মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর এবং তার পরবর্তী সম্রাট আকবরের সুসংহত শাসনের ফলে যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তা আওরঙ্গজেবের (রাজত্বকাল: ১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ) দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজত্বকালে চরম শিখরে পৌঁছলেও, তার কঠোর ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির কারণে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তার মৃত্যুর পরই এই সুবৃহৎ সাম্রাজ্যের পতনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির উত্থান মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করে।
মুঘল আমলের শিল্পী ও লেখকদের নাম ও গ্রন্থের তালিকা
১. আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণ (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ):
* উত্তরাধিকার যুদ্ধ: পিতা সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হওয়ার পর তার চার পুত্র – দারা শিকোহ, শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব ও মুরাদ বক্সের মধ্যে ভয়াবহ উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হয়।
* বিজয়ী: আওরঙ্গজেব তার ভাইদের পরাজিত ও হত্যা করে বা বন্দি করে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে 'আলমগীর' উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তার অসুস্থ পিতাকেও আগ্রা দুর্গে বন্দি করে রাখেন।
২. আওরঙ্গজেবের সম্প্রসারণবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতিসমূহ:
আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সাম্রাজ্যবাদী এবং একই সাথে গোঁড়া সুন্নি মুসলিম শাসক। তার নীতিগুলি সাম্রাজ্যের বিস্তারে সাহায্য করলেও, অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা তীব্র করে তোলে।
ক) ধর্মীয় নীতি (Religious Policy):
আকবরের উদার ধর্মীয় নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং শরিয়ত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
* জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন: ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি অমুসলিমদের উপর থেকে তুলে নেওয়া জিজিয়া কর (মাথাপিছু কর) পুনরায় চালু করেন। এর ফলে সাধারণ হিন্দু প্রজারা এবং রাজপুতরা বিশেষভাবে অসন্তুষ্ট হয়।
* তীর্থকর পুনঃপ্রবর্তন: হিন্দু তীর্থযাত্রীদের উপর থেকে তুলে নেওয়া তীর্থকর আবার চালু করেন।
* মন্দির ধ্বংস: কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির, মথুরার কেশব রায় মন্দির সহ অসংখ্য মন্দির ধ্বংসের নির্দেশ দেন।
* অমুসলিমদের উপর বিধিনিষেধ: হিন্দুদের মেলা, উৎসব, হোলি, দিওয়ালি উদযাপন নিষিদ্ধ করেন। দরবারে ঝরোখা দর্শন, নওরোজ উৎসব, গান-বাজনা নিষিদ্ধ করেন।
* ইসলামে ধর্মান্তরকরণ: অমুসলিমদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন ও চাপ সৃষ্টি করেন। এর ফলে শিখ ও রাজপুতদের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত হয়।
* সরকারি চাকরিতে বৈষম্য: অমুসলিমদের সরকারি উচ্চপদ থেকে সরিয়ে মুসলিমদের নিয়োগ করতে শুরু করেন।
খ) দাক্ষিণাত্য নীতি (Deccan Policy): (সিলেবাসে বিশেষভাবে উল্লিখিত)
আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এবং একে "মুঘল সাম্রাজ্যের ক্যান্সার" বা "দক্ষিণের ঘা" (Deccan Ulcer) বলা হয়। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাজ্যগুলি (বিজয়পুর ও গোলকুন্ডা) এবং উদীয়মান মারাঠা শক্তিকে দমন করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা।
* মারাঠাদের সঙ্গে সংঘাত:
* শিবাজী (Shivaji): মারাঠা নেতা শিবাজী ছিলেন দাক্ষিণাত্যে এক শক্তিশালী স্বাধীন শক্তির প্রতীক। তিনি আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে মুঘলদের নাজেহাল করেন।
* আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খান এবং জয়সিংহকে শিবাজীর বিরুদ্ধে পাঠান। জয়সিংহের সঙ্গে শিবাজীর পুরন্দরের সন্ধি (১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ) স্বাক্ষরিত হয়, যার দ্বারা শিবাজী ২৩টি দুর্গ মুঘলদের হাতে তুলে দেন এবং আওরঙ্গজেবের দরবারে যেতে রাজি হন।
* ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের আগ্রা দরবারে শিবাজীকে বন্দি করা হয়, কিন্তু তিনি কৌশলে পালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রায়গড়ে স্বাধীন ছত্রপতি হিসেবে সিংহাসনে বসেন।
* শিবাজীর সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত মুঘলদের প্রচুর অর্থ ও জনশক্তি নষ্ট করে।
* শম্ভুজী: শিবাজীর মৃত্যুর পর তার পুত্র শম্ভুজী মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যান। ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব শম্ভুজীকে বন্দি করে হত্যা করেন।
* বিজয়পুর ও গোলকুন্ডা দখল: আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের শিয়া সুলতানি রাজ্য বিজয়পুর (১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ) ও গোলকুন্ডা (১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ) দখল করেন। এটি তার সাম্রাজ্যকে ভৌগোলিকভাবে সর্ববৃহৎ করে তোলে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
* দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের প্রভাব: আওরঙ্গজেব জীবনের শেষ ২৭ বছর (১৬৮০-১৭০৭) দাক্ষিণাত্যেই কাটান মারাঠাদের দমন করার জন্য। এই দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধ মুঘল কোষাগার প্রায় শূন্য করে দেয় এবং মুঘল সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। মারাঠা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে দমন করা যায়নি, বরং তারা আরও শক্তিশালী হয়।
গ) রাজপুত নীতি (Rajput Policy):
আকবরের রাজপুতদের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ নীতির পরিবর্তে আওরঙ্গজেব বিদ্বেষপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেন।
* মারওয়ারের রানা যশবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর তার রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন এবং যশবন্ত সিংহের নাবালক পুত্র অজিত সিংকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। এর ফলে মেওয়ার ও মারওয়ারের রাজপুতদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হয়।
