জৈন ধর্মের ২৪ জন তীর্থঙ্কর এবং তাঁদের প্রতীক সম্পর্কিত আলোচনা।

প্রত্যেক তীর্থঙ্করের একটি নিজস্ব প্রতীক বা চিহ্ন রয়েছে। এই প্রতীকগুলি তাঁদের সহজভাবে চিনতে এবং স্মরণ করতে সাহায্য করে।

জৈনধর্ম একটি প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম, যা আত্মনিয়ন্ত্রণ, অহিংসা এবং আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই ধর্মের মূল ভিত্তি হলেন তীর্থঙ্করগণ। 'তীর্থঙ্কর' শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে – 'তীর্থ' (অর্থাৎ একটি পথ বা ঘাট যা পার হয়ে যাওয়া যায়) এবং 'কর' (অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা বা যিনি তৈরি করেন)। সুতরাং, তীর্থঙ্কর মানে যিনি সংসার রূপ সাগরের এপার থেকে ওপারে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেন বা দেখিয়ে দেন। তাঁরা হলেন সেই মহাপুরুষেরা, যাঁরা নিজেদের সাধনা ও তপস্যার মাধ্যমে 'কেবলজ্ঞান' (সর্বোচ্চ জ্ঞান বা সর্বজ্ঞতা) অর্জন করেন এবং অন্য জীবের মুক্তির পথ দেখান। জৈন বিশ্বাস অনুসারে, মোট ২৪ জন তীর্থঙ্কর ছিলেন, যাঁরা যুগে যুগে আবির্ভূত হয়ে সত্যের পথে নির্দেশনা দিয়েছেন। এই প্রবন্ধে আমরা সেই ২৪ জন তীর্থঙ্কর, তাঁদের নাম এবং তাঁদের সঙ্গে যুক্ত প্রতীকী চিহ্নগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

তীর্থঙ্কর কারা এবং কেন তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ?

তীর্থঙ্করগণ হলেন জৈনধর্মের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক শিক্ষক। তাঁরা ঈশ্বর নন, বরং এমন আদর্শ মানুষ যাঁরা নিজেদের চারিত্রিক পূর্ণতা ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করেছেন এবং অন্যদেরও সেই পথ দেখিয়েছেন। তাঁদের জীবন ও শিক্ষা জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্য অনুপ্রেরণা ও পথনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি তীর্থঙ্কর তাঁর সময়ে জৈন সংঘ (সাধু, সাধ্বী, শ্রাবক, শ্রাবিকা - অর্থাৎ সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী, পুরুষ গৃহস্থ এবং নারী গৃহস্থ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ধর্মীয় নীতি ও দর্শন প্রচার করেছিলেন।

প্রতীক বা চিহ্নের গুরুত্ব

প্রত্যেক তীর্থঙ্করের একটি নিজস্ব প্রতীক বা চিহ্ন রয়েছে। এই প্রতীকগুলি তাঁদের সহজভাবে চিনতে এবং স্মরণ করতে সাহায্য করে। এই চিহ্নগুলি সাধারণত তাঁদের জন্ম বা জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকে অথবা তাঁদের বিশেষ কোনো গুণাবলীকে নির্দেশ করে। জৈন মন্দিরে বা চিত্রে তীর্থঙ্করদের চিহ্নিত করার জন্য এই প্রতীকগুলি ব্যবহৃত হয়। এই প্রতীকগুলির মাধ্যমে ভক্তরা নির্দিষ্ট তীর্থঙ্করের গুণাবলী ও শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে পারেন।

২৪ জন তীর্থঙ্কর এবং তাঁদের প্রতীক

জৈনধর্ম অনুসারে ২৪ জন তীর্থঙ্কর হলেন:

১. ঋষভনাথ (আদিনাথ)

* প্রতীক: বৃষ (ষাঁড়)

  • বিবরণ: তিনি ছিলেন প্রথম তীর্থঙ্কর এবং জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত। তাঁর প্রতীক বৃষ শক্তি ও বীরত্বের প্রতীক।

