ন্যাটো গঠনের উদ্দেশ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব আলোচনা করো।

★★★★★
ন্যাটো গঠনের পটভূমি, উদ্দেশ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে ন্যাটোর ভূমিকা এবং এর সীমাবদ্ধতা।
ন্যাটো গঠনের উদ্দেশ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব আলোচনা করো।

ন্যাটো গঠনের পটভূমি

১৯৪৮ সাল থেকেই 'ঠান্ডা যুদ্ধ' মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠতে থাকে, যা মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই শুরু হয়েছিল। এই ঠান্ডা লড়াই-এর দুটি পক্ষের একটি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরটি হল সোভিয়েত রাশিয়া। এরা পশ্চিম ও পূর্ব এই দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ ছিল। পশ্চিম শিবির তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল পুঁজিবাদে বিশ্বাসী এবং পূর্ব শিবির তথা সোভিয়েত রাশিয়া ছিল সাম্যবাদে বিশ্বাসী। পূর্ব ইউরোপের একমাত্র অসাম্যবাদী রাষ্ট্র চেকোশ্লোভাকিয়াতে বহুদলীয় সরকারের অবসান ঘটে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমী শিবির তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা উপলব্ধি করে, এখনই সাম্যবাদ তথা সোভিয়েতকে না থামালে তারা ক্রমেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়ে যাবে। সোভিয়েত রাশিয়া সামরিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠ থাকায় যুদ্ধ বাধলে সোভিয়েত প্রাধান্যই যে প্রতিষ্ঠিত হবে, তা ভেবে পশ্চিম শিবির আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। নিজের এবং পশ্চিমী দেশগুলির যৌথ নিরাপত্তার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সামরিক জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ন্যাটোর পটভূমি এভাবে প্রস্তুত হয়।

ব্রাসেলস্ চুক্তি (১৯৪৮ খ্রীঃ)

ন্যাটো গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল ব্রাসেলস্ চুক্তি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ এই পাঁচটি রাষ্ট্র মিলে ব্রাসেলস্ প্যাক্ট নামে একটি যৌথ সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মূল বক্তব্য ছিল-চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলি একে অপরকে বৈদেশিক আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করবে। এর মেয়াদ ছিল ৫০ বছর। এই চুক্তি দ্বারা পশ্চিমী শিবিরের দেশগুলির যৌথ প্রতিরক্ষা স্বীকৃত হয়।

ন্যাটো প্রতিষ্ঠা

পশ্চিমী শিবিরের ব্যাসেলস্ চুক্তি সোভিয়েত রাশিয়াকে চিন্তান্বিত করেছিল। ব্রাসেলস্ চুক্তির জবাবে ১৯৪৮ সালের জুন মাসে সোভিয়েত বার্লিন অবরোধ করে। ফলে ইউরোপের নিরাপত্তা সংকটের সম্মুখীন হয়। এই সময় মার্কিন রিপাবলিকান দলের নেতা ভ্যান্ডেনবার্গের প্রস্তাব অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আমেরিকার বাইরে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলির সাথে যৌথ সামরিক চুক্তি সম্পাদন করার অধিকার দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে গৃহীত মনরো নীতিতে কেবল দুই আমেরিকার নিরাপত্তার কথা ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু ভান্ডেনবার্গ প্রস্তাব গৃহীত হলে তা 'মনরো নীতির লঙ্ঘনকারী' বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে যাই হোক না কেন ভ্যান্ডেনবার্গের প্রস্তাব মেনে একটি যৌথ প্রতিরক্ষা সংস্থা গড়ে তোলা হয় ১৯৪৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল। এটিই মূলত ন্যাটো বা North Atlantic Treaty Organisation (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা)।

