আলিগড় আন্দোলন ও দেওবন্দ স্কুল (The Aligarh movement, Deoband School)

ইতিহাস সিলেবাসের "আলিগড় আন্দোলন, দেওবন্দ স্কুল" টপিকের উপর বিস্তারিত নোট প্রদান করা হলো।

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতে মুসলিম সমাজে এক গভীর সংকট দেখা দেয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য দুটি বিপরীতমুখী অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল – আলিগড় আন্দোলন এবং দেওবন্দ স্কুল।


### ১. আলিগড় আন্দোলন (Aligarh Movement)

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেক্ষাপট:

* প্রতিষ্ঠাতা: স্যার সৈয়দ আহমেদ খান (১৮১৭-১৮৯৮)।

* সময়কাল: উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ (প্রধানত ১৮৭০-এর দশক থেকে)।

* প্রেক্ষাপট: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদেরকেই বিদ্রোহের মূল হোতা বলে মনে করে। ফলে মুসলমানরা সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে অনীহা দেখায় এবং পশ্চাদপদ হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মুসলমানদের উন্নতিকল্পে আলিগড় আন্দোলনের সূচনা করেন।


লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

1. আধুনিক শিক্ষা প্রসারে: মুসলিম সমাজে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

2. ব্রিটিশ আনুগত্যে: ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য তৈরি করা এবং তাদের বিশ্বাস অর্জন করা।

3. সামাজিক সংস্কারে: মুসলিম সমাজের কুসংস্কার, গোঁড়ামি দূর করে তাদের মধ্যে উদারনৈতিক চিন্তা-চেতনা জাগিয়ে তোলা।

4. রাজনৈতিক সচেতনতায়: মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করা।

5. জাতীয় কংগ্রেস বিরোধিতায়: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে মুসলমানদের দূরে রাখা।


প্রধান কার্যধারা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ:

* সায়েন্টিফিক সোসাইটি (Scientific Society): ১৮৬৪ সালে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান আলিগড়ে 'সায়েন্টিফিক সোসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি গ্রন্থ ও আধুনিক বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা উর্দুতে অনুবাদ করে মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞানের প্রসার ঘটানো।

* তাহজিব-উল-আখলাক (Tahzib-ul-Akhlaq): ১৮৭০ সালে তিনি 'তাহজিব-উল-আখলাক' (নৈতিকতার উন্নতি) নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন এবং আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রচার করেন।

* মুহাম্মদ্যান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ (MAO College): ১৮৭৫ সালে আলিগড়ে 'মুহাম্মদ্যান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ' প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল আলিগড় আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। এই কলেজটি ১৯২০ সালে 'আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়' (Aligarh Muslim University - AMU)-এ উন্নীত হয়। এটি মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।

* মুহাম্মদ্যান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল এডুকেশনাল কনফারেন্স (Muhammadan Anglo-Oriental Educational Conference): ১৮৮৬ সালে তিনি 'মুহাম্মদ্যান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল এডুকেশনাল কনফারেন্স' প্রতিষ্ঠা করেন, যা বার্ষিক অধিবেশনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করত।

* ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিওটিক অ্যাসোসিয়েশন (United Indian Patriotic Association): ১৮৮৮ সালে স্যার সৈয়দ 'ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিওটিক অ্যাসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের রাজনৈতিক কার্যকলাপের বিরোধিতা করা এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য প্রকাশ করা।


আদর্শ ও নীতি:

* আধুনিকতাবাদী: পাশ্চাত্য শিক্ষা, বিজ্ঞান ও যুক্তির উপর জোর।

* আউট-অ্যান্ড-আউট ব্রিটিশ সমর্থক: ব্রিটিশ শাসনের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য।

* জাতীয়তাবাদী বিরোধিতা: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ভারতের মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করা।

* দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ: যদিও স্যার সৈয়দ সরাসরি 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' দেননি, তবে তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি এবং তাদের স্বার্থ ভিন্ন। এটি ভবিষ্যতে দ্বিজাতি তত্ত্ব ও পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।


গুরুত্ব ও প্রভাব:

* মুসলিম রেনেসাঁ: আলিগড় আন্দোলন মুসলিম সমাজে আধুনিক চেতনার উন্মোচন ঘটায় এবং একটি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সৃষ্টি করে। এটি মুসলিম রেনেসাঁর সূচনা করে।

* শিক্ষা প্রসার: আধুনিক শিক্ষার প্রসারে আলিগড় কলেজ (পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

* রাজনৈতিক সচেতনতা: মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

* সাম্প্রদায়িকতার জন্ম: স্যার সৈয়দের কিছু বক্তব্য এবং কংগ্রেস বিরোধিতার নীতি ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন করে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভারত বিভাজনের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে দাঁড়ায়।


### ২. দেওবন্দ স্কুল (Deoband School)

প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা:

* প্রতিষ্ঠা: ১৮৬৬ সালে উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে 'দারুল উলুম দেওবন্দ' (Darul Uloom Deoband) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।

* প্রতিষ্ঠাতা: মহম্মদ কাসিম নানুতবি (Muhammad Qasim Nanautavi) এবং রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি (Rashid Ahmed Gangohi)।


লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

1. ইসলামের ঐতিহ্য রক্ষা: ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে যখন মুসলিম সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছিল, তখন দেওবন্দ স্কুলের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ও ধর্মীয় পরিচিতি রক্ষা করা।

2. ধর্মীয় শিক্ষার পুনরুজ্জীবন: কুরআন, হাদিস এবং ইসলামি আইন (শরিয়ত) শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান ও নৈতিক মূল্যবোধের বিস্তার ঘটানো।

3. ব্রিটিশ প্রভাব মুক্ত: আলিগড় আন্দোলনের মতো ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা না করে স্বাবলম্বীভাবে এবং ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া।

4. ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা: ব্রিটিশ সরকারের ইসলামে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা।


আদর্শ ও নীতি:

* ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা: পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরোধিতা করে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়।

* ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব: দেওবন্দি আলেমরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করতেন এবং তাদের সাথে কোনো রকম সহযোগিতার বিরোধী ছিলেন। তারা নিজেদের অর্থায়নে মাদ্রাসা চালাতেন।

* আত্মনির্ভরশীলতা: ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক বা প্রশাসনিক সাহায্য না নিয়ে জনসাধারণের অনুদানের উপর নির্ভর করা।

* আলিপুর আন্দোলনের বিরোধিতা: দেওবন্দিরা আলিগড় আন্দোলনের পাশ্চাত্যপ্রীতি ও ব্রিটিশ আনুগত্যের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তারা আলিগড়কে ইসলাম বিরোধী বলে মনে করতেন।

* প্যান-ইসলামিজম: তারা বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন।

* রাজনৈতিক ভূমিকা: দেওবন্দি আলেমরা সরাসরি রাজনীতিতে অংশ না নিলেও, পরোক্ষভাবে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সমর্থন দেন (যেমন: জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ)।


গুরুত্ব ও প্রভাব:

* ধর্মীয় পরিচিতি বজায় রাখা: দেওবন্দ স্কুল মুসলিম সমাজের ধর্মীয় পরিচিতি ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামি মূল্যবোধকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

* ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা: মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব এবং আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলে।

* ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র: এটি ভারতবর্ষে অন্যতম বৃহত্তম ও প্রভাবশালী ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়, যা থেকে হাজার হাজার উলেমা তৈরি হন।

* জাতীয় আন্দোলনে ভূমিকা: দেওবন্দি আলেমদের একটি অংশ পরবর্তীতে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে (যেমন: মাওলানা হুসেন আহমেদ মাদানি)। তারা ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান ধারণার বিরোধিতা করেন।


### ৩. আলিগড় ও দেওবন্দ স্কুলের মধ্যে পার্থক্য


বৈশিষ্ট্য আলিগড় আন্দোলন দেওবন্দ স্কুল
প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মহম্মদ কাসিম নানুতবি ও রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি
প্রতিষ্ঠাকাল প্রধান প্রতিষ্ঠান MAO কলেজ ১৮৭৫ (আন্দোলন ১৮৬০ এর দশকে শুরু) দারুল উলুম দেওবন্দ ১৮৬৬
লক্ষ্য আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে মুসলিমদের উন্নতি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা ও মূল্যবোধের সংরক্ষণ।
শিক্ষা পদ্ধতি আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা (ইংরেজি, বিজ্ঞান) + ইসলামি শিক্ষা। ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা (কুরআন, হাদিস, ফিকহ)।
ব্রিটিশের প্রতি মনোভাব ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ও সহযোগিতা। ব্রিটিশ বিরোধী, অসহযোগিতা ও স্বাবলম্বিতা।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কংগ্রেস বিরোধিতা, মুসলিমদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক পথ। ব্রিটিশ বিরোধী, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন।
প্রভাব মুসলিম সমাজে আধুনিকতার সূচনা, মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণি তৈরি, দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ। মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচিতি রক্ষা, ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব, ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র।
অর্থনীতি সরকারি সাহায্য, ব্যক্তিগত অনুদান ও ব্রিটিশ সমর্থন। সম্পূর্ণ জনঅনুদান ও স্বাবলম্বিতা।


উপসংহার:

আলিগড় আন্দোলন এবং দেওবন্দ স্কুল – দুটিই মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য সচেষ্ট ছিল, কিন্তু তাদের পন্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। আলিগড় আধুনিক শিক্ষা ও ব্রিটিশ সহায়তার মাধ্যমে উন্নতি চেয়েছিল, যা দীর্ঘমেয়াদে মুসলিমদের পৃথক রাজনৈতিক পরিচয়ে আবদ্ধ করে এবং বিভাজনের জন্ম দেয়। অন্যদিকে, দেওবন্দ ঐতিহ্যবাহী ইসলামি মূল্যবোধ ও ব্রিটিশ বিরোধী আত্মনির্ভরশীলতার উপর জোর দিয়েছিল, যা মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচিতি বজায় রাখতে এবং একটি অংশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহিত করে। এই দুটি আন্দোলনই ভারতের মুসলিম সমাজের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।