২. অজিতনাথ

* প্রতীক: হস্তী (হাতি)

  • বিবরণ: দ্বিতীয় তীর্থঙ্কর। হাতি শক্তি, স্থিতিশীলতা এবং জ্ঞান নির্দেশ করে।

৩. সম্ভবনাথ

* প্রতীক: অশ্ব (ঘোড়া)

  • বিবরণ: তৃতীয় তীর্থঙ্কর। ঘোড়া গতি, শক্তি এবং আধ্যাত্মিক অগ্রগতির প্রতীক।

৪. অভিনন্দননাথ

* প্রতীক: কপি (বাঁদর)

  • বিবরণ: চতুর্থ তীর্থঙ্কর। বাঁদর অস্থির মনকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতীক।

৫. সুমতিনাথ

* প্রতীক: ক্রৌঞ্চ (বক)

  • বিবরণ: পঞ্চম তীর্থঙ্কর। বক একাগ্রতা এবং আধ্যাত্মিক গভীরতার প্রতীক।

৬. পদ্মপ্রভ

* প্রতীক: লাল পদ্ম

  • বিবরণ: ষষ্ঠ তীর্থঙ্কর। পদ্ম পবিত্রতা, জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রতীক।

৭. সুপার্শ্বনাথ

* প্রতীক: স্বস্তিক

  • বিবরণ: সপ্তম তীর্থঙ্কর। স্বস্তিক শান্তি, সমৃদ্ধি এবং চারটি গতির (দেবতা, মানুষ, তির্যক, নরক) প্রতীক।

৮. চন্দ্রপ্রভ

* প্রতীক: চন্দ্র (চাঁদ)

  • বিবরণ: অষ্টম তীর্থঙ্কর। চাঁদ শান্তি, স্নিগ্ধতা এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক।

৯. সুবিধিনাথ (পুষ্পদন্ত)

* প্রতীক: মকর (কুমির সদৃশ জলজ প্রাণী)

  • বিবরণ: নবম তীর্থঙ্কর। মকর জলজ জীবনের প্রতীক, যা পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্তির ইঙ্গিত দেয়।

১০. শীতলনাথ

  • প্রতীক: শ্রীবৎস (হৃদয় চিহ্নিত প্রতীক) / কল্পবৃক্ষ
  • বিবরণ: দশম তীর্থঙ্কর। শ্রীবৎস আধ্যাত্মিক পূর্ণতা এবং কল্পবৃক্ষ মনোবাঞ্ছা পূরণের প্রতীক।

১১. শ্রেয়াংসনাথ

* প্রতীক: গণ্ডার

  • বিবরণ: একাদশ তীর্থঙ্কর। গণ্ডার নির্জনতা, আত্মনির্ভরশীলতা এবং শক্তিশালী ইচ্ছার প্রতীক।

১২. বাসুপূজ্য

* প্রতীক: মহিষ

  • বিবরণ: দ্বাদশ তীর্থঙ্কর। মহিষ স্থায়িত্ব এবং পার্থিব ইচ্ছার উপর বিজয়ের প্রতীক।

১৩. বিমলনাথ

* প্রতীক: বরাহ (শূকর)

  • বিবরণ: ত্রয়োদশ তীর্থঙ্কর। বরাহ ভয়হীনতা এবং আধ্যাত্মিক দৃঢ়তার প্রতীক।

১৪. অনন্তনাথ

  • প্রতীক: শশক (খরগোশ) / বাজপাখি (Hawk)
  • বিবরণ: চতুর্দশ তীর্থঙ্কর। খরগোশ চঞ্চলতা এবং পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্তির প্রতীক।

১৫. ধর্মনাথ

* প্রতীক: বজ্রদণ্ড (বজ্র)

  • বিবরণ: পঞ্চদশ তীর্থঙ্কর। বজ্রদণ্ড জ্ঞান ও ধর্মের শক্তি, যা অজ্ঞতাকে ধ্বংস করে।

১৬. শান্তিনাথ

* প্রতীক: মৃগ (হরিণ)

