মুঘল সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক স্বর্ণালী অধ্যায় রচনা করেছে। সামরিক শক্তি, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি মুঘল শাসকরা শিল্পকলা, সাহিত্য ও স্থাপত্যের এক অসাধারণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের রাজত্বকালে পারসিক, মধ্য এশীয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল, যা মুঘল শিল্পকলা ও সাহিত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
১. বাবরের আমল (১৫২৬-১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ): মুঘল সাহিত্যের সূচনা
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর একজন বিচক্ষণ শাসক হওয়ার পাশাপাশি একজন সুশিক্ষিত সাহিত্যপ্রেমীও ছিলেন। যদিও তার সময়কালে ভারতে মুঘল চিত্রকলার তেমন বিকাশ ঘটেনি, তবে তিনি আত্মজীবনী লেখার মাধ্যমে মুঘল সাহিত্যচর্চার এক শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেন।
* প্রধান সাহিত্যকর্ম ও লেখক:
- বাবরনামা (Tuzuk-i-Baburi): বাবরের নিজ হাতে লেখা এই আত্মজীবনী মুঘল সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এটি চাগতাই তুর্কি ভাষায় লেখা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়। বাবরনামায় তার জীবন, যুদ্ধ, ভারত এবং মধ্য এশিয়ার প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতির বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এটি কেবল একটি আত্মজীবনী নয়, বরং ইতিহাস, ভূগোল ও সমাজতত্ত্বের এক জীবন্ত দলিল।
২. হুমায়ুনের আমল (১৫৩০-১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ): পারসিক চিত্রকলার আগমন
বাবরের পুত্র হুমায়ুনও শিল্পের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। পারস্যে নির্বাসিত থাকার সময় তিনি পারসিক চিত্রকলার সাথে পরিচিত হন এবং ভারতে ফিরে আসার সময় দুই প্রখ্যাত পারসিক চিত্রশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন, যারা মুঘল চিত্রকলার ভিত্তি স্থাপন করেন।
* প্রধান শিল্পী ও তাদের অবদান:
- মির সৈয়দ আলী (Mir Sayyid Ali): তিনি পারস্যের তাবরিজ থেকে এসেছিলেন এবং হুমায়ুনের দরবারে যোগ দেন। তার শিল্পকর্ম পারসিক মিনিয়েচার শৈলীর বৈশিষ্ট্য বহন করত।
- আব্দুস সামাদ (Abdus Samad): ইনিও পারসিক শিল্পী ছিলেন এবং মুঘল চিত্রকলাকে একটি নতুন মাত্রা দেন। হুমায়ুন তার তত্ত্বাবধানে একটি চিত্রশালা প্রতিষ্ঠা করেন।
- উল্লেখযোগ্য কর্ম: এই দুই শিল্পী যৌথভাবে সুবিশাল 'হামজানামা' (দস্তান-ই-আমির হামজা)-এর চিত্রাঙ্কনের কাজ শুরু করেন, যা আকবরের আমলে সমাপ্ত হয়। এটি হাজার হাজার চিত্রকর্ম সংবলিত একটি মহাকাব্যিক গ্রন্থ।
৩. আকবরের আমল (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ): শিল্প ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ
আকবরের রাজত্বকাল মুঘল শিল্পকলা ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। তিনি শিল্পীদের বিশাল পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং তার দরবারে অসংখ্য গুণী শিল্পী ও লেখক ছিলেন। তিনি একটি বৃহৎ চিত্রশালা (কারখানা) স্থাপন করেন যেখানে শত শত শিল্পী কাজ করতেন।
* প্রধান শিল্পী ও তাদের অবদান (চিত্রকলা):
- দশবন্ত (Daswanth): আকবরের আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিন্দু চিত্রশিল্পী। তিনি মূলত একজন সাধারণ পালকির বাহক ছিলেন, কিন্তু তার প্রতিভা আকবরের নজরে আসে এবং তিনি তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তিনি মহাকাব্য এবং ফারসি সাহিত্যের বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক চিত্র এঁকেছিলেন।
- বাসাওয়ান (Basawan): আকবরী চিত্রকলার আরেক প্রভাবশালী শিল্পী। তিনি রঙ, মানুষের মুখের অভিব্যক্তি এবং পটভূমি চিত্রণে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তার আঁকা ছবিতে ত্রিমাত্রিকতা ও বাস্তবতার ছাপ ছিল।
