বিশ্ব ইতিহাস: সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও যুদ্ধ (Imperialism, Colonialism and War)

ইতিহাস সিলেবাসের "সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও যুদ্ধ" অংশটির উপর বিস্তারিত নোটস দেওয়া হলো।

ভূমিকা: ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগ এবং ২০শ শতাব্দীর প্রথম ভাগ বিশ্ব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সময় ছিল। এই সময়ে একদিকে যেমন ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তার ও উপনিবেশ দখলের তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তেমনি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। এর পাশাপাশি রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দেয়, যা বিশ্ব রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।


১. পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ (Capitalism, Imperialism & Colonialism)

* পুঁজিবাদ (Capitalism): এটি একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদন ও বন্টনের প্রধান উপকরণগুলি (যেমন, জমি, কলকারখানা) ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থাকে এবং মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। শিল্প বিপ্লবের পর পুঁজিবাদের বিকাশ হয় এবং এর ফলস্বরূপ উৎপাদিত পণ্যের জন্য নতুন বাজার ও কাঁচামালের প্রয়োজন দেখা দেয়।

* সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism): এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র বা অঞ্চলের উপর আধিপত্য স্থাপন করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করা।

    * পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্ক: ভি. আই. লেনিন তার বিখ্যাত গ্রন্থ "Imperialism, the Highest Stage of Capitalism" (১৯১৬) -এ দেখিয়েছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত পর্যায়। পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত মূলধন বিনিয়োগের জন্য নতুন ক্ষেত্র, উৎপাদিত পণ্যের জন্য নতুন বাজার এবং সস্তা কাঁচামালের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়, যা তাদের সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঠেলে দেয়।

    * সাম্রাজ্যবাদের কারণ:

        * অর্থনৈতিক কারণ: কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি, অতিরিক্ত মূলধন বিনিয়োগের সুযোগ।

        * রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ: জাতীয় মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধি, কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন।

        * জনসংখ্যাগত কারণ: বর্ধিত জনসংখ্যার পুনর্বাসন।

        * সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণ: "শ্বেতাঙ্গ মানুষের বোঝা" (White Man's Burden) - এর ধারণা অর্থাৎ অনুন্নত জাতিগুলিকে সভ্য করার দায়িত্ববোধ।

* উপনিবেশবাদ (Colonialism): এটি সাম্রাজ্যবাদের একটি বিশেষ রূপ যেখানে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র সরাসরি একটি দুর্বল অঞ্চল বা দেশের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং সেটিকে তার উপনিবেশে পরিণত করে। যেমন, ভারতে ব্রিটিশ শাসন ছিল উপনিবেশবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


২. উপনিবেশের জন্য কাড়াকাড়ি (Scramble for Colonies)

* সময়কাল: মূলত ১৯শ শতাব্দীর শেষ ভাগ (১৮৮০-১৯১৪)।

* আফ্রিকা বিভাজন (Scramble for Africa):

    * আফ্রিকা ছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলির উপনিবেশ দখলের প্রধান কেন্দ্র। ১৮৮০ সালের আগে আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল অনাবিষ্কৃত বা অনধিকৃত ছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে পুরো মহাদেশটি ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।

    * বার্লিন সম্মেলন (Berlin Conference, ১৮৮৪-১৮৮৫): জার্মান চ্যান্সেলর বিসমার্কের উদ্যোগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আফ্রিকার বিভাজনের নিয়মাবলী নির্ধারণ করা হয় এবং কোনো দেশের দাবিকে বৈধতা দিতে হলে সেখানে কার্যকর দখলদারিত্ব থাকতে হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এর ফলে উপনিবেশ দখলের প্রক্রিয়া আরও তীব্র হয়।

    * গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা:

        * বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের কঙ্গো দখল।

        * ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ফাসোদা সংকট (Fashoda Incident, ১৮৯৮), যা সুদানকে কেন্দ্র করে হয়েছিল এবং পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়।

