ইতিহাসের কালনির্ণয় পদ্ধতি আলোচনা করো - [[ CHRONOLOGY ]]

ইতিহাসচর্চায় ও ইতিহাস লেখায় কালপঞ্জিবিন্যাস-এর ব্যবহার অপরিহার্য। কালপঞ্জিবিন্যাসের সাহায্যেই ইতিহাসের ঘটনাক্রমের ধারাবাহিকতা বোঝা যায়৷ প্রাচীন মিশরবাসী নীলনদের প্লাবন, পূর্ণিমা, অমাবস্যা ইত্যাদির সাহায্যে কালক্রম ঠিক করত। প্রাচীন গ্রিকবাসী কালক্রম ঠিক করার জন্য অলিম্পিক খেলার আয়োজন করে (খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬)। এরপর প্রতি চার বছর অন্তর তারা এই খেলার আয়োজনের মধ্যে দিয়ে সময়ের একটা হিসাব রাখত। ভারতীয়দের মধ্যে নিরক্ষর লোকেদের একাংশ সময়ের ধারা বোঝায় জন্য কোনো বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করত, যেমন— খরার বছর, বন্যার বছর, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর প্রভৃতি।

কালক্রমের রূপ

  • চান্দ্রবৎসর : পৃথিবীর চারিদিকে চাঁদের ঘোরার ভিত্তিতে বছর গণনার রীতিকে বলা হয় চান্দ্রবৎসর (Lunar year)। প্রাচীন সুমেরবাসী এই রীতি চালু করে। ইসলামি হিজরি সন হল চান্দ্রবৎসরনির্ভর। 
  • সৌরবৎসর : পৃথিবীর চারিদিকে সূর্যের ঘোরার ভিত্তিতে বছর গণনার রীতিকে বলা হয় সৌরবৎসর (Solar year)। প্রাচীন মিশরবাসী এই রীতি চালু করে। খ্রিস্টাব্দ ও বঙ্গাব্দও সৌরবৎসর নির্ভর। চান্দ্রবর্ষ থেকে সৌরবর্ষ ১১ দিন বেশি।

কালক্রম পদ্ধতি

খ্রিস্টান : আধুনিক বিশ্বের সর্বত্র খ্রিস্টান কালক্রম (খ্রিস্টাব্দ) ব্যবহৃত হয়। সংক্ষিপ্তাকারে এই কালক্রমের দুটি প্রকাশ 
  • (i) A.D. : A.D. শব্দের সম্পূর্ণ রূপ হল— Anno Domini। এই শব্দ দ্বয়ের অর্থ হল— In the year of our (christians) Lord (Jesus)। অর্থাৎ আমাদের (খ্রিস্টানদের) প্রভুর (জিশুর) বছর। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকদের মতে, জিশুখ্রিস্টের আবির্ভাবের পরবর্তী সময়কালের যাবতীয় ঘটনার সময় সুচক হল A.D. 
  • (ii) B.C. : B.C.-এর পুরো অর্থ হল Before (the advent of Christ। অর্থাৎ জিশুখ্রিস্টের আবির্ভাবের পূর্বে ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনার সময়কাল বোঝানোর জন্য B.C. ব্যবহৃত হয়।
মুসলিম (A.H.) : বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান কালক্রমের পাশাপাশি হিজরি সালও ব্যবহার করে থাকে। এটি A.H. নামে পরিচিত। এর পুরো নাম হল After Hizrat, অর্থাৎ হিজরত 25-এর পর। মক্কায় কোরায়েশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও নিরুপায় হয়ে হজরত মহম্মদ (সাঃ) সদলবলে মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নেন। মহম্মদের এই মদিনা গমনকে হিজরত বলা হয়। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রাঃ) হিজরতের দিনটিকে মুসলিম কালক্রম অর্থাৎ হিজরি সালের সূচনাকাল হিসেবে ঘোষণা করেন। ইসলামি হিজরি সন গণনা পদ্ধতি চান্দ্রবৎসর নির্ভর। সমগ্র মুসলিম দুনিয়ার যাবতীয় উৎসব ও ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ড অর্থাৎ ইদ, শবেবরাত, শবেকদর, শবে মেহরাজ, মহরম, রোজা প্রভৃতি হিজরি কালক্রম অনুসারেই পালিত হয়।

বাংলা : ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলিতে কালক্রম বোঝানোর জন্য বঙ্গাব্দের প্রচলন রয়েছে। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করেন। সুবা বাংলায় রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য তিনি মূলত এই কালক্রম চালু করেছিলেন। আকবরের রাজত্বকালের ১৯তম বছরে এটি চালু হলেও এর গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে এই বিশেষ দিনটিতে আকবর দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন। এই কালক্রমটির প্রথমে নাম ছিল 'তারিখ-ই এলাহি', পরে এর নাম হয় বঙ্গাব্দ।

ইতিহাসের কালনির্ণয় পদ্ধতি


রেডিয়ো কার্বন (C-14, C-12) ডেটিং পদ্ধতি

সজীব উদ্ভিদ বা প্রাণীদেহে রেডিয়ো কার্বন (C-14) ও অ-তেজস্ক্রিয় কার্বনের (C-12)-এর একটি নির্দিষ্ট অনুপাত বজায় থাকে। মৃত্যুর পর কার্বন সমৃদ্ধ যে-কোনো নমুনায় রেডিয়ো কার্বনের পরিমাণ কমে আসে, কিন্তু C-12 এর পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে। তাই কোনো প্রাচীন কাঠ, প্রাচীন দেহের অস্থি ইত্যাদিতে C-14 ও C-12 এর অনুপাত পর্যবেক্ষণ করে তাদের বয়স নির্ণয় করা যায়।

ইউরেনিয়াম থোরিয়াম পদ্ধতি

এই পদ্ধতির সাহায্যে কোনো প্রত্নবস্তুতে উপস্থিত ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অনুপাত থেকে ওই প্রত্নবস্তুর বয়স নির্ণয় করা যায়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস জানা সম্ভব।

থার্মোলুমিনিসেন্স পদ্ধতি

কাদামাটির মধ্যেকার কোয়ার্টজকে গরম করলে তার থেকে শক্তি নির্গত হয়, ঠান্ডা হওয়ার পর কোয়ার্টজ পুনরায় সেই শক্তি সংগ্রহ করে নেয়। এই পুনঃসংগৃহীত শক্তির যখন পরিমাপ করা হয় তখন তা থেকে সেই কাদামাটির প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা যায়।

ফিসন চিহ্ন শনাক্তকরণ পদ্ধতি

তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে নির্গত কণাগুলি শিলায় প্রোথিত বিভিন্ন বস্তুতে যে অগুন্তি চিহ্ন বা দাগ সৃষ্টি করে তার দ্বারা ওই বস্তুর বয়স নির্ণয় করা হয়।

প্রত্নচুম্বকত্ব পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে প্রত্নক্ষেত্রে চুম্বক দ্বারা চৌম্বকত্বের দিক বদলের সূত্র ধরে কাল নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতি মেনে পাললিক শিলার মধ্যেকার জীবাশ্মগুলির বয়স নির্ণয় করা হয়।

ডেনড্রোক্রনোলজি পদ্ধতি 

C-14 পরীক্ষায় প্রাপ্ত সময়কালের সঙ্গে আর ৭০০ বছর যোগ করে যে সময়কাল নির্ণয় করা হয় তার ইংরেজি নাম ক্যালিব্রেশন আর তাকে বাংলায় বলা হয় কাল-পরিধি নির্ণায়ক পরীক্ষা। এই পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক নাম হল ডেনড্রোক্রনোলজি ।

Next Post Previous Post