১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কাঠামোগত পরিবর্তন আসে এবং ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। এই সময়কাল থেকেই ধীরে ধীরে আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। এর প্রধান কারণগুলি ছিল:
* রাজনৈতিক ঐক্য ও ব্রিটিশ প্রশাসন: ব্রিটিশ শাসন ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে একত্রিত করে একটি অভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসে। অভিন্ন আইন, বিচার ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা (রেল, ডাক, তার) ভারতীয়দের মধ্যে একতার ধারণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
* পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ধ্যানধারণার প্রভাব: ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষা (যেমন, ১৮৩৫ সালের মেকলের মিনিট, ১৮৫৪ সালের উডের ডেসপ্যাচ) ভারতীয়দের মধ্যে মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল, রুশো, ভলতেয়ারের মতো পশ্চিমা দার্শনিকদের প্রগতিশীল ধারণা যেমন – স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে পরিচিত করায়। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর প্রমুখের নেতৃত্বে সামাজিক সংস্কার আন্দোলনগুলিও আত্মসম্মান ও জাতীয় চেতনার উন্মেষে সহায়তা করে।
* সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন: ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন (যেমন, ব্রাহ্মসমাজ, আর্য সমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন) কুসংস্কার দূর করে ভারতীয় সমাজকে আধুনিকতার পথে নিয়ে আসে। এই আন্দোলনগুলি ভারতীয়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান এবং নিজেদের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ববোধ জাগিয়ে তোলে, যা জাতীয়তাবাদী ধারণার ভিত্তি তৈরি করে।
* অর্থনৈতিক শোষণ: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতিগুলি ভারতের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। ভূমি রাজস্বের উচ্চহার, শিল্পের বিনাশ, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ এবং সম্পদ নিষ্কাশন (Drain of Wealth) ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়।
* জাতিগত বৈষম্য ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ: ব্রিটিশরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত এবং ভারতীয়দের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করত। ইলবার্ট বিল বিতর্ক (১৮৮৩) এই জাতিগত বৈষম্যের চরম দৃষ্টান্ত ছিল, যা ভারতীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং তাদের একতাবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। আর্মস অ্যাক্ট (১৮৭৮), দেশীয় সংবাদপত্র আইন (১৮৭৮) ইত্যাদিও ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছিল।
* সংবাদপত্র ও সাহিত্যের ভূমিকা: সংবাদপত্রগুলি (যেমন, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য হিন্দু, বেঙ্গলি, সোমপ্রকাশ) এবং দেশাত্মবোধক সাহিত্য (যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ', হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা) ব্রিটিশ শাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে জনমত গঠন করে এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
* যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি: রেলপথ, টেলিগ্রাফ, ডাক ব্যবস্থার উন্নতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করে তোলে, যা রাজনৈতিক সংগঠনগুলির কার্যকলাপ প্রসারে এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের একত্রিত হতে সাহায্য করে।
#### ২. প্রাথমিক রাজনৈতিক সমিতি (Early Political Associations)
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে আঞ্চলিক এবং সর্বভারতীয় স্তরে বেশ কিছু রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে। এগুলি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসারে এবং ভারতীয়দের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
* ভূমি-অধিকারী সমিতি (Landholders’ Society) – ১৮৩৮: এটি ছিল ভারতের প্রথম সংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। দ্বারকানাথ ঠাকুর এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা করা।
* ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (British India Society) – ১৮৩৯: এটি লন্ডনে উইলিয়াম অ্যাডামস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।
* ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (British Indian Association) – ১৮৫১: ভূমি-অধিকারী সমিতি ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে এটি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব এবং সম্পাদক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটি আইনসভায় ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব, বিচার বিভাগের সংস্কার, লবণ কর হ্রাস ইত্যাদি দাবি জানায়।
* পুনার সার্বজনিক সভা (Poona Sarvajanik Sabha) – ১৮৬৭: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে (M.G. Ranade) এবং জি.ভি. যোশী এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এটি সরকারি নীতি সম্পর্কে জনগণের মতামত সংগ্রহ করত এবং সরকারকে তা জানাত।
* ইন্ডিয়ান লীগ (Indian League) – ১৮৭৫: শিশির কুমার ঘোষ কলকাতায় এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল শক্তিশালী জনমত গঠন এবং রাজনৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবোধ জাগানো।
* ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন / ভারত সভা (Indian Association / Indian National Association) – ১৮৭৬: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আনন্দমোহন বসু কলকাতায় এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল কংগ্রেসের পূর্ববর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি শক্তিশালী জনমত তৈরি করা, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা এবং ভারতীয়দের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায় করা। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়স কমানোর বিরুদ্ধে (১৮৭৭-৭৮) এবং ইলবার্ট বিলের সমর্থনে (১৮৮৩) এই সমিতি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন পরিচালনা করে।
* মাদ্রাজ মহাজন সভা (Madras Mahajan Sabha) – ১৮৮৪: এম. ভিরারাঘাভাচরি, জি. সুব্রামানিয়াম আইয়ার এবং পি. আনন্দচারলু এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
* বোম্বাই প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন (Bombay Presidency Association) – ১৮৮৫: ফিরোজ শাহ মেহতা, কে.টি. তেলাং এবং বদরুদ্দিন তৈয়বজি এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
এই প্রাথমিক সমিতিগুলি আঞ্চলিক ও সর্বভারতীয় স্তরে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে এবং পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
#### ৩. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা (১৮৮৫)
* প্রতিষ্ঠার তারিখ: ২৮শে ডিসেম্বর, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ।
* প্রতিষ্ঠাতা: একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ আমলা, অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম (A.O. Hume)।
* প্রথম অধিবেশন:
* স্থান: বোম্বাইয়ের গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজ (Gokuldas Tejpal Sanskrit College)।
* সভাপতি: উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (W.C. Bonnerjee)।
* প্রতিনিধি সংখ্যা: ৭২ জন প্রতিনিধি এই অধিবেশনে যোগ দেন।
* প্রাথমিক নাম: A.O. হিউম প্রাথমিকভাবে এর নাম দিয়েছিলেন 'ভারতীয় জাতীয় ইউনিয়ন' (Indian National Union)। পরে দাদাভাই নওরোজির পরামর্শে এর নাম পরিবর্তন করে 'ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস' রাখা হয়।
* উদ্দেশ্য (প্রাথমিকভাবে): ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা এবং সর্বভারতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।
#### ৪. সেফটি-ভালভ থিসিস (The Safety-valve Thesis)
* ধারণার উৎস: লালা লাজপত রায় তার 'ইয়ং ইন্ডিয়া' (Young India) গ্রন্থে (১৯১৬) প্রথম এই 'সেফটি-ভালভ' (নিরাপত্তা কপাটিকা) তত্ত্বটি তুলে ধরেন।
* মূল ধারণা: এই তত্ত্ব অনুসারে, অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মূলত তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের (Lord Dufferin) পরামর্শে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী অসন্তোষ তীব্র হচ্ছিল। ডাফরিন ও হিউম মনে করতেন, যদি ভারতীয়দের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক পথ তৈরি করা না যায়, তাহলে তা আবার একটি বড় বিদ্রোহের রূপ নিতে পারে। তাই কংগ্রেসকে একটি 'সেফটি-ভালভ' বা নিরাপত্তা কপাটিকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে ভারতীয়দের অসন্তোষ শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হবে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক গণবিস্ফোরণ এড়ানো যাবে।
* সমালোচনা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি: আধুনিক ঐতিহাসিকরা, যেমন বিপান চন্দ্র, সুমিত সরকার, এই তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, কংগ্রেস কেবলমাত্র ব্রিটিশদের একটি সৃষ্টি ছিল না, বরং এটি ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সচেতনতার স্বাভাবিক পরিণতি। হিউম হয়ত ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষায় এর প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেসের মূল চালিকা শক্তি ছিল ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং ভারতীয়দের নিজস্ব রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকে ভারতীয়দের নিজস্ব প্রচেষ্টার ফল হিসেবেই দেখা উচিত, যেখানে হিউম কেবল একজন সুবিধাপ্রদানকারী (facilitator) ছিলেন।
#### ৫. প্রাথমিক কংগ্রেসের কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য (Programme and objectives of the early Congress)
১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সময়কালকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের 'নরমপন্থী' (Moderates) পর্ব বলা হয়। এই সময়ের কংগ্রেস নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মসূচি ও উদ্দেশ্যগুলি ছিল:
* নরমপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি:
* ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য: নরমপন্থী নেতারা ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের জন্য কল্যাণকর মনে করতেন এবং ব্রিটিশদের ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী ছিলেন।
* নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পথ: তারা নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক উপায়ে (যেমন: আবেদন, নিবেদন, স্মারকলিপি, সভা-সমিতি) দাবি আদায়ে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের পদ্ধতিকে 'আবেদন-নিবেদন নীতি' (Policy of Petitions and Prayers) বলা হয়।
