দেওয়ানির হস্তান্তর এবং বাংলায় এর প্রভাব (The Transfer of Diwani and its impact in Bengal)

ইতিহাস সিলেবাসের জন্য "দেওয়ানির হস্তান্তর এবং বাংলায় এর প্রভাব" শীর্ষক বিস্তারিত নোট দেওয়া হলো।

দেওয়ানি (Diwani) ছিল মুঘল সাম্রাজ্যে রাজস্ব আদায় ও অসামরিক বিচার পরিচালনার অধিকার। সুবাদার বা প্রাদেশিক শাসকরা নিজামত (প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও সামরিক ব্যবস্থা) এবং দেওয়ানি (রাজস্ব ও অসামরিক বিচার) উভয় দায়িত্ব পালন করতেন।


### ২. প্রেক্ষাপট: দেওয়ানি হস্তান্তরের পটভূমি

* পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) ও বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪): পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফরকে বাংলার নবাব করা হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই ক্ষমতার মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা কোম্পানির হাতে আসে বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪) বিজয়ের পর। এই যুদ্ধে ইংরেজরা বাংলার নবাব মীরকাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম-এর সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে।

* মুঘল সম্রাটের দুর্বলতা: বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম অত্যন্ত দুর্বল ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। তাঁর কাছে ইংরেজদের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

* কোম্পানির আকাঙ্ক্ষা: বক্সারের যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাবকে নিয়ন্ত্রণ করে পরোক্ষ শাসনের পরিবর্তে সরাসরি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হাতে নিতে আগ্রহী ছিল। বিশেষত, বাংলার বিশাল রাজস্ব আয় তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, যা দিয়ে তারা ভারতে তাদের সামরিক ব্যয় এবং ব্রিটেনে পণ্য ক্রয়ের খরচ মেটাতে পারত।


### ৩. দেওয়ানি লাভ: এলাহাবাদের চুক্তি (১৭৬৫)

বক্সারের যুদ্ধের পর, রবার্ট ক্লাইভ (যিনি ১৭৬৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন) মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার সঙ্গে এলাহাবাদে দুটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিগুলির মাধ্যমে কোম্পানি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার দেওয়ানি লাভ করে।


* তারিখ: ১২ই আগস্ট, ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ।

* চুক্তির পক্ষগণ: মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (প্রতিনিধি: রবার্ট ক্লাইভ)।

* চুক্তির শর্তাবলী:

    * মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি (রাজস্ব আদায় ও অসামরিক বিচার) ক্ষমতা প্রদান করেন।

    * কোম্পানি অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার কাছ থেকে কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ দুটি নিয়ে মুঘল সম্রাটকে প্রদান করে।

    * কোম্পানি বাংলার নবাব নজম-উদ-দৌলাকে নিজামত (প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা) পরিচালনার জন্য ৫৩ লক্ষ টাকা বার্ষিক ভাতা দিতে সম্মত হয়।

    * মুঘল সম্রাট কোরা ও এলাহাবাদ অঞ্চল কোম্পানিকে দেন এবং অযোধ্যার নবাবের থেকে প্রাপ্ত বেনারস ও গাজিপুর অঞ্চলের জায়গির কোম্পানিকে প্রদান করেন।


### ৪. দ্বৈত শাসন (Dual Government): ১৭৬৫-১৭৭২

দেওয়ানি লাভের পর রবার্ট ক্লাইভ বাংলায় এক নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, যা 'দ্বৈত শাসন' নামে পরিচিত।


* সংজ্ঞা: এই ব্যবস্থায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি (রাজস্ব আদায়) ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখে, আর নিজামত (প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার) ক্ষমতা নামমাত্র নবাবের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।

* প্রকৃত ক্ষমতা: যদিও নবাবের হাতে নিজামত ছিল, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা কোম্পানির হাতেই ছিল, কারণ সামরিক বাহিনী ও রাজস্ব আয়ের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। কোম্পানি নবাবকে নিজামত পরিচালনার জন্য ভাতা দিত।

* উদ্দেশ্য: ক্লাইভ জানতেন যে, সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করলে ফরাসি ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি এবং দেশীয় রাজাদের বিরোধিতা দেখা যেতে পারে। তাই, আইনগতভাবে মুঘল সম্রাটের অধীনে থেকে কোম্পানির পক্ষে পরোক্ষভাবে শাসনভার চালানোই দ্বৈত শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এর ফলে, ক্ষমতা কোম্পানির হাতে এলেও, দায়ভার নবাবের উপর থাকত।

* কার্যক্রম:

    * রাজস্ব আদায়ের জন্য কোম্পানি বাংলার জন্য মহম্মদ রেজা খান, বিহারের জন্য সিতাব রায় এবং উড়িষ্যার জন্য রায় দুর্লভকে (পরে উড়িষ্যাও মহম্মদ রেজা খানের অধীনে আসে) নায়েব দেওয়ান বা উপ-দেওয়ান নিযুক্ত করে। এরা কোম্পানির অধীনে রাজস্ব আদায় করতেন।