* মুঘলদের দীর্ঘদিনের অনুগত রাজপুতরা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে চলে যায়, যা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক স্তম্ভকে দুর্বল করে দেয়।
ঘ) শিখ নীতি (Sikh Policy):
* শিখ গুরু তেগ বাহাদুরকে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে আওরঙ্গজেব ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে মৃত্যুদণ্ড দেন।
* এই ঘটনা শিখদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং গুরু গোবিন্দ সিংহ (গুরু তেগ বাহাদুরের পুত্র) শিখদের একটি সামরিক জাতি 'খালসা'তে পরিণত করেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেন।
ঙ) অন্যান্য বিদ্রোহ:
আওরঙ্গজেবের নীতির কারণে জাট, সাতনামী, বুন্দেলা প্রমুখ আঞ্চলিক জনগোষ্ঠী বিদ্রোহ করে। যদিও এই বিদ্রোহগুলি দমন করা হয়েছিল, তবে এগুলি সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে।
৩. মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে আওরঙ্গজেবের ভূমিকা: (সিলেবাসে বিশেষভাবে উল্লিখিত)
আওরঙ্গজেবের দীর্ঘ শাসনামল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করে, যা তার মৃত্যুর পর ত্বরান্বিত হয়। তার নীতিগুলি সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ফাটলগুলিকে বাড়িয়ে তোলে।
* ১. সাম্রাজ্যের অত্যধিক বিস্তার (Imperial Over-expansion): আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য জয় করে সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তারকে চরম সীমায় নিয়ে যান। কিন্তু এত বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করার মতো দক্ষ প্রশাসন বা পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না। এর ফলে শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে।
* ২. দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব (Long-term Impact of Deccan Wars): আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে যে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধ চালান, তা মুঘল কোষাগারকে শূন্য করে দেয়। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে যায় এবং মুঘল প্রশাসকরা নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। একে "দক্ষিণের ঘা" (Deccan Ulcer) বা "দক্ষিণতাত্য ক্যান্সার" বলা হয়।
* ৩. ধর্মীয় গোঁড়ামি ও বিভাজন (Religious Intolerance and Division): জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন, মন্দির ধ্বংস এবং ইসলামীকরণের প্রচেষ্টা অমুসলিম প্রজাদের alienated (বিচ্ছিন্ন) করে দেয়। এর ফলে শিখ, রাজপুত, মারাঠা এবং অন্যান্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে খারাপ হয়, যা সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।
* ৪. রাজপুতদের সমর্থন হারানো (Loss of Rajput Support): আকবরের আমল থেকে রাজপুতরা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম বিশ্বস্ত স্তম্ভ ছিল। আওরঙ্গজেবের রাজপুত-বিরোধী নীতি তাদের মুঘলদের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়, যা সাম্রাজ্যের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে।
* ৫. জায়গিরদারি সংকট (Jagirdari Crisis): মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা 'মনসবদারি' ও 'জায়গিরদারি' প্রথার উপর নির্ভরশীল ছিল। আওরঙ্গজেবের আমলে জায়গিরের অপ্রাপ্যতা এবং জায়গিরদারদের মধ্যে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। এটি কৃষক বিদ্রোহ এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতার কারণ হয়।
* ৬. আঞ্চলিক শক্তির উত্থান (Rise of Regional Powers): আওরঙ্গজেবের দমনমূলক নীতি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগে মারাঠা, শিখ, জাট, রাজপুত, বুন্দেলা প্রভৃতি আঞ্চলিক শক্তিগুলি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং মুঘলদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে শুরু করে।
* ৭. অর্থনৈতিক দুর্বলতা (Economic Weakness): দীর্ঘ যুদ্ধ, কৃষক বিদ্রোহ এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থা সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। ভূমি রাজস্ব আদায় কমে যায় এবং বাণিজ্য ব্যাহত হয়।
* ৮. অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন (Inefficient and Corrupt Administration): আওরঙ্গজেবের দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা (সুবেদার) স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করেন এবং দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করে।
* ৯. সাম্রাজ্যের বিশালতা ও যোগাযোগ সমস্যা (Vastness of the Empire and Communication Problems): আওরঙ্গজেবের আমলে সাম্রাজ্য এতটাই বিশাল হয়ে গিয়েছিল যে সে সময়কার যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে তা দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
* ১০. উত্তরাধিকারী সংকট (Succession Crisis): আওরঙ্গজেব এমন কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারী তৈরি করে যেতে পারেননি, যিনি তার বিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার বহন করতে পারতেন। তার মৃত্যুর পর দুর্বল শাসকদের মধ্যে পুনরায় উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হয়, যা সাম্রাজ্যের পতনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়।
উপসংহার:
আওরঙ্গজেব নিঃসন্দেহে একজন শক্তিশালী, পরিশ্রমী ও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, যিনি মুঘল সাম্রাজ্যকে ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে তার গোঁড়া ধর্মীয় নীতি, আগ্রাসী দাক্ষিণাত্য নীতি এবং রাজপুত ও শিখদের প্রতি বৈরী মনোভাব সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। তিনি নিজেই এমন সব সমস্যার জন্ম দিয়েছিলেন, যা মুঘল সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার মৃত্যুর পর দুর্বল ও অযোগ্য উত্তরাধিকারী, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা, এবং আঞ্চলিক শক্তির উত্থান মুঘল সাম্রাজ্যের তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে।