অশোকের শিলা লেখ ও স্তম্ভ লেখ একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা

এখানে অশোকের শিলা লেখ ও স্তম্ভ লেখগুলি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব নিবন্ধ দেওয়া হলো

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন মৌর্য সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২)। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে তিনি গভীরভাবে অনুতপ্ত হন এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে 'ধম্ম' (ধর্ম) প্রসারে মনোনিবেশ করেন। তাঁর এই নৈতিক ও প্রশাসনিক আদর্শগুলি প্রজাদের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পাথর কেটে বা স্তম্ভ নির্মাণ করে শিলা লেখ ও স্তম্ভ লেখ খোদাই করান। এই লেখগুলি কেবল অশোকের শাসনকাল, তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রশাসনিক নীতিগুলি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যই দেয় না, বরং প্রাচীন ভারতীয় লিপি এবং ভাষার গবেষণার ক্ষেত্রেও এক অপরিহার্য উৎস। এই নিবন্ধে আমরা অশোকের শিলা লেখ ও স্তম্ভ লেখগুলির প্রেক্ষাপট, প্রকারভেদ, বিষয়বস্তু এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য (Context and Purpose)

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬১) অশোকের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁকে এতটাই বিচলিত করে যে তিনি শসস্ত্র বিজয় (‘দিগ্বিজয়’) নীতি পরিত্যাগ করে 'ধম্মবিজয়' (ধর্মের মাধ্যমে বিজয়) নীতি গ্রহণ করেন। এই নতুন নীতি এবং তাঁর আদর্শগুলি প্রজাদের মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশ্যেই তিনি এই লেখগুলি খোদাই করান।

মূল উদ্দেশ্যগুলি ছিল:

  • ধর্ম প্রচার: 'ধম্ম'-এর নীতিগুলি (যেমন – অহিংসা, সহিষ্ণুতা, প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, সৎ আচরণ) জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।
  • নৈতিক নির্দেশনা: প্রজাদের মধ্যে নৈতিকতা ও সদ্গুণ জাগ্রত করা।
  • প্রশাসনিক নির্দেশ: বিভিন্ন প্রশাসনিক নির্দেশ ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা।
  • নিজের পরিচয় স্থাপন: একজন ধর্মপ্রাণ এবং জনদরদী শাসক হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরি করা।

লেখগুলির প্রকারভেদ (Types of Edicts)

অশোকের লেখগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: শিলা লেখ (Rock Edicts) এবং স্তম্ভ লেখ (Pillar Edicts)। এইগুলি আবার বৃহৎ (Major) ও ক্ষুদ্র (Minor) এই দুটি উপ-বিভাগে বিভক্ত।

১. শিলা লেখ (Rock Edicts):

  • এগুলি সাধারণত পাহাড়ের গায়ে বা বৃহৎ পাথরের চাঁইয়ের উপর খোদাই করা হয়েছে।
  • ক. বৃহৎ শিলা লেখ (Major Rock Edicts):

* সংখ্যায় মোট ১৪টি।

  • এগুলি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাওয়া গেছে, যেমন – গিরনার (গুজরাট), ধৌলি ও জওগড় (ওড়িশা), কালসী (উত্তরাখণ্ড), শাহবাজগড়ি ও মনশেরা (পাকিস্তান), ইত্যাদি।
  • এগুলির বিষয়বস্তু তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ এবং ধম্মের মূল নীতি, কল্যাণমূলক কাজ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, এবং প্রশাসনিক নির্দেশাবলীর উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
  • খ. ক্ষুদ্র শিলা লেখ (Minor Rock Edicts):

* সংখ্যায় অনেক বেশি এবং ক্ষুদ্রাকৃতির।

  • এগুলি মূলত অশোকের ব্যক্তিগত ধর্মান্তর এবং বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা সম্পর্কে আলোকপাত করে।
  • ব্রহ্মগিরি, মাস্কি, গবিমাথ, অরহুরা, রূপনাথ – এই ধরনের উল্লেখযোগ্য স্থান। মাস্কি, গুজররা, নিতুর, এবং উদগোলম লেখগুলিতে অশোকের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে, যা তাঁর প্রকৃত পরিচয় নির্ণয়ে সাহায্য করেছে।

২. স্তম্ভ লেখ (Pillar Edicts):

