উনিশ শতকে ভারতে যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা মূলত উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে এই আন্দোলনগুলি আরও ব্যাপকতা লাভ করে, যা কেবল উচ্চ শ্রেণির নয়, বরং সমাজের নিম্নস্তর, বিশেষত দলিত ও নারী সমাজের সমস্যাগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে। এই সময়ের সংস্কারগুলি ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ, জাতিভেদ প্রথা বিলোপ, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষাবিস্তারের উপর জোর দেয়।
আন্দোলনের প্রধান ধারাগুলি:
১. জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন:
উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের শুরুতে এই আন্দোলন ভারতীয় সমাজ সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্যতা এবং দলিত শ্রেণির উপর আরোপিত সামাজিক বঞ্চনা দূর করা।
* জ্যোতিবা ফুলে (১৮২৭-১৮৯০):
* অবস্থান: মহারাষ্ট্রের একজন অগ্রণী সমাজ সংস্কারক। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি "দলিত" শব্দটি ব্যবহার করেন।
* লক্ষ্য: ব্রাহ্মণদের আধিপত্য ও বর্ণপ্রথার বিরোধিতা, নারী ও দলিতদের শিক্ষার প্রসার।
* সত্যশোধক সমাজ (১৮৭৩): ফুলে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং শোষিত ও দলিতদের অধিকার রক্ষা করা। তিনি বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধিতা করেন এবং বিধবা বিবাহ প্রচলনে সহায়ক ছিলেন।
* গ্রন্থ: 'গুলামগিরি' (Gulamgiri), 'সার্বজনিক সত্যধর্ম পুস্তক' (Sarvajanik Satyadharma Pustak)।
* নারায়ণ গুরু (১৮৫৪-১৯২৮):
* অবস্থান: কেরলের একজন প্রভাবশালী সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক।
* আন্দোলন: তিনি অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। অরুভিপুরম আন্দোলন (১৮৮৮) তার নেতৃত্বে শুরু হয়, যেখানে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
* শ্রী নারায়ণ ধর্ম পরিপালন যোগম (SNDP Yogam, ১৯০৩): এটি প্রতিষ্ঠা করে তিনি দলিতদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ করেন।
* দর্শন: তার বিখ্যাত উক্তি "এক জাতি, এক ধর্ম, এক ঈশ্বর মানবজাতির জন্য" (One Caste, One Religion, One God for Man)।
* ড. বি. আর. আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬):
* অবস্থান: বিশ শতকের ভারতের দলিত আন্দোলনের প্রধান মুখ ও ভারতের সংবিধানের জনক।
* লক্ষ্য: দলিতদের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বর্ণপ্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করা।
* সংগঠন ও কার্যক্রম:
* মূকনায়ক (১৯২০), বহিস্কৃত ভারত (১৯২৭), সমতা (১৯২৮): তার দ্বারা প্রকাশিত পত্রিকাগুলি দলিতদের অধিকারের মুখপত্র ছিল।
* মাহাদ সত্যাগ্রহ (১৯২৭): দলিতদের সরকারি পুকুরের জল ব্যবহারের অধিকারের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়।
* নিখিল ভারত দলিত শ্রেণি ফেডারেশন (All India Depressed Classes Federation, ১৯৪২): দলিতদের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করার জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
* পুনা চুক্তি (১৯৩২): গোলটেবিল বৈঠকে দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচন মণ্ডলীর দাবিতে আম্বেদকরের প্রস্তাবের পর মহাত্মা গান্ধীর অনশনের প্রেক্ষিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে দলিতদের জন্য প্রাদেশিক আইনসভা ও কেন্দ্রীয় আইনসভায় আসন সংরক্ষিত হয়, কিন্তু পৃথক নির্বাচন মণ্ডলী বাতিল করা হয়। এটি দলিত রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়।
* বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ: ১৯৫৬ সালে আম্বেদকর লক্ষ লক্ষ অনুগামী নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন, যা দলিতদের আত্মমর্যাদা ও সামাজিক মুক্তির পথ হিসেবে বিবেচিত হয়।
* ই. ভি. রামস্বামী 'পেরিয়ার' (১৮৭৯-১৯৭৩):
* অবস্থান: তামিলনাড়ুর একজন প্রভাবশালী সমাজ সংস্কারক ও রাজনৈতিক নেতা।
* আন্দোলন: তিনি আত্মসম্মান আন্দোলন (Self-Respect Movement, ১৯২৫) শুরু করেন, যা ব্রাহ্মণদের আধিপত্য এবং বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে ছিল। তিনি দ্রাবিড় আন্দোলনেরও (Dravidian Movement) একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন।
* দর্শন: যুক্তিবাদের উপর জোর, দেব-দেবী ও ধর্মীয় কুসংস্কারের তীব্র বিরোধিতা।
* মহাত্মা গান্ধী:
* অবস্থান: যদিও গান্ধীজির মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা আন্দোলন, তিনি অস্পৃশ্যতাকে "হিন্দু ধর্মের কলঙ্ক" বলে মনে করতেন এবং এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেন।
* হরিজন সেবা সংঘ (১৯৩২): তিনি অস্পৃশ্যদের "হরিজন" (ঈশ্বরের সন্তান) আখ্যা দেন এবং তাদের উন্নতির জন্য এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
* হরিজন পত্রিকা: দলিতদের অধিকার ও তাদের সামাজিক উন্নয়নের বিষয়ে জনমত গঠনের জন্য তিনি এই পত্রিকা প্রকাশ করেন।
২. নারী সংস্কার আন্দোলন:
উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় প্রমুখের হাত ধরে নারী সংস্কারের যে বীজ বপিত হয়েছিল, বিশ শতকে তা আরও বিকশিত হয়।
* বাল্যবিবাহ ও আইন: বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলস্বরূপ শারদা আইন (Sarda Act, ১৯২৯) পাশ হয়। এই আইন অনুযায়ী, মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর এবং ছেলেদের ১৮ বছর ধার্য করা হয়।
