১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাস: লীগ অফ নেশনস, সম্মিলিত নিরাপত্তা, নাৎসিবাদের ও ফ্যাসিবাদীর উত্থান (জার্মানি, ইতালি ও জাপান), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

ইতিহাস সিলেবাসের "১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাস" অংশের জন্য বিস্তারিত নোট দেওয়া হলো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) অবসানের পর বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই জাতিসমূহের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ধারণার জন্ম হয়। কিন্তু একদিকে যেমন লীগ অফ নেশনস বা জাতিপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা শান্তিরক্ষার চেষ্টা করছিল, অন্যদিকে তেমনই অর্থনৈতিক সংকট, জাতিগত বিদ্বেষ ও সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষার ফলস্বরূপ ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মতো আগ্রাসী মতাদর্শের উত্থান ঘটে, যা শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


১. লীগ অফ নেশনস (জাতিপুঞ্জ) ও সম্মিলিত নিরাপত্তা

* প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য:

    * প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের "চৌদ্দ দফা নীতি"-র অন্যতম প্রস্তাব হিসেবে ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়।

    * এর সদর দফতর ছিল সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে।

    * প্রধান উদ্দেশ্য: আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, নিরস্ত্রীকরণ, এবং আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান করে বিশ্বশান্তি বজায় রাখা।


* সম্মিলিত নিরাপত্তা (Collective Security):

    * জাতিপুঞ্জের অন্যতম মৌলিক নীতি ছিল 'সম্মিলিত নিরাপত্তা'। এর অর্থ ছিল, "এক রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ সমগ্র জাতিপুঞ্জভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের উপর আক্রমণ" বলে গণ্য হবে।

    * এই নীতি অনুযায়ী, কোনো আগ্রাসী রাষ্ট্রকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা হবে এবং আক্রান্ত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করা হবে। এটি ছিল জাতিপুঞ্জের সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি।


* সাফল্য (আংশিক):

    * জাতিপুঞ্জ কিছু ছোটখাটো আন্তর্জাতিক বিরোধ মেটাতে সফল হয়েছিল, যেমন - ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মধ্যে আল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের বিবাদ (১৯২১), গ্রীস ও বুলগেরিয়ার সীমান্ত বিরোধ (১৯২৫)।

    * স্বাস্থ্য, শ্রম অধিকার, নারী ও শিশু পাচার রোধ প্রভৃতি সামাজিক ক্ষেত্রেও কিছু ইতিবাচক কাজ করেছিল।


* ব্যর্থতা ও পতন:

    * মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান না করা: জাতিপুঞ্জের প্রধান রূপকার উইলসনের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাই জাতিপুঞ্জের সদস্য হয়নি, যা এর নৈতিক ও আর্থিক শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।

    * পেশী শক্তির অভাব: জাতিপুঞ্জের নিজস্ব কোনো সামরিক বাহিনী ছিল না, যার ফলে আগ্রাসী রাষ্ট্রকে সামরিকভাবে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না।

    * সর্বসম্মতির নীতি: কোনো প্রস্তাব পাশ করতে হলে সকল সদস্য রাষ্ট্রের সর্বসম্মতি প্রয়োজন হত, যা প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিত।

    * বৃহৎ শক্তিগুলোর অসহযোগিতা: জার্মানি, ইতালি, জাপানের মতো আগ্রাসী শক্তিগুলোর কার্যকলাপ থামাতে জাতিপুঞ্জ ব্যর্থ হয়।

    * আগ্রাসী কার্যকলাপের প্রতিরোধে ব্যর্থতা:

        * জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল (১৯৩১): জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ ও দখল করলে জাতিপুঞ্জ কেবল নিন্দা করেই ক্ষান্ত হয়, কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। জাপান জাতিপুঞ্জ ত্যাগ করে।

        * ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ (১৯৩৫): ইতালি আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) আক্রমণ করলে জাতিপুঞ্জ কেবল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা অকার্যকর প্রমাণিত হয়। ইতালিও জাতিপুঞ্জ ত্যাগ করে।

        * জার্মানির আগ্রাসন: জার্মানি রাইনল্যান্ডে সৈন্য প্রবেশ (১৯৩৬), অস্ট্রিয়া দখল (১৯৩৮), চেকোস্লোভাকিয়া দখল (১৯৩৮-৩৯) ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জ নিষ্ক্রিয় ছিল।

    * মিউনিখ চুক্তি (১৯৩৮) ও তুষ্টি নীতি: ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আগ্রাসী জার্মানিকে তুষ্ট করার (Appeasement Policy) নীতি জাতিপুঞ্জকে আরও দুর্বল করে দেয়।

    * দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জাতিপুঞ্জের কার্যকারিতা সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়।


২. ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উত্থান (জার্মানি, ইতালি ও জাপান)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউরোপে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ ও স্বৈরাচারী শাসনের উত্থান ঘটে, যা ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ নামে পরিচিত।


* সাধারণ কারণ:

    * প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া: পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে সৃষ্ট হতাশা, ভ্যার্সাই চুক্তির অপমান (বিশেষ করে জার্মানির ক্ষেত্রে)।

    * অর্থনৈতিক মহামন্দা (১৯২৯): বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি করে, যা গণতন্ত্রের উপর মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয় এবং চরমপন্থী মতাদর্শের পথ খুলে দেয়।

    * গণতন্ত্রের দুর্বলতা: নবগঠিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির অদক্ষতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থতা।

    * সাম্যবাদের ভয়: ইতালির বুর্জোয়া শ্রেণী ও জার্মানির শিল্পপতিরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আশঙ্কায় ফ্যাসিবাদী ও নাৎসি দলের প্রতি সমর্থন জানায়।

    * রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা: বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘাত ও অস্থিরতা।


ক. ইতালির ফ্যাসিবাদ:

    * প্রতিষ্ঠা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে চরম অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে বেনিটো মুসোলিনি 'ফ্যাসিবাদী দল' (Fascist Party) গঠন করেন।

    * ক্ষমতা দখল: ১৯২২ সালে মুসোলিনি তার 'কালো কোর্তা' (Black Shirts) বাহিনী নিয়ে রোম অভিযান (March on Rome) করেন এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী হন। পরে তিনি নিজেকে স্বৈরাচারী শাসক 'ইল ডুচে' (Il Duce) ঘোষণা করেন।

    * নীতি:

        * চরম জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ।

        * গণতন্ত্রের বিরোধিতা, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিলোপ সাধন।

        * রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা (State is everything, individual is nothing)।

        * কৃষি, শিল্প ও সামরিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।

        * জাতিপুঞ্জের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আবিসিনিয়া (১৯৩৫), আলবেনিয়া (১৯৩৯) প্রভৃতি দখল করে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা।


খ. জার্মানির নাৎসিবাদ:

    * প্রতিষ্ঠা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উপর আরোপিত ভ্যার্সাই চুক্তির কঠোর শর্তাবলী এবং ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা জার্মানির নবগঠিত ওয়েমার প্রজাতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে অ্যাডলফ হিটলার ও তার 'ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি' (Nationalsozialistische Deutsche Arbeiterpartei - NSDAP) বা সংক্ষেপে 'নাৎসি দল'-এর উত্থান ঘটে।

    * ক্ষমতা দখল: ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন এবং দ্রুত নিজেকে 'ফিউরার' (Führer - নেতা) ঘোষণা করে একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

    * নীতি:

        * চরম জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ: 'লেবেনস্রাউম' (Lebensraum) বা জীবনধারণের স্থান প্রসারের নামে জার্মানির সীমানা বিস্তারের নীতি গ্রহণ।