ন্যাটোর সাংগঠনিক বিন্যাস

প্রথমে কানাডা, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, গ্রীস, ইসল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থার সদস্য হয়। পরে পশ্চিম জার্মানী ও তুরস্ক এর অন্তর্ভুক্ত হয়। ৮২-১৩ ভোটে মার্কিন সেনেট এই চুক্তি অনুমোদন করে। এই সদস্যভুক্ত দেশগুলিকে নিয়েই উত্তর আটলান্টিক পরিষদ গঠিত হয়। সামরিক নীতি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছিল প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা কমিটির ওপর। ন্যাটোর প্রশাসনিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য একটি সচিবালয় গঠিত হয়। এর প্রধান হলেন মহাসচিব। ন্যাটোর সকল সদস্যরাষ্ট্রের বাহিনীর প্রধান বা তাদের প্রতিনিধি নিয়ে ন্যাটোর সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়। এই সামরিক বাহিনী আবার চারটি ভাগে বিভক্ত। যথা-ইউরোপীয় বাহিনী, উপকূল কম্যান্ড, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী এবং সামুদ্রিক বাহিনী। মার্কিন সেনাপতি ডোয়াইট আইজেন হাওয়ার ন্যাটোর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নেন। ন্যাটোর অনুসৃত নীতি 'The Forward Strategy' নামে পরিচিত। এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখা।

ন্যাটোর শর্তাবলী

ন্যাটোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও মিত্র বৃদ্ধি করা। এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি এই অঙ্গীকার করে যে, 

  • (a) রাষ্ট্রসংঘের সনদ অনুসারে তারা আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা রক্ষা করবে, 
  • (b) নিজেদের মধ্যে বিবাদ আপোসে মিটিয়ে নেবে, 
  • (c) চুক্তিভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলে চুক্তিভুক্ত অপর দেশগুলি একক বা যৌথভাবে আক্রান্ত দেশটিকে সাহায্য করবে, 
  • (d) এই চুক্তিভুক্ত দেশগুলি রাষ্ট্রসংঘকে সমস্ত ক্ষেত্রে সাহায্য করবে, 
  • (e) আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে চুক্তিভুক্ত দেশগুলি একে অপরকে সহায়তা করবে। 

ন্যাটোতে যে-কোনো মুহূর্তে দেশ যোগাযোগ করতে পারবে। প্রথমদিকে স্থির হয় ন্যাটোর চুক্তিকাল ২০ বছরের এবং কুড়ি বছর পরে যে-কোনো সদস্যদেশ এক বছরের নোটিশ দিয়ে ন্যাটোর সদস্যপদ ত্যাগ করতে পারবে।

ন্যাটোর সীমাবদ্ধতা

উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার কতকগুলি সীমাবদ্ধতা ছিল।

  1. প্রথমত, ন্যাটো চুক্তি করা হয়েছিল আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলির সাথে, যদিও গ্রীস, ইটালী, তুরস্ক মহাসাগরীয় তীরবর্তী ছিল না। আবার স্পেন মহাসাগরের তীরবর্তী হলেও তাকে চুক্তিভুক্ত করা হয়নি। তবে স্পেনের সাথে পরবর্তীকালে দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর থেকে বোঝা যায়, ন্যাটোর সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্কভুক্ত দেশগুলিই এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
  2. দ্বিতীয়ত, সদ্যসভুক্ত রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঐতিহ্যগত ও আদর্শগত সংহতি ছিল না। প্রসঙ্গত বলা যায়, সদস্যরাষ্ট্রগুলির জার্মানী ও ইটালীর প্রতি সংগ্রামী মনোভাবের কথা। এর থেকে উপলব্ধি করা যায়, নেতিবাচক মনোভাব নিয়েই এই সংস্থা গঠিত হয়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সোভিয়েত আক্রমণ প্রতিরোধ।
  3. তৃতীয়ত, এই সংস্থা সামরিক ও অর্থনৈতিক দিকসহ বিভিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
  4. চতুর্থত, এই চুক্তিভুক্ত দেশগুলি অন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতপার্থক্য ঘটে। ফলে তাদের সংহতি নষ্ট হয়।

ন্যাটোর উদ্দেশ্য যে সামরিক ছিল না, সোভিয়েত প্রভাব প্রতিরোধ ছিল তা উপলব্ধি করা যায়। আর অস্ত্রের সাহায্যে সম্ভব বলেই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি সামরিক চুক্তি সম্পাদন করেছিল। ইউরোপের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো সদস্যদের স্বার্থে কোনো যৌথ প্রতিরোধ নীতি অনুসরণ করেনি।