- কেসু দাস (Kesu Das): ইনিও আকবরের দরবারের একজন প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন। তিনি মূলত পোর্ট্রেট অঙ্কনে দক্ষ ছিলেন।
- মির্জা সৈয়দ আলী ও আব্দুস সামাদ: এরা উভয়েই আকবরের রাজত্বকালে কাজ চালিয়ে যান এবং 'হামজানামা' প্রকল্পের সমাপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- প্রধান লেখক ও তাদের অবদান (সাহিত্য ও ইতিহাস):
- আবুল ফজল (Abul Fazl): আকবরের প্রধান উপদেষ্টা ও সভাসদ। তিনি মুঘল আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ও লেখক।
- আকবরনামা (Akbarnama): আকবরের রাজত্বের বিস্তারিত ইতিহাস। এটি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও সামাজিক কাঠামোর এক বিশদ বর্ণনা।
- আইন-ই-আকবরী (Ain-i-Akbari): আকবরনামার তৃতীয় খণ্ড, যা আকবরের শাসনতন্ত্র, রাজস্ব ব্যবস্থা, অর্থনীতি, ভূগোল এবং সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে।
- ফৈজি (Faizi): আবুল ফজলের বড় ভাই এবং আকবরের দরবারের রাজকবি। তিনি ফারসি ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন।
- অনুবাদ কর্ম: ফৈজি সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনুবাদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার তত্ত্বাবধানে মহাভারত, রামায়ণ, অথর্ববেদ এবং পাটিগণিতের বিখ্যাত গ্রন্থ 'লীলাবতী' ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়।
- বীরবল (Birbal): আকবরের নবরত্নের একজন এবং তার প্রধান বিচক্ষণ সভাসদ। তিনি তার বুদ্ধি ও কৌতুকের জন্য পরিচিত ছিলেন, যদিও তার সাহিত্যকর্ম সরাসরি পাওয়া যায় না, তবে তার নাম লোককথার মাধ্যমে অমর হয়ে আছে।
- উল্লেখযোগ্য অনুবাদ কর্ম (আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায়):
- রাজমনামা (Razmnama): মহাভারতের ফারসি অনুবাদ।
- রামায়ণ, অথর্ববেদ, লীলাবতী, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত গ্রন্থের ফারসি অনুবাদ।
৪. জাহাঙ্গীরের আমল (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ): চিত্রকলার পরিপূর্ণ বিকাশ
জাহাঙ্গীর শিল্পের একজন উচ্চমানের সমঝদার ছিলেন এবং নিজেই একজন চিত্র সমালোচক ছিলেন। তার রাজত্বকালে মুঘল চিত্রকলা তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে। তিনি প্রকৃতি, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিশেষ গুরুত্ব দেন।
* প্রধান শিল্পী ও তাদের অবদান (চিত্রকলা):
- ওস্তাদ মনসুর (Ustad Mansur): জাহাঙ্গীরের দরবারের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী ও উদ্ভিদ চিত্রকর। তাকে 'নাহির-উল-আসর' (যুগের শ্রেষ্ঠ) উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি বিরল প্রজাতির প্রাণী ও পাখির নিখুঁত ছবি আঁকতেন।
- বিশনদাস (Bishandas): প্রতিকৃতি অঙ্কনে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি জাহাঙ্গীর ও তার সভাসদদের অনেক নিখুঁত প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন।
- আবুল হাসান (Abul Hasan): তিনি জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত শিল্পী ছিলেন এবং তাকে 'নাহির-উজ-জামান' (যুগের বিস্ময়) উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তার আঁকা দরবারের দৃশ্য, শিকারের দৃশ্য এবং ব্যক্তিগত প্রতিকৃতিগুলো অত্যন্ত জীবন্ত ছিল।
- গোভর্ধন (Govardhan): ইনিও প্রতিকৃতি অঙ্কনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
* প্রধান সাহিত্যকর্ম ও লেখক:
- তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী (Tuzuk-i-Jahangiri): জাহাঙ্গীরের নিজ হাতে লেখা আত্মজীবনী। বাবরনামার মতো এটিও তার শাসনকাল, ব্যক্তিগত জীবন, প্রকৃতির প্রতি আগ্রহ এবং শিল্পের প্রতি তার ভালবাসার এক বিশদ বর্ণনা। এটি ফারসি ভাষায় লেখা হয়েছিল।