  • এগুলি মসৃণ পাথর দ্বারা নির্মিত বিশালাকৃতির স্তম্ভের উপর খোদাই করা হয়েছে। এই স্তম্ভগুলি প্রায়শই বিশেষ স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল।
  • ক. বৃহৎ স্তম্ভ লেখ (Major Pillar Edicts):

* সংখ্যায় ৭টি।

  • এগুলি সাধারণত দীর্ঘ এবং ধম্মের বিশদ ব্যাখ্যা, অশোকের প্রশাসনিক নীতি, এবং তাঁর ব্যক্তিগত 'ধম্মবিজয়' প্রচেষ্টার বিবরণ দেয়।
  • দিল্লি-টোপরা, দিল্লি-মীরাট, লৌরিয়া-নন্দগড়, লৌরিয়া-আরেরাজ, রামপুরওয়া, এলাহাবাদ-কৌশাম্বী – এইগুলি উল্লেখযোগ্য।
  • খ. ক্ষুদ্র স্তম্ভ লেখ (Minor Pillar Edicts):
  • এগুলি সাধারণত সংক্ষিপ্ত এবং নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করে।

* উদাহরণ:

  • সারনাথ, সাঁচি, কৌশাম্বী লেখগুলি বৌদ্ধ সংঘের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করার নির্দেশ দেয়।
  • লুম্বিনি (রুম্মিনদেই) লেখটি বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে লুম্বিনির গুরুত্ব এবং সেখানকার ভূমি রাজস্ব হ্রাস করার কথা বলে।
  • নিগালি সাগর লেখটি কনকমুনি বুদ্ধের স্তূপের সম্প্রসারণের কথা উল্লেখ করে।

ভাষা ও লিপি (Language and Script)

অশোকের বেশিরভাগ লেখই প্রাকৃত ভাষায় লেখা এবং ব্রাহ্মী লিপিতে খোদাই করা হয়েছে। তবে সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভিন্ন ভাষা ও লিপি ব্যবহৃত হয়েছে, যা অশোকের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার ইঙ্গিত দেয়।

  • ভাষা: অধিকাংশ লেখ প্রাকৃত ভাষায় (বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষা সহ)।

* লিপি:

  • ব্রাহ্মী: বেশিরভাগ লেখ (ভারতের মূল ভূখণ্ডে) এই লিপিতে লেখা। এটি বাম থেকে ডানে লেখা হতো।
  • খরষ্ঠী: উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে (যেমন - শাহবাজগড়ি, মনশেরা) এই লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। এটি ডান থেকে বামে লেখা হতো।
  • গ্রিক ও আরামাইক: আফগানিস্তান অঞ্চলে (যেমন – কান্দাহার) কিছু লেখ গ্রিক ও আরামাইক ভাষায় এবং লিপিতে পাওয়া গেছে, যা এই অঞ্চলের বহুজাতিক জনসংখ্যার প্রতি অশোকের সহনশীল মনোভাবের পরিচয়।

গুরুত্বপূর্ণ শিলা লেখ ও স্তম্ভ লেখের বিষয়বস্তু (Content of Important Rock and Pillar Edicts)

অশোকের লেখগুলি থেকে প্রাপ্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

বৃহৎ শিলা লেখ (Major Rock Edicts):

  • প্রথম শিলা লেখ (MRE-I): পশুবলি এবং উৎসবের সময় পশুহত্যা নিষিদ্ধ করার নির্দেশ।
  • দ্বিতীয় শিলা লেখ (MRE-II): মানব ও পশুর জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা, রাস্তা নির্মাণ, কূপ খনন এবং ঔষধি গাছ রোপণের কথা।
  • তৃতীয় শিলা লেখ (MRE-III): ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের প্রতি উদারতা, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং স্বল্প ব্যয়ের উপর জোর।
  • পঞ্চম শিলা লেখ (MRE-V): 'ধম্ম মহামাত্র' (ধর্মীয় আধিকারিক) নিয়োগের কথা, যাদের কাজ ছিল ধম্মের নীতি প্রচার এবং জনগণের কল্যাণ সাধন।
  • সপ্তম শিলা লেখ (MRE-VII): সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা।
  • একাদশ শিলা লেখ (MRE-XI): 'ধম্ম-দান' (ধর্মীয় উপহার) বা ধর্মীয় দানকে শ্রেষ্ঠ দান হিসেবে ঘোষণা।
  • ত্রয়োদশ শিলা লেখ (MRE-XIII): কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনা, অশোকের অনুশোচনা, এবং ধর্মবিজয়ের গুরুত্ব। এই লেখটি অশোকের জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে।

