আধুনিক দেশীয় সাহিত্য, সংবাদমাধ্যম, জনমত ও বৈজ্ঞানিক ধারণার বিকাশ (The Growth of modern vernacular literature, press and public opinion, growth and spread of scientific ideas *)

ইতিহাস সিলেবাসের "আধুনিক দেশীয় সাহিত্য, প্রেস ও জনমতের বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক ধারণার বৃদ্ধি ও বিস্তার" শীর্ষক বিষয়ের উপর বিস্তারিত নোট দেওয়া হল।

উনিশ শতকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে এক নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে। এই জাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আধুনিক দেশীয় (vernacular) সাহিত্যের বিকাশ, সংবাদপত্রের প্রসার এবং এর মাধ্যমে জনমত গঠন, এবং বৈজ্ঞানিক ধারণার উন্মোচন ও বিস্তার। এই তিনটি বিষয় একে অপরের পরিপূরক ছিল এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।


#### ১. আধুনিক দেশীয় সাহিত্যের বিকাশ (Growth of Modern Vernacular Literature)

পাশ্চাত্য শিক্ষা ও মুদ্রণ যন্ত্রের আগমনের ফলে দেশীয় ভাষার সাহিত্য এক নতুন দিশা লাভ করে। এটি শুধু মনোরঞ্জনের মাধ্যম ছিল না, বরং সমাজ সংস্কার, জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ এবং জনশিক্ষার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


ক. বিকাশের কারণ:

* মুদ্রণ যন্ত্রের প্রভাব: মুদ্রণ যন্ত্রের প্রসারের ফলে বইপত্র প্রকাশ সহজ ও সুলভ হয়, যা সাহিত্যের ব্যাপক প্রচারে সাহায্য করে। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস (১৮০০ খ্রি.) এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেয়।

* পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব: ইংরেজি সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় দেশীয় সাহিত্যিকরা নতুন বিষয়বস্তু, লিখনশৈলী এবং ধারার (যেমন উপন্যাস, নাটক) সঙ্গে পরিচিত হন।

* সমাজ সংস্কার আন্দোলন: রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ সমাজ সংস্কারকরা তাঁদের বার্তা প্রচারে সাহিত্যকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।

* জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ: ভারতমাতা ও মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা সাহিত্যে প্রকাশিত হতে শুরু করে।

* সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো: ইংরেজি বা সংস্কৃতের পরিবর্তে সাধারণ মানুষের বোধগম্য দেশীয় ভাষায় সাহিত্য রচনার প্রবণতা বাড়ে।


খ. বাংলা সাহিত্য (সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ):

বাংলা সাহিত্যেই এর প্রথম ও ব্যাপক প্রকাশ দেখা যায়।


* গদ্য সাহিত্য:

    * রামমোহন রায়: বাংলা গদ্যের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর 'বেদান্ত গ্রন্থ', 'বেদান্ত সার', 'সংবাদ কৌমুদী' (পত্রিকা) প্রভৃতি গ্রন্থে যুক্তিনির্ভর গদ্যের ব্যবহার দেখা যায়। তিনি সংস্কৃত ও আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে সরল গদ্য রচনার পথ দেখান।

    * ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: বাংলা গদ্যের প্রকৃত রূপকার হিসেবে পরিচিত। তিনি "ছেদ" বা "যতি" চিহ্ন প্রয়োগ করে বাংলা গদ্যে শৃঙ্খলা আনেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা: 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭), 'শকুন্তলা' (১৮৫৪), 'সীতার বনবাস' (১৮৬০), 'কথামালা', 'বোধোদয়' প্রভৃতি। তাঁর গদ্য ছিল সহজ, সরল ও সাবলীল।

    * অক্ষয়কুমার দত্ত: তাঁর 'চারুপাঠ' ও 'পদার্থবিদ্যা' গ্রন্থে তথ্যনির্ভর ও জ্ঞানমূলক গদ্যের প্রকাশ দেখা যায়।


* কাব্য সাহিত্য:

    * মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বাংলা কাব্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন এবং সনেট রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্য: 'মেঘনাদবধ কাব্য' (১৮৬১), 'বীরাঙ্গনা কাব্য', 'ব্রজাঙ্গনা কাব্য', 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'।

    * হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: তাঁর 'ভারত-ভিক্ষা', 'ভারত-সঙ্গীত' প্রভৃতি দেশাত্মবোধক কবিতা জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগাতে সাহায্য করে।