* ব্রিটিশদের সহযোগিতা: তারা বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের সহযোগিতা ছাড়া ভারতের উন্নতি সম্ভব নয়।
* ধীর ও পর্যায়ক্রমিক সংস্কার: তারা দ্রুত কোনো বিপ্লবী পরিবর্তন চাননি, বরং ধীর গতিতে পর্যায়ক্রমিক সংস্কারের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পক্ষপাতী ছিলেন।
* প্রধান উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি:
* প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও আইনসভার সম্প্রসারণ: আইন পরিষদে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি এবং নির্বাচিত সদস্যদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
* আইনসভা ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ: নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার দাবি, যাতে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হয়।
* সিভিল সার্ভিস ভারতীয়করণ: উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগের জন্য সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা ভারতে আয়োজন এবং পরীক্ষার্থীদের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি।
* সামরিক ব্যয় হ্রাস: ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ সামরিক ব্যয় হ্রাস করে সেই অর্থ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করার দাবি।
* কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন: ভূমি রাজস্ব হ্রাস, লবণ কর বিলোপ এবং ভারতীয় শিল্পের সুরক্ষার দাবি।
* গণতান্ত্রিক অধিকার: সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং সভা-সমিতির অধিকার নিশ্চিত করার দাবি।
* জাতীয় ঐক্যের বিকাশ: ভারতের বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা।
* রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও শিক্ষা প্রসারিত করা।
* সীমাবদ্ধতা ও সাফল্য:
* সীমাবদ্ধতা: নরমপন্থীদের আন্দোলন উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারা গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের দাবিগুলি খুব কমই আদায় হয়েছিল।
* সাফল্য: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষিত ভারতীয়দের একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক চরিত্র উন্মোচন করেন এবং জনমানসে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। ভারতের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
#### ৬. অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও ড্রেন থিওরি (Economic Nationalism and Drain Theory)
* ধারণার জন্ম ও প্রবক্তা: ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক শোষণমূলক চরিত্র উন্মোচন করা। এই ধারণা 'অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ' নামে পরিচিত। এর প্রধান প্রবক্তারা ছিলেন – দাদাভাই নওরোজী, রমেশচন্দ্র দত্ত (আর.সি. দত্ত), মহাদেব গোবিন্দ রানাডে (M.G. Ranade), গোপাল কৃষ্ণ গোখলে প্রমুখ।
* সম্পদ নিষ্কাশন তত্ত্ব (Drain Theory): দাদাভাই নওরোজী তার বিখ্যাত গ্রন্থ "Poverty and Un-British Rule in India" (১৯০১) এবং রমেশচন্দ্র দত্ত তার "Economic History of India" (১৯০৩) গ্রন্থে ব্রিটিশদের 'সম্পদ নিষ্কাশন' বা 'ড্রেন থিওরি' ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন।
* তত্ত্বের মূল কথা: এই তত্ত্ব অনুসারে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ইংল্যান্ডে স্থানান্তরিত হচ্ছিল, যার বিনিময়ে ভারত কোনো প্রকৃত অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছিল না। এই একতরফা সম্পদ নিষ্কাশনই ভারতের দারিদ্র্যের মূল কারণ।
* সম্পদ নিষ্কাশনের পথগুলি:
* হোম চার্জেস (Home Charges): ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সামরিক ও অসামরিক কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, ছুটি ভাতা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয়, যা ইংল্যান্ডে পরিশোধ করা হত।
* বাণিজ্যিক মুনাফা: ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির ভারতে অর্জিত বিশাল মুনাফা, যা তারা তাদের দেশে পাঠিয়ে দিত।
* সুদ: ভারতের জন্য গৃহীত ঋণের উপর উচ্চহারে সুদ, যা ইংল্যান্ডকে দিতে হত।
* সামরিক ব্যয়: ভারতের প্রতিরক্ষার নামে চাপানো বিশাল সামরিক ব্যয়, যা ভারতীয়দেরই বহন করতে হত।
* আমলাতান্ত্রিক ব্যয়: ভারতের শাসন ব্যবস্থার জন্য ইংল্যান্ডে রাখা ভারত সচিবের কার্যালয় ও অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয়।
* তাৎপর্য:
* ব্রিটিশ শাসনের মুখোশ উন্মোচন: ড্রেন থিওরি ভারতীয়দের কাছে ব্রিটিশ শাসনের তথাকথিত 'সভ্যতার আলো' ছড়ানোর দাবির আসল রূপ উন্মোচন করে এবং এটি যে আসলে ভারতের শোষণের উপর নির্ভরশীল, তা প্রমাণ করে।
* জাতীয়তাবাদী ঐক্যের ভিত্তি: এই তত্ত্ব ভারতীয়দের মধ্যে অর্থনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে। কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী – সবাই বুঝতে পারে যে তাদের দারিদ্র্যের মূলে রয়েছে ব্রিটিশ শোষণ।
* ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ভিত্তি: এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নরমপন্থী ও চরমপন্থী উভয় ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করে। এটি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে কাজ করে।