ক্ষুদ্র শিলা লেখ (Minor Rock Edicts):

  • প্রথম ক্ষুদ্র শিলা লেখ (MRE-I): অশোকের ব্যক্তিগতভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ এবং সংঘের প্রতি তাঁর ভক্তি প্রকাশ। (মাস্কি, গুজররা, নিতুর, উদগোলম লেখগুলিতে অশোকের নাম 'দেবানামপ্রিয় প্রিয়দাসী' এর সাথে 'অশোক' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।)

বৃহৎ স্তম্ভ লেখ (Major Pillar Edicts):

  • ষষ্ঠ স্তম্ভ লেখ (MPE-VI): ধম্মের নীতি প্রচারের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধনের উপর জোর।
  • সপ্তম স্তম্ভ লেখ (MPE-VII): অশোকের ধম্ম নীতির সারাংশ, ধম্ম প্রসারে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ এবং ধম্মের সার্বজনীনতা। এটি অশোকের ধম্ম সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করে।

ক্ষুদ্র স্তম্ভ লেখ (Minor Pillar Edicts):

  • সারনাথ/সাঁচি/কৌশাম্বী স্তম্ভ লেখ: বৌদ্ধ সংঘে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি।
  • লুম্বিনি (রুম্মিনদেই) স্তম্ভ লেখ: বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনিতে অশোকের তীর্থযাত্রার কথা এবং সেখানকার গ্রামগুলির ভূমি রাজস্ব এক-অষ্টমাংশে কমানোর নির্দেশ। এই লেখটি বুদ্ধের জন্মস্থান নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে।

লেখগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব (Historical Significance of Edicts)

অশোকের শিলা লেখ ও স্তম্ভ লেখগুলি ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে:

  • মৌর্য যুগ সম্পর্কে প্রাথমিক উৎস: এগুলি অশোকের শাসনকাল, তাঁর প্রশাসন, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে সরাসরি ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ করে।
  • অশোকের ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন: এগুলি থেকে একজন শাসক হিসেবে অশোকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, নৈতিক মূল্যবোধ এবং প্রজাদের প্রতি তাঁর উদ্বেগের গভীরতা বোঝা যায়।
  • বৌদ্ধধর্মের প্রসারের প্রমাণ: লেখগুলি থেকে জানা যায়, কিভাবে অশোক বৌদ্ধধর্মকে কেবল ভারত নয়, পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতেও ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
  • ভাষাতত্ত্ব ও লিপিতত্ত্বের গবেষণা: ১৮৩৭ সালে জেমস প্রিন্সেপ কর্তৃক ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার এই লেখগুলির মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল, যা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
  • সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন: কিছু লেখ থেকে তৎকালীন সমাজের রীতিনীতি, প্রাণী কল্যাণ, এবং রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
  • ঐতিহাসিক ভূগোল: লেখগুলির অবস্থান মৌর্য সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তৃতি নির্ধারণে সহায়তা করে।

উপসংহার (Conclusion)

অশোকের শিলা লেখ ও স্তম্ভ লেখগুলি কেবল প্রাচীন ভারতের এক মহান সম্রাটের বার্তা নয়, বরং মানবজাতির জন্য শান্তি, সহনশীলতা এবং নৈতিকতার এক চিরন্তন দলিল। এগুলি তৎকালীন ভারতীয় সমাজ, ধর্ম, এবং প্রশাসনের এক মূল্যবান চিত্র তুলে ধরে। হাজার হাজার বছর পরেও এই লেখগুলি অশোককে একজন দূরদর্শী শাসক এবং মানবতাবাদী নেতা হিসেবে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি তাঁর সাম্রাজ্যের সীমারেখা পেরিয়ে এক নৈতিক উত্তরাধিকার স্থাপন করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি আমাদের অতীতের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করে এবং ইতিহাসের এক আলোকিত অধ্যায়কে জীবন্ত রাখে।