  • বিবরণ: ষোড়শ তীর্থঙ্কর। হরিণ শান্তি, কোমলতা এবং ভয়হীনতার প্রতীক।

১৭. কুন্থুনাথ

* প্রতীক: ছাগল

  • বিবরণ: সপ্তদশ তীর্থঙ্কর। ছাগল আত্ম-সংযম এবং পার্থিব ভোগ থেকে মুক্তির প্রতীক।

১৮. অরনাথ

  • প্রতীক: নন্দ্যাবর্ত (একটি বিশেষ প্রতীক) / মৎস্য (মাছ)
  • বিবরণ: অষ্টাদশ তীর্থঙ্কর। নন্দ্যাবর্ত সুখ ও সৌভাগ্যের প্রতীক, আর মৎস্য মুক্ত জীবনের প্রতীক।

১৯. মল্লিনাথ

* প্রতীক: কলস (জলপূর্ণ ঘট)

  • বিবরণ: ঊনবিংশ তীর্থঙ্কর। কলস বিশুদ্ধতা এবং সম্পূর্ণতার প্রতীক।

২০. মুনিসুব্রত

* প্রতীক: কচ্ছপ

  • বিবরণ: বিংশ তীর্থঙ্কর। কচ্ছপ স্থায়িত্ব, আত্মরক্ষা এবং ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।

২১. নমিনাথ

* প্রতীক: নীলপদ্ম

  • বিবরণ: একবিংশ তীর্থঙ্কর। নীলপদ্ম শান্তি এবং আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতার প্রতীক।

২২. নেমিনাথ

* প্রতীক: শঙ্খ

  • বিবরণ: দ্বাবিংশ তীর্থঙ্কর। শঙ্খ জ্ঞান, জাগরণ এবং পবিত্রতার প্রতীক। তিনি শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক ছিলেন বলে মনে করা হয়।

২৩. পার্শ্বনাথ

  • প্রতীক: সর্প (সাপ, প্রায়শই ফণা তোলা বহু-মাথা সাপ)
  • বিবরণ: তেইশতম তীর্থঙ্কর। সর্প তাঁর উপর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা (বর্ষণ) থেকে সুরক্ষার প্রতীক এবং আত্মরক্ষার প্রতীক। তিনি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত।

২৪. মহাবীর (বর্ধমান)

* প্রতীক: সিংহ

  • বিবরণ: চব্বিশতম এবং শেষ তীর্থঙ্কর। সিংহ সাহস, শক্তি, ভয়হীনতা এবং রাজকীয় মর্যাদার প্রতীক। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর শিক্ষার উপরই বর্তমান জৈনধর্মের মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

প্রথম ২২ জন তীর্থঙ্করকে পৌরাণিক বা কিংবদন্তি পুরুষ হিসেবে দেখা হয়, যাঁদের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক প্রমাণ খুব কম। তবে ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এবং ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীরকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়। তাঁদের জীবনকাল ও শিক্ষা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। মহাবীরের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯ সালে এবং তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ সালে নির্বাণ লাভ করেন বলে মনে করা হয়।

উপসংহার

জৈন তীর্থঙ্করগণ কেবল নামের তালিকা বা তাদের প্রতীকের সমষ্টি নন, তাঁরা মানবজাতির জন্য আধ্যাত্মিক আলো এবং মুক্তির পথের দিশারী। তাঁদের জীবন ও শিক্ষা জৈনধর্মের মূল নীতি - অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (চুরি না করা), ব্রহ্মচর্য (সতীত্ব) এবং অপরিগ্রহ (অসঞ্চয়) - এর ভিত্তি। এই ২৪ জন মহাপুরুষের জীবন এবং তাঁদের প্রতীকগুলি স্মরণ করে, আমরা তাঁদের দেখানো আত্ম-শুদ্ধি ও মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। তাঁদের প্রতিটি প্রতীকই যেন এক একটি নীরব নির্দেশ, যা আমাদের মনকে আত্মিক উন্নতির দিকে পরিচালিত করে।