দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তির (SEATO) পটভূমি এবং এর গুরুত্ব পর্যালোচনা করো।

★★★★★
স্নায়ুযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট প্রভাব রোধ করার জন্য SEATO প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং অন্যান্যরা
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO)

South-East Asia Treaty Organisatio

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে ঠান্ডা লড়াইজনিত কারণে পৃথিবীতে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় তার থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও বাদ যায়নি। রাশিয়ার সাম্যবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে চীন সেই নীতিতে পরিচালিত হতে থাকে এবং ১৯০৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট দলের সফলতা বৃদ্ধি পায়। চীনের এই সাফল্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম গোলার্ধের গণতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী দেশগুলি শঙ্কিত হয়ে ওঠে। তাদের আশংকা ছিল যে চীনা কমিউনিস্ট প্রভাব শীঘ্রই দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। চীনা কমিউনিস্ট বিরোধী নেতা চিয়াং-কাই-শেক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফরমোজা দ্বীপে সাম্যবাদী প্রসার রোধের প্রচেষ্টা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন জানায়। সাম্যবাদী প্রসার রোধের জন্য অচিরেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি রাষ্ট্র জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

১৯৫২ সালে জেনারেল আইজেন হাওয়ার রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ঘটনা যেমন ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের কাছে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের পতন, কোরিয়ায় রাষ্ট্র সংঘের পাঠানো সেনার সাথে চীনের কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংঘাত প্রভৃতি কারণে সাম্যবাদী অগ্রসর প্রসারিত হয় এবং এই ঘটনায় পাশ্চাত্য রাষ্ট্রজোট শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালের জেনিভা কনফারেন্সের পর ম্যানিলা চুক্তির সম্মেলন আহুত হয়েছিল এই রোধের উদ্দেশ্যে। এই সম্মেলনেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া রক্ষার উদ্দেশ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তিই 'South-East Asia Treaty Organisation' বা SEATO নামে পরিচিত। একে 'দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা' বা সিয়াটো বলা হয়।


এই চুক্তিতে স্থির হয়, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করে শক্ত ধবংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার ব্যবস্থা নেবে। সমবেত নিরাপত্তা পরিকল্পনার মাধ্যমে রক্ষা ব্যবস্থা গঠন করবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে সমস্ত রাষ্ট্র এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, যেমন লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি সেখানে কোনো আগ্রাসন হলেও এই সংস্থা তার রোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খারমোজা ও হংকং ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান এই চুক্তিতে স্বাক্ষরদান করে। এই সংস্থা কেবল কমিউনিস্ট আগ্রাসনের জন্যই নয় যে-কোনো প্রকার আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করবে বলে স্থির হয়। যুক্তরাষ্ট্র কেবল কমিউনিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে এই সংস্থাকে সাহায্য করবে বলে স্থির হয়।


ভারত, ব্রহ্মদেশ, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই সমস্ত দেশকে বাদ দিয়ে পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সাহায্যে দেশকে বাদ দিয়ে পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সাহায্যে পাকিস্তান, ফিলিপাইন প্রভৃতি পাশ্চাত্য রাষ্ট্রজোটের অনুগত দেশ নিয়ে গঠিত SEATO-র কার্যকারিতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনে এই জোটের নিন্দা করা হয়। মনে করা হয়, সিয়াটো গঠনের মাধ্যমে ঠান্ডা লড়াইকে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই সংস্থার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াতে যে-কোনো পশ্চিমী রাষ্ট্রজোট বিরোধী পরিবর্তনে বাধা দান করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সিয়েটোকে কেবল সামরিক জোট হিসাবে দেখা ভুল হবে। কারণ শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, সুবিচার ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করা এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্থিক উন্নয়ন এর নীতি বলে দাবি করা হয়।


ভিয়েতনামের ঘটনা সিয়াটোর ভিত্তি দুর্বল করেছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে ফ্রান্সও এই সংস্থার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তান সিয়াটো ত্যাগ করে তার উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায়। তাই সামরিক জোট হিসাবে সিয়াটোর অবসান হয়।

FAQ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO)

Q1: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO) কী?

A1: SEATO হলো একটি আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা সংস্থা যা ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্যবাদের বিস্তার রোধ করার জন্য গঠিত হয়েছিল। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।


Q2: SEATO গঠনের কারণ কী?

A2: চীনসহ এশিয়ার অন্যান্য অংশে সাম্যবাদের বিস্তার রোধ করার জন্য SEATO গঠিত হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল সাম্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমবেত নিরাপত্তা প্রদান করা।


Q3: SEATO-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি কোনগুলি ছিল?

A3: SEATO-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান এবং যুক্তরাজ্য।


Q4: কেন ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রহ্মদেশ SEATO-তে যোগ দেয়নি?

A4: ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রহ্মদেশ নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় কোনো সামরিক জোটের সাথে যোগ দিতে চায়নি।


Q5: SEATO-এর প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?

A5: SEATO-এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাম্যবাদের বিস্তার রোধ করা এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসনের ক্ষেত্রে সমবেতভাবে প্রতিরক্ষা প্রদান করা।


Q6: ভিয়েতনাম যুদ্ধ SEATO-কে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

A6: ভিয়েতনাম যুদ্ধ SEATO-এর ভিত্তিকে দুর্বল করেছিল কারণ এটি অঞ্চলে সাম্যবাদের বিস্তার রোধের চ্যালেঞ্জ এবং জটিলতাগুলি প্রকাশ করেছিল। যুদ্ধ SEATO-এর সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের সীমাবদ্ধতাগুলিকে সামনে নিয়ে আসে।


Q7: SEATO কখন এবং কেন বিলুপ্ত হয়েছিল?

A7: SEATO ১৯৭৭ সালে বিলুপ্ত হয়েছিল কারণ প্রধান সদস্য রাষ্ট্রগুলি সংগঠন থেকে সরে গিয়েছিল এবং এটি তার উদ্দেশ্যগুলি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পাকিস্তান ১৯৭৩ সালে SEATO ত্যাগ করে এবং ১৯৬৭ সাল থেকে ফ্রান্স এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, যা সংস্থার পতনের দিকে নিয়ে যায়।


Q8: SEATO কি শুধুমাত্র একটি সামরিক জোট ছিল?

A8: না, SEATO শুধুমাত্র একটি সামরিক জোট ছিল না। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, সুবিচার এবং জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করারও লক্ষ্য ছিল। এছাড়াও, এর একটি উদ্দেশ্য ছিল অঞ্চলের আর্থিক উন্নয়ন।


Q9: ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনের পর SEATO নিয়ে কী বলা হয়েছিল?

A9: ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনে SEATO-এর সমালোচনা করা হয়েছিল এবং এটি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের একটি সম্প্রসারণ এবং এশিয়ায় ঠান্ডা লড়াইয়ের উত্তেজনা নিয়ে আসার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই সম্মেলনটি SEATO-এর কার্যকারিতা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল।


Q10: SEATO-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল?

A10: SEATO-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, সাম্যবাদী প্রভাব মোকাবেলায় সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করা। যুক্তরাষ্ট্র SEATO-কে এশিয়ায় সাম্যবাদ নিয়ন্ত্রণের কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখেছিল।

Tags:
Next Post Previous Post

You May Also Like

Editor
ইতিহাস পাঠশালা

যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু অতীত তাই হল ইতিহাস৷ ইতিহাস পাঠশালা হল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত, উত্তরধর্মী, প্রবন্ধ মূলক পাঠ সহায়ক একটি ব্লগ৷ মূলত ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরাই এই ব্লগের প্রধান লক্ষ্য৷