        * বোয়ার যুদ্ধ (Boer Wars, ১৮৯৯-১৯০২): দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ ও ডাচ বসতি স্থাপনকারী (বোয়ার) দের মধ্যে যুদ্ধ, যেখানে ব্রিটিশরা জয়লাভ করে।

* এশিয়াতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা:

    * চীন: ইউরোপীয় শক্তিগুলি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) চীনের উপর "প্রভাব বলয়" (Sphere of Influence) তৈরি করে।

    * মুক্তদ্বার নীতি (Open Door Policy): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে সব দেশের জন্য সমান বাণিজ্যিক সুযোগের পক্ষে এই নীতি ঘোষণা করে (১৮৯৯-১৯০০)।

    * আফিম যুদ্ধ (Opium Wars): ব্রিটেনের দ্বারা চীনে আফিম বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দুটি যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২ ও ১৮৫৬-৬০), যা চীনের উপর অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয়।

    * বক্সার বিদ্রোহ (Boxer Rebellion, ১৯০০): চীনের বিদেশী প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ, যা দমন করা হয়।

* ফলাফল: উপনিবেশের জন্য এই তীব্র কাড়াকাড়ি ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি করে, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


৩. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (The First World War: ১৯১৪-১৯১৮)

* ভূমিকা: এই যুদ্ধ ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম সর্বব্যাপী যুদ্ধ, যা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোকে দুই প্রতিপক্ষ শিবিরে বিভক্ত করে দেয়।

* উৎপত্তি বা কারণসমূহ:

    * সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা: উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা (যেমন, মরক্কো সংকট, বলকান সংকট)।

    * সামরিকবাদ (Militarism): দেশগুলির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা (বিশেষ করে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে নৌ-অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যেমন – ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজ), বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি।

    * জোট ব্যবস্থা (Alliance System): ইউরোপে দুটি প্রধান সামরিক জোটের সৃষ্টি।

        * ত্রিশক্তি জোট (Triple Alliance, ১৮৮২): জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ইতালি (যুদ্ধ শুরু হলে ইতালি নিরপেক্ষ থাকে ও পরে প্রতিপক্ষ জোটে যোগ দেয়)।

        * ত্রিশক্তি আঁতাত (Triple Entente, ১৯০৭): ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া।

    * উগ্র জাতীয়তাবাদ (Aggressive Nationalism): বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব (যেমন, আলসাস-লোরেন নিয়ে ফ্রান্স-জার্মানির বিরোধ, প্যান-স্লাভিজম নিয়ে রাশিয়া-অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বিরোধ)।

    * বলকান সমস্যা: "ইউরোপের বারুদখানা" নামে পরিচিত বলকান অঞ্চল নিয়ে জাতিগত ও রাজনৈতিক উত্তেজনা।

    * তাৎক্ষণিক কারণ: ২৮ জুন, ১৯১৪ তারিখে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রীকে সারাজেভোতে একজন সার্ব জাতীয়তাবাদী ছাত্র গ্যাভরিলো প্রিন্সিপ কর্তৃক হত্যা। এর প্রতিক্রিয়ায় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, যা দ্রুত ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

    * শ্লিফেন পরিকল্পনা (Schlieffen Plan): জার্মানির একটি সামরিক পরিকল্পনা, যা দ্রুত ফ্রান্সকে পরাজিত করে পরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপর জোর দেয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জার্মানি বেলজিয়াম আক্রমণ করলে ব্রিটেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

* প্রভাব বা ফলাফল:

    * ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি: প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ নিহত এবং ২ কোটি মানুষ আহত বা পঙ্গু হয়। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়।

    * রাজনৈতিক পরিবর্তন:

        * চারটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে: জার্মান সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য, রুশ সাম্রাজ্য এবং অটোমান সাম্রাজ্য।

        * নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় (যেমন, চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড)।

        * রাজতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পায়।

        * নারী সমাজে ভোটাধিকারসহ নানা অধিকারের দাবি ওঠে।

    * ভার্সাই চুক্তি (Treaty of Versailles, ১৯১৯): প্যারিস শান্তি সম্মেলনে জার্মানির উপর এই কঠোর চুক্তি চাপানো হয়। এর প্রধান শর্তগুলি ছিল:

        * জার্মানিকে "যুদ্ধাপরাধী" ঘোষণা (ধারা ২৩১ - War Guilt Clause)।

        * বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ (৬৬০ কোটি পাউন্ড)।

        * ভূখণ্ড ও উপনিবেশ হারানো।

        * সামরিক বাহিনীর উপর কঠোর বিধিনিষেধ।

    * জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা (League of Nations, ১৯২০): ভবিষ্যৎ যুদ্ধ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের "চৌদ্দ দফা" নীতির (Fourteen Points) ভিত্তিতে এই আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠিত হয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে যোগ দেয়নি।

    * অর্থনৈতিক প্রভাব: বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা এবং ঋণগ্রস্ততা বৃদ্ধি পায়।

    * রাশিয়ান বিপ্লবের পথ প্রশস্ত: যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার চরম অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট রাশিয়ান বিপ্লবের জন্ম দেয়।

    * দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ: ভার্সাই চুক্তির কঠোর শর্তাবলী, বিশেষ করে জার্মানির উপর চাপানো অসম চুক্তি, জার্মানিতে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয় যা পরবর্তীতে হিটলার ও নাৎসিবাদ উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হয়।


৪. রুশ বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা (Russian Revolution & Establishment of a Socialist State)

* পটভূমি (Pre-Revolution Russia):

    * স্বৈরাচারী জার শাসন: রোমানভ বংশের জার দ্বিতীয় নিকোলাস ছিলেন একজন স্বৈরাচারী শাসক। জনগণের কোনো প্রতিনিধি পরিষদ ছিল না।

    * অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা: রাশিয়া ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক, শিল্পে অনুন্নত। কৃষকরা ছিল ভূমিদাস প্রথার শিকার এবং শ্রমিকরা ছিল অভাবগ্রস্ত ও শোষিত।

    * সামাজিক বৈষম্য: সমাজের উঁচু তলার অভিজাত এবং নিচু তলার কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য ছিল।

    * ১৯০৫ সালের বিপ্লব: রুশো-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় এবং "রক্তাক্ত রবিবার" (Bloody Sunday, ২২ জানুয়ারি, ১৯০৫) - এর ঘটনা প্রথম বিপ্লবের জন্ম দেয়। এর ফলস্বরূপ সীমিত ক্ষমতা সহ "দুমা" (Duma) নামে একটি আইনসভা গঠিত হলেও জার তা উপেক্ষা করেন।

    * প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ: রাশিয়ার দুর্বল সামরিক প্রস্তুতি এবং যুদ্ধক্ষেত্রে লাগাতার পরাজয় জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করে। খাদ্য ও জ্বালানির সংকট পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।


* ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (February Revolution, ১৯১৭):

    * সময়কাল: মার্চ, ১৯১৭ (রাশিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি)।

    * কারণ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয়, খাদ্য সংকট, জার সরকারের অযোগ্যতা ও স্বৈরাচারী শাসন।

    * ঘটনা: ৮ মার্চ, ১৯১৭ (আন্তর্জাতিক নারী দিবস) পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) শ্রমিকদের ধর্মঘট ও বিক্ষোভ শুরু হয়। দ্রুত এটি বিদ্রোহে রূপ নেয় এবং সামরিক বাহিনীও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়।

    * ফলাফল: ১৫ মার্চ, ১৯১৭ তারিখে জার দ্বিতীয় নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করেন। প্রিন্স লভোভে-এর নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার (Provisional Government) গঠিত হয়। একই সময়ে শ্রমিক ও সৈনিকদের দ্বারা সোভিয়েত (Soviet) বা পরিষদ গঠিত হয়, যার মধ্যে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। এটি "দ্বৈত শাসন" (Dual Power) নামে পরিচিতি লাভ করে।


