ক সংঘ): ১৮৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শুল্ক সংঘ জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অভ্যন্তরীণ শুল্ক তুলে দিয়ে একটি বৃহৎ বাজার তৈরি করে, যা শিল্পায়নে সহায়ক হয়।
* প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ: রুহর উপত্যকায় কয়লা ও লোহার বিশাল ভাণ্ডার ছিল জার্মানির শিল্পায়নের মূল ভিত্তি।
* উন্নত বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা: জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক শিল্পের বিকাশে সহায়ক হয়।
* বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কার্টেল: জার্মান শিল্পে বৃহৎ কোম্পানি এবং কার্টেল (বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে জোট) গঠনের প্রবণতা দেখা যায়, যা প্রতিযোগিতা কমিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
* গুরুত্বপূর্ণ শিল্প: ইস্পাত (ক্রুপ পরিবার), রাসায়নিক (বায়ার, বিএএসএফ), বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম (সিমেন্স)।
* প্রভাব: জার্মানির দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে উত্থান, যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য বিসমার্কের নীতি (যেমন, স্বাস্থ্য বীমা, দুর্ঘটনা বীমা) উল্লেখযোগ্য।
২.৩. রাশিয়া (Russia):
* সময়কাল: ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে জার ও দ্বিতীয় আলেকজান্ডার, তৃতীয় আলেকজান্ডার এবং দ্বিতীয় নিকোলাসের অধীনে শিল্পায়ন শুরু হয়। তবে ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত আমলে (বিশেষত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে) এর গতি প্রচণ্ড বৃদ্ধি পায়।
* বৈশিষ্ট্য ও কারণ:
* রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন: জার আমলেও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ছিল, কিন্তু সোভিয়েত আমলে এটি সম্পূর্ণ রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত (Centralized Planning) হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগের বদলে রাষ্ট্রই শিল্পের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল।
* বিদেশী বিনিয়োগ: জার আমলে (যেমন, ১৮৯২-১৯০৩ সালে সার্গেই উইটের অধীনে) প্রচুর বিদেশী পুঁজি (ফ্রান্স, ব্রিটেন) রাশিয়ার শিল্পায়নে বিনিয়োগ করা হয়।
* বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ: কয়লা, তেল, গ্যাস, লোহা সহ বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ রাশিয়াতে ছিল।
* ভারী শিল্পের ওপর জোর: সোভিয়েত শিল্পায়নের মূল লক্ষ্য ছিল ভারী শিল্প (ইস্পাত, যন্ত্রপাতি, অস্ত্র) ও প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ, যা ভোগ্যপণ্য শিল্পের ব্যয়ভার বহন করত।
* কৃষি থেকে শ্রমিকের যোগান: ভূমিদাস প্রথার বিলোপ ও জোরপূর্বক সমবায় কৃষির (Collective Farming) ফলে প্রচুর শ্রমিক শিল্পে নিযুক্ত হয়।
* গুরুত্বপূর্ণ শিল্প: ইস্পাত (ম্যাগনিটোগোরস্ক), কয়লা (ডনবাস), তেল।
* প্রভাব: দ্রুত শিল্প শক্তি হিসেবে উত্থান (বিশেষত সোভিয়েত আমলে), কিন্তু তা ভারসাম্যহীন ছিল। ভোগ্যপণ্যের অভাব, শ্রমিক শোষণ (বিশেষত স্টালিনের আমলে), এবং ব্যাপক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন। শিল্পায়নের প্রক্রিয়াই রাশিয়ায় বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
২.৪. জাপান (Japan):
* সময়কাল: ১৮৬৮ সালের মেইজি পুনর্গঠনের (Meiji Restoration) পর থেকে জাপানে শিল্পায়ন শুরু হয়।
* বৈশিষ্ট্য ও কারণ:
* রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও জাতীয়তাবাদী চেতনা: পশ্চিমা শক্তির আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা এবং স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জাপান দ্রুত শিল্পায়নের পথ বেছে নেয়। মেইজি সরকার শিল্পায়নে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেয়।
* পশ্চিমা প্রযুক্তি ও জ্ঞান গ্রহণ: জাপান দ্রুত পশ্চিমা প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সামরিক কৌশল ও শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করে।
* Zaibatsu (জাইবাতসু): সরকার শিল্পগুলি শুরু করে পরে সেগুলিকে কয়েকটি বৃহৎ পারিবারিক শিল্পগোষ্ঠী (যেমন, মিতসুবিশি, মিতসুই, সুমিতোমো, ইয়াসুদা) কাছে বিক্রি করে দেয়, যারা জাপানের শিল্পায়নের প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে।
* শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ: কারিগরি ও উচ্চশিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়, যা দক্ষ শ্রমশক্তি ও উদ্ভাবনের জন্ম দেয়।
* রেশম ও বস্ত্র শিল্পের প্রাথমিক ভূমিকা: প্রাথমিকভাবে রেশম ও বস্ত্র শিল্প জাপানের শিল্পায়নের মূল ভিত্তি ছিল, পরে ভারী শিল্প ও সামরিক শিল্পের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়।
* কাঁচামাল ও বাজারের জন্য সাম্রাজ্যবাদ: জাপানের অভ্যন্তরীণ কাঁচামালের অভাব এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজারের প্রয়োজনীয়তা তাকে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য করে (যেমন, কোরিয়া, মানচুরিয়া দখল)।
* গুরুত্বপূর্ণ শিল্প: বস্ত্র, ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণ, অস্ত্র।
* প্রভাব: এশিয়ার প্রথম আধুনিক শিল্প শক্তি হিসেবে উত্থান, যা পরবর্তীতে সামরিক শক্তি হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং এশিয়ায় জাপানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
উপসংহার:
শিল্পায়ন ছিল আধুনিক বিশ্বের এক যুগান্তকারী প্রক্রিয়া। ইংল্যান্ডে এর সূচনা হলেও, তা দ্রুত বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিটি দেশের নিজস্ব ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনলেও, সমাজের প্রতিটি স্তরে গভীর পরিবর্তন ও নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয়, যা একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বকেও প্রভাবিত করে চলেছে। এই প্রক্রিয়া বিশ্ব মানচিত্র পরিবর্তন করে নতুন শক্তির ভারসাম্য তৈরি করে এবং বিশ্বযুদ্ধের মতো মহাবিপর্যয়ের কারণও হয়ে ওঠে।