    * নবীনচন্দ্র সেন: তাঁর মহাকাব্য 'পলাশীর যুদ্ধ' ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত গুরুত্বপূর্ণ রচনা।


* উপন্যাস:

    * বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা উপন্যাসের জনক হিসেবে পরিচিত। তাঁর উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্য ও জাতীয়তাবাদে গভীর প্রভাব ফেলে। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: 'দুর্গেশনন্দিনী' (১৮৬৫, প্রথম বাংলা উপন্যাস), 'কপালকুণ্ডলা', 'বিষবৃক্ষ', 'কৃষ্ণকান্তের উইল', 'আনন্দমঠ' (যেখানে 'বন্দে মাতরম্' গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়)। তাঁর উপন্যাসগুলি ঐতিহাসিক পটভূমি, সমাজনীতি ও দেশাত্মবোধকে তুলে ধরে।

    * রমেশচন্দ্র দত্ত: ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতা। তাঁর 'বঙ্গবিজেতা', 'মাধবীকঙ্কণ', 'জীবনপ্রভাত', 'জীবনসন্ধ্যা' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।


* নাটক:

    * দীনবন্ধু মিত্র: তাঁর 'নীলদর্পণ' (১৮৬০) নাটকটি নীলকর সাহেবদের অত্যাচার তুলে ধরে এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে। এটি বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক মাইলফলক।

    * মাইকেল মধুসূদন দত্ত: 'শর্মিষ্ঠা' (প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক), 'পদ্মাবতী', 'কৃষ্ণকুমারী' প্রভৃতি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন।

    * গিরিশচন্দ্র ঘোষ: বাংলা থিয়েটারের অন্যতম পথিকৃৎ।


* মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান:

    * মীর মশাররফ হোসেন: তাঁর 'বিষাদ সিন্ধু' কারবালার ট্র্যাজেডি অবলম্বনে রচিত এক অমর সাহিত্যকর্ম। তিনি মুসলিম সমাজের সংস্কার ও শিক্ষার প্রসারেও ভূমিকা রাখেন।

    * কায়কোবাদ: তাঁর 'মহাশ্মশান' কাব্য উল্লেখযোগ্য।


গ. অন্যান্য ভাষার সাহিত্য:

* হিন্দি: ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রকে আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের জনক বলা হয়। তিনি হিন্দি গদ্য, নাটক ও কবিতার বিকাশে অবদান রাখেন। প্রেমচাঁদ তাঁর উপন্যাসে গ্রামীণ জীবন ও সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেন।

* উর্দু: মির্জা গালিব ও আলতাফ হোসেন হালি উর্দুর বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন।

* তামিল, তেলুগু, মারাঠি: এই ভাষাগুলিতেও সাহিত্যিকরা আধুনিক ধারার উপন্যাস, কবিতা ও নাটক রচনা করেন, যা আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদী চেতনাকে তুলে ধরে।


ঘ. গুরুত্ব:

* জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ: সাহিত্যে মাতৃভূমি ও দেশাত্মবোধের ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে। 'বন্দে মাতরম্' এর মতো গান জাতীয়তার মন্ত্রে পরিণত হয়।

* সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার: বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ প্রথা ইত্যাদি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সাহিত্য ছিল এক শক্তিশালী প্রতিবাদ।

* জনশিক্ষার মাধ্যম: সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞান ও তথ্যের প্রসারে সাহায্য করে।

* ভাষার সমৃদ্ধি: গদ্য, পদ্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্পের মতো নতুন নতুন সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয় এবং ভাষার প্রামাণ্য রূপ তৈরি হয়।

* সাধারণ মানুষের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম: সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সমস্যা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা সাহিত্যের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।


#### ২. সংবাদপত্রের বিকাশ ও জনমত গঠন (Development of Press and Formation of Public Opinion)

সংবাদপত্র ছিল আধুনিক ভারতের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, যা তথ্য সরবরাহ, জনমত গঠন এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।


ক. পটভূমি ও প্রাথমিক পর্যায়:

* ভারতের প্রথম সংবাদপত্র: জেমস অগাস্টাস হিকি সম্পাদিত 'বেঙ্গল গেজেট' বা 'ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার' (১৭৮০)। এটি ছিল একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক।