        * আর্য শ্রেষ্ঠত্ব ও ইহুদি বিদ্বেষ: জার্মানদের 'আর্য' জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ দাবি করা এবং ইহুদিদের জার্মানির সকল দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার (হলোকাস্ট) ও গণহত্যা চালানো।

        * গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের বিরোধিতা।

        * ভার্সাই চুক্তির লঙ্ঘন: জার্মানির সামরিকীকরণ, রাইনল্যান্ডে সৈন্য মোতায়েন, অস্ট্রিয়া দখল (Anschluss, ১৯৩৮), চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেন অঞ্চল দখল (মিউনিখ চুক্তি, ১৯৩৮) এবং পরবর্তীতে সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া দখল।

        * 'মেইন ক্যাম্পফ' (Mein Kampf) হিটলারের আত্মজীবনী ও রাজনৈতিক মতাদর্শের দলিল।

        * হিটলারের ব্রাউন শার্ট বাহিনী ও গেস্টাপো (গোপন পুলিশ) ছিল নাৎসিবাদের হাতিয়ার।


গ. জাপানের সামরিকবাদ:

    * কারণ:

        * প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানেও অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়।

        * কাঁচামালের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে তোলে।

        * পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি অবিশ্বাস এবং এশিয়ায় নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা।

        * রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব।

    * আগ্রাসী নীতি:

        * জাপানের সামরিক নেতারা দেশের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেন।

        * মাঞ্চুরিয়া দখল (১৯৩১): জাপানের কোয়ান্টুং সেনাবাহিনী চীনের মাঞ্চুরিয়া দখল করে 'মাঞ্চুকুও' নামক পুতুল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা জাতিপুঞ্জ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়।

        * চীন আক্রমণ (১৯৩৭): জাপানের সেনাবাহিনী চীনে ব্যাপক আগ্রাসন চালায়, যা দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের সূচনা করে।

        * দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা।

    * অক্ষশক্তির জোট: জার্মানি, ইতালি ও জাপান আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী হয়ে ওঠে। ১৯৩৬ সালে জার্মানি ও ইতালির মধ্যে রোম-বার্লিন অক্ষচুক্তি এবং ১৯৪০ সালে জাপানের যোগদানের মাধ্যমে রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট গঠিত হয়।


৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫)

ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ও সামরিকবাদের আগ্রাসী নীতি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা বিশ্বকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।


* কারণসমূহ:

    * ভ্যার্সাই চুক্তির ত্রুটিপূর্ণ ও কঠোর শর্তাবলী: জার্মানির উপর চাপানো অপমানজনক শর্তগুলি জার্মানদের মধ্যে প্রতিশোধের মনোভাব জাগিয়ে তোলে এবং হিটলারের উত্থানের পথ প্রশস্ত করে। জার্মানির ভূখণ্ড হ্রাস, বিপুল ক্ষতিপূরণ (যুদ্ধাপরাধীর তকমা) এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণ ছিল এর মূল বিষয়।

    * জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা: জাতিপুঞ্জের দুর্বলতা এবং আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়।

    * ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের আগ্রাসী নীতি: জার্মানির লেবেনস্রাউম নীতি, ইতালির সাম্রাজ্যবাদ এবং জাপানের সামরিকবাদী নীতি বিশ্বশান্তি বিনষ্ট করে।

    * তুষ্টি নীতি (Appeasement Policy): ব্রিটেন (নেভিল চেম্বারলেইন) ও ফ্রান্সের আগ্রাসী শক্তি, বিশেষ করে হিটলারকে শান্ত রাখার জন্য বারবার ছাড় দেওয়ার নীতি (যেমন: মিউনিখ চুক্তি, ১৯৩৮)। এই নীতি হিটলারকে আরও সাহসী করে তোলে।

    * অর্থনৈতিক মহামন্দা (১৯২৯): মন্দার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ ও সামাজিক অস্থিরতা বিভিন্ন দেশে চরমপন্থী শক্তির উত্থান ঘটায়।

    * জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা: নাৎসিবাদের ইহুদি বিদ্বেষ ও আর্য শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা জাতিগত সংঘাতকে তীব্র করে।

    * অক্ষশক্তির জোট গঠন: জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মধ্যে সামরিক জোট আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করে।

    * রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমী দেশগুলির অবিশ্বাস: জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ১৯৩৯ সালের অনাক্রমণ চুক্তি (মলোটোভ-রিবেনট্রপ চুক্তি) পশ্চিমী দেশগুলির জন্য এক বড় ধাক্কা ছিল।

    * তাৎক্ষণিক কারণ: ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ। এর প্রতিক্রিয়ায় ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।


* গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী (সংক্ষিপ্ত):

    * ১৯৩৯-৪১: জার্মানির ব্লিৎসক্রিগ (Blitzkrieg - বিদ্যুৎগতির যুদ্ধ) কৌশল দ্বারা পোল্যান্ড, ফ্রান্স, নরওয়ে, ডেনমার্ক সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশ দখল।

    * ১৯৪১: জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ (অপারেশন বারবারোসা)। জাপানের পার্ল হারবারে (মার্কিন নৌঘাঁটি) আক্রমণ, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগ দেয়।

    * ১৯৪২-৪৩: স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ (জার্মানির পরাজয়), উত্তর আফ্রিকা ও ইতালিতে মিত্রশক্তির অভিযান।

    * ১৯৪৪: ডি-ডে (নরম্যান্ডিতে মিত্রশক্তির অবতরণ), জার্মানির পতন শুরু।

    * ১৯৪৫: হিটলারের আত্মহনন, জার্মানির আত্মসমর্পণ (মে, ১৯৪৫)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিরোশিমা (৬ আগস্ট) ও নাগাসাকিতে (৯ আগস্ট) পারমাণবিক বোমা হামলা। জাপানের আত্মসমর্পণ (২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান।


* ফলাফল ও পরিণতি:

    * ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি: প্রায় ৬-৮ কোটি মানুষের মৃত্যু, অগণিত পঙ্গু, এবং ইতিহাসের বৃহত্তম অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ধ্বংসযজ্ঞ।

    * জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা: বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য অধিকতর শক্তিশালী এবং কার্যকরী আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘ (United Nations Organization - UNO) প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর)।

    * ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্লক) এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (সমাজতান্ত্রিক ব্লক) - এই দুটি পরাশক্তির উদ্ভব হয় এবং তাদের মধ্যে আদর্শগত ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা 'ঠান্ডা যুদ্ধ' নামে পরিচিত।

    * উপনিবেশবাদের অবসান: যুদ্ধ-পরবর্তী দুর্বল উপনিবেশিক শক্তিগুলো (ব্রিটেন, ফ্রান্স) তাদের উপনিবেশগুলো ধরে রাখতে অক্ষম হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে (যেমন ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ইত্যাদি)।

    * জার্মানির বিভাজন: জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিতে বিভক্ত হয় এবং উভয় অংশই যথাক্রমে সোভিয়েত ও পশ্চিমা প্রভাব বলয়ে চলে যায়। বার্লিনও বিভক্ত হয়।

    * পারমাণবিক যুগের সূচনা: পারমাণবিক অস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতা বিশ্বকে নতুন এক হুমকির মুখে ফেলে দেয়।

    * বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি: যুদ্ধের প্রয়োজনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটে।

    * নারীর ভূমিকা বৃদ্ধি: যুদ্ধে পুরুষদের অনুপস্থিতিতে নারীরা কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা তাদের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায়।


উপসংহার:

১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সালের সময়কাল ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক অস্থির ও পরিবর্তনশীল অধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শান্তির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের আগ্রাসী উত্থান এক ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। এই যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে, যার রেশ আজও বিদ্যমান। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মানবাধিকার এবং বিশ্বশান্তি বজায় রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে মানবজাতিকে এক কঠিন শিক্ষা দেয়।