ন্যাটোর গুরুত্ব

সীমাবদ্ধতা ও উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব ছিল অপরিসীম। এই সংস্থা গঠনের ফলে সোভিয়েত তথা সাম্যবাদের অগ্রসরতা কিছুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়। চুক্তিভুক্ত দেশগুলির সামরিক সংগঠন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা লাভবান হয়ে ওঠে। এই চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়েছিল। সোভিয়েতের প্রভাব অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ হয়।


প্রশ্ন ১: ন্যাটো গঠনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: ন্যাটো গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা, সদস্য দেশগুলির সামরিক মিত্রতা বৃদ্ধি করা এবং সোভিয়েত প্রভাব প্রতিরোধ করা।


প্রশ্ন ২: ন্যাটোর পটভূমি কীভাবে তৈরি হয়?

উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে আদর্শগত বিরোধের ফলে পশ্চিমী শিবিরের দেশগুলি তাদের যৌথ নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।


প্রশ্ন ৩: ব্রাসেলস্ চুক্তি কী এবং এর গুরুত্ব কী?

উত্তর: ১৯৪৮ সালের ব্রাসেলস্ চুক্তি ছিল ন্যাটো গঠনের প্রথম পদক্ষেপ, যেখানে ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ একসাথে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে নিজেদের বৈদেশিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করে।


প্রশ্ন ৪: ন্যাটো প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কী ছিল?

উত্তর: সোভিয়েত রাশিয়ার বার্লিন অবরোধের ফলে ইউরোপে নিরাপত্তা সংকট দেখা দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্যান্ডেনবার্গ প্রস্তাব অনুসারে আমেরিকার বাইরের দেশগুলির সাথে যৌথ সামরিক চুক্তি করে ১৯৪৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল ন্যাটো প্রতিষ্ঠা করে।


প্রশ্ন ৫: ন্যাটোর সাংগঠনিক বিন্যাস কেমন?

উত্তর: ন্যাটোর সদস্য দেশগুলি নিয়ে একটি উত্তর আটলান্টিক পরিষদ গঠিত হয়। সামরিক নীতি সম্পর্কিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা কমিটি নেয় এবং ন্যাটোর প্রশাসনিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য একটি সচিবালয় থাকে যার প্রধান মহাসচিব।


প্রশ্ন ৬: ন্যাটোর প্রধান নীতি কী ছিল?

উত্তর: ন্যাটোর প্রধান নীতি ছিল 'The Forward Strategy', যার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত রাশিয়াকে সামরিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা।


প্রশ্ন ৭: ন্যাটোর প্রধান শর্তাবলী কী কী?

উত্তর: ন্যাটোর শর্তাবলীর মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, নিজেদের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে নেয়া, সদস্য রাষ্ট্র আক্রমণের শিকার হলে একে অপরকে সাহায্য করা, রাষ্ট্রসংঘকে সাহায্য করা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান।


প্রশ্ন ৮: ন্যাটোর সীমাবদ্ধতা কী ছিল?

উত্তর: ন্যাটোর সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিল আটলান্টিক তীরবর্তী দেশগুলির মধ্যে আদর্শগত সংহতির অভাব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা, এবং অন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে মতপার্থক্য।


প্রশ্ন ৯: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ন্যাটোর প্রভাব কী ছিল?

উত্তর: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ন্যাটোর প্রভাব ছিল অপরিসীম। এর ফলে সোভিয়েত প্রভাব কিছুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়, চুক্তিভুক্ত দেশগুলির সামরিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন শক্তিশালী হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়।

Tags:
Next Post Previous Post

You May Also Like

Editor
ইতিহাস পাঠশালা

যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু অতীত তাই হল ইতিহাস৷ ইতিহাস পাঠশালা হল ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত, উত্তরধর্মী, প্রবন্ধ মূলক পাঠ সহায়ক একটি ব্লগ৷ মূলত ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরাই এই ব্লগের প্রধান লক্ষ্য৷