* প্রথম বাংলা সংবাদপত্র: শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন কর্তৃক প্রকাশিত 'দিগদর্শন' (মাসিক, ১৮১৮) এবং 'সমাচার দর্পণ' (সাপ্তাহিক, ১৮১৮)।

* ভারতীয়দের উদ্যোগ:

    * রামমোহন রায়: ১৮২১ সালে 'সংবাদ কৌমুদী' (বাংলা) এবং ১৮২২ সালে 'মিরাত-উল-আখবার' (ফার্সি) প্রকাশ করেন। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।

    * হরচন্দ্র রায়: 'সমাচার চন্দ্রিকা' (১৮২২)।

    * দ্বারকানাথ ঠাকুর: 'বেঙ্গল স্পেক্টেটর' (১৮৪২)।


খ. সংবাদপত্রের প্রসার:

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সংবাদপত্রের সংখ্যা ও প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র:

* অমৃতবাজার পত্রিকা (১৮৬৮): শিশির কুমার ঘোষ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। প্রথমে বাংলা, পরে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট থেকে বাঁচতে ইংরেজিতে রূপান্তরিত হয়।

* হিন্দু প্যাট্রিয়ট (১৮৫৩): হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত। নীল বিদ্রোহের সময় নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়। পরে এটি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বেঙ্গলী' পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়।

* দ্য হিন্দু (১৮৭৮): জি. সুব্রমণিয়াম আইয়ার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদপত্র।

* কেশরী (মারাঠি) ও মারাঠা (ইংরেজি): বাল গঙ্গাধর তিলক সম্পাদিত। জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব প্রচারে অগ্রণী।

* ইন্ডিয়ান মিরর (১৮৬১): দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে কেশবচন্দ্র সেন দ্বারা প্রকাশিত।

* সোমপ্রকাশ (১৮৫৮): ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে নির্ভীক মতামত প্রকাশ করত।


গ. ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৭৮ (Vernacular Press Act, 1878):

* প্রেক্ষাপট: লর্ড লিটনের শাসনকালে (১৮৭৬-১৮৮০) দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রগুলির ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব দমন করার জন্য এই আইন প্রণীত হয়।

* উদ্দেশ্য: সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বা অসন্তোষজনক লেখা প্রকাশের ক্ষমতা হরণ করা।

* মূল বৈশিষ্ট্য:

    * ম্যাজিস্ট্রেটকে দেশীয় সংবাদপত্রের প্রকাশক বা মুদ্রাকরের কাছ থেকে মুচলেকা আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়।

    * সরকারের বিরুদ্ধে কিছু প্রকাশ করা হলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

    * এই আইন "গ্যাজিং অ্যাক্ট" (মুখ বন্ধ করার আইন) নামে পরিচিত ছিল।

    * শুধুমাত্র দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রের উপর আরোপিত হয়, ইংরেজি সংবাদপত্র এর আওতার বাইরে ছিল।

* প্রতিক্রিয়া: এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের নেতৃত্বে ভারত সভা এই আইনের বিরুদ্ধে সারা ভারত জুড়ে জনমত গঠন করে।

* রদ: লর্ড রিপন (১৮৮০-১৮৮৪) উদারনীতির অংশ হিসেবে এই আইন ১৮৮২ সালে বাতিল করেন।


ঘ. সংবাদপত্রের ভূমিকা ও জনমত গঠন:

* তথ্য আদান-প্রদান: সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের খবর ও সরকারের নীতি সম্পর্কে জনসাধারণ অবহিত হতে পারত।

* জনমত সৃষ্টি: সংবাদপত্রগুলি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে জনমতকে প্রভাবিত করত। উদাহরণস্বরূপ, নীল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

* জাতীয়তাবাদের প্রচার: ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক নীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, প্রশাসনিক ত্রুটিগুলি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত, যা জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রসারিত করত।

* আন্দোলনের প্লাটফর্ম: সংবাদপত্রগুলি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের খবর প্রকাশ করত এবং বিভিন্ন সংগঠনের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিত।

* শিক্ষার প্রসার: অনেক সংবাদপত্র ও সাময়িকী বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানমূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করত।


ঙ. গুরুত্ব:

* সংবাদপত্র ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের প্রধান হাতিয়ার।

* এটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতো রাজনৈতিক সংগঠনগুলির বার্তা প্রচারে সহায়ক হয়।

* সংবাদপত্রের মাধ্যমে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার এবং নারী শিক্ষার মতো ইতিবাচক পরিবর্তনগুলি গতি পায়।