* নারী শিক্ষা:
* ধন্দো কেশব কার্ভে (D. K. Karve): তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি পুনেতে ভারতের প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
* পণ্ডিতা রমাবাই সরস্বতী (Pandita Ramabai Saraswati): তিনি বিধবা ও অসহায় নারীদের জন্য শারদা সদন (Sharda Sadan, ১৮৮৯) প্রতিষ্ঠা করেন।
* পর্দা প্রথা বিরোধী আন্দোলন: মুসলিম সমাজে পর্দা প্রথার বিরোধিতা করে অনেকে এগিয়ে আসেন।
* মাতৃ মঙ্গলের উন্নয়ন: নারীদের স্বাস্থ্য ও মাতৃ মঙ্গলের উন্নয়নে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ শুরু করে।
৩. মুসলিম সমাজ সংস্কার আন্দোলন:
উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে মুসলিম সমাজের মধ্যেও আধুনিকীকরণ ও সংস্কারের প্রবণতা দেখা যায়।
* আলিগড় আন্দোলন (Aligarh Movement):
* নেতৃত্ব: স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন।
* লক্ষ্য: মুসলিম সমাজের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানো, এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করা।
* আলিগড় অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ (১৮৭৫): এটি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯২০) রূপান্তরিত হয়।
* প্রভাব: এটি মুসলিম সমাজের মধ্যে একটি আধুনিক ও শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করতে সহায়ক হয়, যদিও এর রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিতর্ক আছে।
* দেওবন্দ স্কুল (Deoband School):
* নেতৃত্ব: মুহাম্মদ কাসিম নানুতবি ও রশিদ আহমদ গাংগুহি দ্বারা ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত।
* লক্ষ্য: এটি আলিগড় আন্দোলনের বিপরীত ধারার ছিল, যা ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ সংরক্ষণের উপর জোর দিত। তারা ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরোধিতা করত।
* প্রভাব: এটি ধর্মীয় ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজের মধ্যে রক্ষণশীল ধারার জন্ম দেয়, তবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি তারা সহানুভূতিশীল ছিল।
৪. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও সংস্কারক:
* গোপাল কৃষ্ণ গোখলে:
* ভারত সেবক সমাজ (Servants of India Society, ১৯০৫): তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশসেবায় ব্রতী হওয়া এবং সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে কাজ করা।
* আর্য সমাজ (দয়ানন্দ সরস্বতী):
* উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর প্রভাব বিশ শতকেও ছিল। তারা শুద్ధి আন্দোলন, বাল্যবিবাহ ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা এবং নারী শিক্ষার প্রসারে কাজ করে।
* রামকৃষ্ণ মিশন (বিবেকানন্দ):
* স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২) নেতৃত্বে রামকৃষ্ণ মিশন (১৮৯৭) সেবাধর্ম ও জনকল্যাণের উপর জোর দেয়। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দরিদ্রদের সাহায্যে সক্রিয় ছিল, যা সামাজিক সংস্কারেরই অংশ।
আন্দোলনগুলির বৈশিষ্ট্য:
* ব্যাপকতা: উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যেও আন্দোলনের প্রসার।
* আঞ্চলিক বৈচিত্র্য: মহারাষ্ট্র, কেরালা, তামিলনাড়ু, বাংলা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিজস্ব ধারার আন্দোলন গড়ে ওঠে।
* ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয়: প্রতিটি আন্দোলন তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয় বজায় রেখে সংস্কারের চেষ্টা করে।
* পশ্চিমী প্রভাব বনাম দেশীয় ঐতিহ্য: কিছু আন্দোলন পশ্চিমী যুক্তিবাদ ও আধুনিক শিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত ছিল, আবার কিছু আন্দোলন দেশীয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুত্থানের মাধ্যমে সংস্কার চেয়েছিল।
* সরকার ও সংস্কারকদের সম্পর্ক: অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার সংস্কারকদের সমর্থন করেছে (যেমন, শারদা আইন পাশ), আবার কিছু ক্ষেত্রে তাদের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে।
গুরুত্ব ও প্রভাব:
* সামাজিক পরিবর্তন: এই আন্দোলনগুলি বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা (যদিও পূর্বে আইন হয়েছিল, এর প্রভাব তখনও ছিল), অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথা ইত্যাদি বহু কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ও সেগুলিকে নির্মূল করতে সহায়তা করে।
* সচেতনতা বৃদ্ধি: সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারী ও দলিতদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
* জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি: সামাজিক ন্যায় ও সমতার এই আন্দোলনগুলি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে, কারণ সামাজিক বিভেদ দূর করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন জাতীয়তাবাদের জন্য অপরিহার্য ছিল।
* দুর্বল অংশের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি: দলিত ও নারী আন্দোলনের ফলে সমাজের এই দুর্বল অংশগুলি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ হয়।