    * নবাবের প্রতিনিধিরা আইন-শৃঙ্খলা ও বিচার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু তাদের কার্যকারিতা ছিল সীমিত।

* সময়কাল: ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত এই দ্বৈত শাসন চলেছিল।


### ৫. দেওয়ানি ও দ্বৈত শাসনের প্রভাব

দেওয়ানি লাভ এবং দ্বৈত শাসন বাংলার অর্থনীতি, সমাজ ও প্রশাসনে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।


* ক. অর্থনৈতিক প্রভাব:

    * সম্পদের নির্গমন (Drain of Wealth): বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ব্রিটেনে পাচার হতে শুরু করে। কোম্পানি রাজস্ব বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ভারত থেকে পণ্য কিনে তা ব্রিটেনে রফতানি করত, ফলে ব্রিটেনের থেকে ভারতে কোনো অর্থ আসত না। এটি বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

    * কৃষকদের দুর্দশা: কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ে মনোযোগী হয়। অতিরিক্ত করের চাপে কৃষকরা ভূমিহীন ও দরিদ্র হতে শুরু করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ফসলহানির সময়ও কর মওকুফ করা হতো না।

    * শিল্প ও বাণিজ্যের অবক্ষয়: বাংলার ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্প ও অন্যান্য কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য নীতি, দেশীয় তাঁতিদের উপর নির্যাতন, কাঁচামাল জোর করে কম দামে ক্রয় এবং উৎপাদিত পণ্য চড়া দামে বিক্রি ইত্যাদি কারণে বাংলার সমৃদ্ধ শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে।

    * ১৭৭০ সালের মন্বন্তর (ছিয়াত্তরের মন্বন্তর): দ্বৈত শাসনের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি ছিল ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের (বাংলা ১১৭৬ সন) ভয়াবহ মন্বন্তর। এর মূল কারণ ছিল কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের তীব্র চাপ, কৃষকদের উপর অত্যাচার এবং খাদ্য মজুদকরণে কোম্পানির উদাসীনতা ও অসহযোগিতা। এই মন্বন্তরে বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়।


* খ. প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাব:

    * প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা: নিজামত অর্থাৎ শাসন ও বিচার ব্যবস্থা নবাবের হাতে থাকলেও, রাজস্বের অভাব এবং কোম্পানির অসহযোগিতার কারণে আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। বাংলায় চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বৃদ্ধি পায়।

    * নবাবের ক্ষমতাহীনতা: নবাব নামমাত্র শাসক ছিলেন। তাঁর কোনো প্রকৃত ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব ছিল না।

    * দুর্নীতি বৃদ্ধি: কোম্পানির কর্মচারী ও নায়েব দেওয়ানরা অবাধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ করত। ক্লাইভ নিজেও দেওয়ানি লাভের সময় প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন।

    * কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতার সুদৃঢ়ীকরণ: দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার একচ্ছত্র রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এটি ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে।


* গ. সামাজিক প্রভাব:

    * অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও মন্বন্তর বাংলার সমাজ জীবনে চরম বিপর্যয় নিয়ে আসে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ভয়াবহভাবে নেমে যায়।

    * সমাজপতি ও প্রভাবশালী শ্রেণীর ক্ষমতা হ্রাস পায়, কারণ তারা কোম্পানির প্রভাবের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে।


### ৬. দ্বৈত শাসনের অবসান

* কারণ: দ্বৈত শাসনের ফলে কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি, চরম অর্থনৈতিক শোষণ এবং ১৭৭০ সালের ভয়াবহ মন্বন্তর ব্রিটেনে কোম্পানির বিরুদ্ধে তীব্র জনমত তৈরি করে। কোম্পানিও নিজেদের ক্ষতির মুখ দেখছিল।

* অবসান: ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে নবনিযুক্ত গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান এবং বাংলার শাসনভার সরাসরি কোম্পানির হাতে তুলে দেন। নবাবের ভাতা কমিয়ে ৩২ লক্ষ টাকায় নামানো হয় এবং মহম্মদ রেজা খান সহ সকল নায়েব দেওয়ানকে বরখাস্ত করা হয়।


### ৭. গুরুত্ব ও উপসংহার

দেওয়ানি লাভ এবং এর ফলস্বরূপ সৃষ্ট দ্বৈত শাসন বাংলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি কেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্থানের পথ প্রশস্ত করেনি, বরং বাংলার সমৃদ্ধি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন হয় এবং বাংলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম ও প্রধান অর্থনৈতিক উৎস কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও প্রতিফলিত হয়েছিল, যা ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক শোষণের স্বরূপ উন্মোচন করেছিল।