* অক্টোবর বিপ্লব (October Revolution, ১৯১৭):

    * সময়কাল: ৭ নভেম্বর, ১৯১৭ (রাশিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর)।

    * লেনিনের আগমন: এপ্রিল, ১৯১৭-তে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন নির্বাসন থেকে রাশিয়ায় ফিরে আসেন এবং তার "এপ্রিল থিসিস" (April Theses) ঘোষণা করেন। এতে তিনি "শান্তি, জমি ও রুটি" (Peace, Land, Bread) - এই স্লোগান দিয়ে অস্থায়ী সরকারের বিরোধিতা করে সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতগুলির হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান।

    * বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: লেনিন ও বলশেভিকরা (বলশেভিক পার্টি, যার নেতা ছিলেন লেনিন) কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

    * বিপ্লবের ঘটনা: ৭ নভেম্বর, ১৯১৭ তারিখে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটায়। তারা পেত্রোগ্রাদে অবস্থিত অস্থায়ী সরকারের সদর দফতর "উইন্টার প্যালেস" (Winter Palace) দখল করে এবং অস্থায়ী সরকারের পতন ঘটায়।

    * নতুন সরকার: লেনিনের নেতৃত্বে "গণকমিসারদের পরিষদ" (Council of People's Commissars - Sovnarkom) গঠিত হয়, যা ছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকার।


* সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা:

    * প্রাথমিক ডিক্রি: নতুন বলশেভিক সরকার ভূমি (জমি কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া), শান্তি (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরে আসার ঘোষণা - ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তি, ১৯১৮), এবং জাতীয়করণ (ব্যাঙ্ক, শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থার রাষ্ট্রীয়করণ) সংক্রান্ত ডিক্রি জারি করে।

    * গৃহযুদ্ধ (১৯১৮-১৯২২): বলশেভিকদের (লাল ফৌজ) বিরুদ্ধে জার সমর্থক, সমাজতান্ত্রিক বিরোধী এবং বিদেশি শক্তির (ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান) সহায়তায় "শ্বেত ফৌজ" নামে পরিচিত বাহিনী যুদ্ধ শুরু করে। লেনিনের নেতৃত্বে লাল ফৌজ বিজয়ী হয়।

    * যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ (War Communism): গৃহযুদ্ধের সময় বলশেভিকরা কঠোর নীতি গ্রহণ করে, যেমন কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফসল বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করা, শিল্প জাতীয়করণ।

    * নয়া অর্থনৈতিক নীতি (New Economic Policy - NEP, ১৯২১): যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের ব্যর্থতা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে লেনিন নয়া অর্থনৈতিক নীতি ঘোষণা করেন, যা সীমিত আকারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং বাজার অর্থনীতিকে অনুমোদন দেয়।

    * সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলির ইউনিয়ন (Union of Soviet Socialist Republics - USSR) প্রতিষ্ঠা: ৩০ ডিসেম্বর, ১৯২২ তারিখে রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ এবং ট্রান্সককেশীয় ফেডারেশন নিয়ে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইউএসএসআর (সোভিয়েত ইউনিয়ন) গঠিত হয়।

    * স্ট্যালিনের উত্থান: লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্ট্যালিন ক্ষমতা দখল করেন এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (Five-Year Plans) এবং কৃষির সম্মিলিতকরণ (Collectivization) - এর মাধ্যমে শিল্প ও কৃষিতে বিশাল পরিবর্তন আনেন।


* গুরুত্ব ও প্রভাব:

    * বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।

    * সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিস্তার এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী ও উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রেরণা।

    * বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ এবং পরবর্তীতে স্নায়ুযুদ্ধের ভিত্তি স্থাপন।

    * গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি চ্যালেঞ্জ।