৫. শাহজাহানের আমল (১৬২৭-১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ): স্থাপত্যের যুগ ও নতুন সাহিত্য ধারা
শাহজাহানের আমলে স্থাপত্যকলা তার শিখরে পৌঁছেছিল (যেমন তাজমহল), তবে চিত্রকলা ও সাহিত্যচর্চাও অব্যাহত ছিল। এই সময়ে কিছু নতুন ধারার সাহিত্যিকদের আবির্ভাব হয়, বিশেষ করে দারার মতো দার্শনিক লেখকের।
* প্রধান শিল্পী ও তাদের অবদান (চিত্রকলা):
- মুহাম্মদ নাদির সমরকান্দি (Muhammad Nadir Samarqandi): শাহজাহানের সময়ের অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী।
- যদিও চিত্রকলায় জাহাঙ্গীরের সময়ের মতো ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না, শিল্পীরা বাস্তবধর্মী চিত্র এবং কিছু ঐতিহাসিক চিত্রের দিকে মনোযোগ দেন।
* প্রধান লেখক ও তাদের অবদান (সাহিত্য):
- দারা শিকোহ (Dara Shikoh): শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক ও পণ্ডিত। তিনি মুঘল রাজপরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতীয় ধর্মীয় দর্শন নিয়ে গভীর আগ্রহী ছিলেন।
- সিরর-ই-আকবর (Sirr-i-Akbar): উপনিষদের ফারসি অনুবাদ। দারা ৪০টিরও বেশি উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন।
- মাজমা-উল-বাহরাইন (Majma-ul-Bahrain): হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মরমী ধারণার মধ্যে সাদৃশ্য নিয়ে একটি গ্রন্থ।
- অন্যান্য অনুবাদ: তিনি ভগবদ্গীতা এবং যোগবশিষ্ঠ-এরও ফারসি অনুবাদ করেছিলেন। তার কাজগুলি মুঘল আমলে ধর্মীয় সংহতি এবং জ্ঞান বিনিময়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
৬. আওরঙ্গজেবের আমল (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরবর্তী পর্যায়: পৃষ্ঠপোষকতার হ্রাস
আওরঙ্গজেব একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম শাসক ছিলেন এবং তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত সংযমী। তিনি ইসলামি আইন ও ধর্মীয় গবেষণায় বেশি মনোযোগী ছিলেন এবং চিত্রকলা ও সঙ্গীত সহ অন্যান্য শিল্পকলায় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস করেন।
* প্রধান সাহিত্যকর্ম:
- ফতোয়া-ই-আলমগীরী (Fatawa-i-Alamgiri): আওরঙ্গজেবের নির্দেশনায় ইসলামিক আইনের একটি বিশাল সংকলন। এটি সুন্নি হানাফি আইনশাস্ত্রের এক প্রামাণ্য গ্রন্থ।
- যদিও ঐতিহাসিক গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা কমে যায়, তার সময়ে মির্জা মুহাম্মদ কাজিম কর্তৃক 'আলমগীরনামা' লিখিত হয়েছিল, যা তার রাজত্বের প্রথম দশ বছরের ইতিহাস। তবে আওরঙ্গজেব পরে ইতিহাস লেখকদের নিরুৎসাহিত করেন।
- শিল্পকলা: যদিও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা কমে গিয়েছিল, কিন্তু প্রাদেশিক দরবার এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্পচর্চা অব্যাহত ছিল, যা পরবর্তীতে আঞ্চলিক চিত্রকলা শৈলীর বিকাশে সহায়ক হয়।
উপসংহার
মুঘল আমল ভারতের শিল্পকলা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে। বাবর থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত প্রত্যেক সম্রাটই নিজ নিজ উপায়ে শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। পারসিক ও ভারতীয় শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল মুঘল চিত্রকলায়, যা স্বতন্ত্র মুঘল মিনিয়েচার শৈলীর জন্ম দেয়। বাবর ও জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী, আবুল ফজল ও ফৈজির মতো পণ্ডিতদের ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক অবদান এবং দারা শিকোহের মতো দার্শনিকদের অনুবাদ কর্ম মুঘল সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। যদিও আওরঙ্গজেবের আমলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস পায়, মুঘলদের রেখে যাওয়া শিল্প ও সাহিত্যের এই বিপুল ঐতিহ্য আজও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।