* এটি ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঐক্যবোধ জাগিয়ে তোলে।


#### ৩. বৈজ্ঞানিক ধারণার বৃদ্ধি ও বিস্তার (Growth and Spread of Scientific Ideas)

উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার উন্মোচন ও বিস্তার ঘটে। এটি যুক্তি, নিরীক্ষা ও গবেষণার উপর ভিত্তি করে এক নতুন চিন্তাধারার জন্ম দেয়।


ক. সূচনা ও পটভূমি:

* ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে জ্ঞান বিদ্যমান ছিল, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি ছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও শিল্প বিপ্লব।

* ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ভারতে কিছু বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।


খ. প্রাথমিক উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠান:

* এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪): উইলিয়াম জোন্স কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি ভারতে বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ ছিল। এর জার্নালগুলিতে ভারতের উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, ভূবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হত।

* কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫): এটি ভারতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

* রুরকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৮৪৭): ভারতের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, যা আধুনিক প্রকৌশল বিদ্যার জন্ম দেয়।

* বিজ্ঞান গবেষণা: ব্রিটিশ শাসকরা ভূ-জরিপ, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা ইত্যাদির জন্য কিছু বিভাগ খোলে।


গ. বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও তাঁদের অবদান:

* ড. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪): একাধারে একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক, সমাজসেবক ও বিজ্ঞানপ্রেমী। তিনি উপলব্ধি করেন যে ভারতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যথেষ্ট নয়।

    * ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (IACS) প্রতিষ্ঠা (১৮৭৬): তাঁর দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল নিজস্ব উদ্যোগে বিজ্ঞান গবেষণা ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে জনপ্রিয় করা। তিনি ভারতবাসীর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই সি.ভি. রমন এবং মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণা পরিচালনা করেন।

* জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭): আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।

    * অবদান: পদার্থবিজ্ঞান, জীবপদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং বেতার বিজ্ঞানে তাঁর মৌলিক অবদান রয়েছে। তিনি বেতার তরঙ্গের ক্ষুদ্র তরঙ্গ ব্যবহার করে দূরপাল্লার যোগাযোগের পথিকৃৎ ছিলেন।

    * উদ্ভিদ বিজ্ঞান: ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করে প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদের প্রাণ আছে এবং তারা উদ্দীপনায় সাড়া দেয়।

    * প্রতিষ্ঠা: ১৯১৭ সালে 'বসু বিজ্ঞান মন্দির' (Bose Institute) প্রতিষ্ঠা করেন।

* প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪): প্রখ্যাত রসায়নবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তা।

    * অবদান: মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেন। 'এ হিস্টোরি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি' তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।

    * প্রতিষ্ঠা: ১৯০১ সালে 'বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস' প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল ভারতের প্রথম স্বদেশী শিল্প উদ্যোগগুলির অন্যতম। এর মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং শিল্পের বিকাশে অবদান রাখেন।


ঘ. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ:

* উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে এবং বিশ শতকের শুরু থেকে ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ে।

* বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন বিজ্ঞান সমিতি, পাঠচক্র ও পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে।

* কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়।


ঙ. গুরুত্ব:

* কুসংস্কার দূরীকরণ: বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিবাদী চিন্তাধারাকে উৎসাহিত করে এবং কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করতে সাহায্য করে।

* জাতীয়তাবাদী প্রেরণা: ভারতীয় বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন যে বিজ্ঞান গবেষণায় ভারতীয়রা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই, যা আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় গর্ব বাড়ায়।

* শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশ: প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো বিজ্ঞানীর উদ্যোগ ভারতে স্বদেশী শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশে পথ দেখায়।

* স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ: আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে সহায়ক হয়।

* আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো বিজ্ঞানীদের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ভারতের সম্মান বৃদ্ধি করে।


উপসংহার:

উনিশ শতকে আধুনিক দেশীয় সাহিত্য, সংবাদপত্র ও জনমত এবং বৈজ্ঞানিক ধারণার বিকাশ ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। এগুলি পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এক নতুন আধুনিক ভারতের জন্ম দেয়, যা একদিকে নিজস্ব ঐতিহ্যকে ধারণ করে, অন্যদিকে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সংহতি স্থাপন করে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলে। এই পরিবর্তনগুলিই পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করে।