বাবর ও তাঁর ভারত আক্রমণের গুরুত্ব (Babar and the importance of his invasion of India)

ইতিহাস সিলেবাসের জন্য "বাবর ও তার ভারত আক্রমণের গুরুত্ব" বিষয়ক বিস্তারিত নোটগুলি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ...

জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর (Zahir-ud-din Muhammad Babur), যিনি মধ্যযুগীয় ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতে মুঘল শাসনের সূচনা করেন। তাঁর ভারত আক্রমণ শুধুমাত্র একটি রাজবংশের পরিবর্তন ছিল না, এটি ভারতের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং সামরিক ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিল।


#### ২. বাবরের পরিচয় ও প্রারম্ভিক জীবন

* বংশ পরিচয়: বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কি-মোঙ্গল বংশোদ্ভূত। তিনি মায়ের দিক থেকে মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খাঁ-এর চতুর্দশ বংশধর এবং পিতার দিক থেকে তুর্কি সেনাপতি তৈমুর লঙ-এর পঞ্চম বংশধর ছিলেন।

* প্রাথমিক জীবন: ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান উজবেকিস্তানের ফারগানায় তাঁর জন্ম হয়। মাত্র ১১ বছর (মতান্তরে ১২ বছর/১৫ বছর) বয়সে তিনি ফারগানার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি সমরকন্দ, বুখারা, কাশগর জয়ের চেষ্টা করলেও সফল হননি। অবশেষে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কান্দাহার ও ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুলের অধিকার লাভ করেন, যা তাঁকে ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে উৎসাহিত করে।


#### ৩. ভারত আক্রমণের কারণ

বাবরের ভারত আক্রমণের পিছনে একাধিক কারণ ছিল, যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত ছিল না, বরং তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মধ্য এশিয়ার পরিবেশ দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল।


* আর্থিক প্রলোভন: ভারতের অপরিসীম ধনসম্পদ ও উর্বর ভূমি বাবরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কাবুলের অর্থনীতি মজবুত ছিল না এবং বাবর তাঁর সেনাবাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান করতে পারছিলেন না।

* ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতা: ১৫শ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ১৬শ শতাব্দীর শুরুতে দিল্লি সালতানাতের শক্তি হ্রাস পেয়েছিল। ইব্রাহিম লোদির দুর্বল ও অত্যাচারী শাসন এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক শক্তির (যেমন – রাজপুত্র, আফগান সর্দার) মধ্যে অনৈক্য বাবরের জন্য পথ সুগম করেছিল। লোদি বংশের ক্ষমতা সীমিত ছিল এবং সমগ্র ভারত জুড়ে বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল।

* আমন্ত্রণ: পাঞ্জাবের গভর্নর দৌলত খাঁ লোদি এবং ইব্রাহিম লোদির কাকা আলম খাঁ লোদি, এমনকি মেবারের রাজপুত শাসক রানা সংগ্রাম সিংহ (সংগ্রাম সিংহ) ইব্রাহিম লোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

* বাবরের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা: মধ্য এশিয়ায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যর্থ হয়ে বাবর এক নতুন সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী 'তুজুক-ই-বাবরী' (বাবরনামা)-তে তিনি লিখেছেন যে, ভারত আক্রমণ তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমুরের উত্তরাধিকার রক্ষার একটি প্রয়াস ছিল।

* সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব: বাবরের কাছে উন্নত কামান এবং প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী ছিল, যা তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের কাছে ছিল না। তাঁর 'তুলঘুমা' (Tulgama) যুদ্ধ কৌশলও ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে অপরিচিত।


#### ৪. বাবরের প্রধান সামরিক অভিযান ও যুদ্ধসমূহ

বাবর মোট পাঁচবার ভারত অভিযান করেন। এর মধ্যে শেষ চারটি যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


* ১. প্রথম পানিপথের যুদ্ধ (১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ):

    * প্রতিপক্ষ: দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদি।

    * স্থান: হরিয়ানার পানিপথ।

    * গুরুত্ব: বাবর তাঁর উন্নত কামান এবং অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ‘তুলঘুমা’ যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করেন, যা লোদির বৃহৎ কিন্তু অপ্রশিক্ষিত ও প্রাচীন পদ্ধতিতে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। ইব্রাহিম লোদি যুদ্ধে নিহত হন। এই যুদ্ধের ফলে ভারতে দিল্লি সালতানাতের অবসান ঘটে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।


* ২. খানুয়ার যুদ্ধ (১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ):

    * প্রতিপক্ষ: মেবারের রাজপুত শাসক রানা সংগ্রাম সিংহ।

    * স্থান: আগ্রার কাছে খানুয়া।

    * গুরুত্ব: রানা সংগ্রাম সিংহ রাজপুতদের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাবরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেন। বাবর এই যুদ্ধকে 'জিহাদ' (ধর্মযুদ্ধ) ঘোষণা করে মুসলিম সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করেন। পানিপথের ন্যায় এখানেও কামানের ব্যবহার ও সুসংগঠিত সামরিক কৌশলের সাহায্যে বাবর জয়লাভ করেন। এই জয় ভারতে রাজপুত শক্তির উত্থানের স্বপ্ন ভঙ্গ করে এবং বাবরের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করে।


* ৩. চান্দেরীর যুদ্ধ (১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ):

    * প্রতিপক্ষ: মালবের মেদিনী রায় (রাজপুত শাসক)।

    * স্থান: চান্দেরী।

    * গুরুত্ব: রাজপুতদের প্রতিরোধ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেওয়ার জন্য বাবর চান্দেরীর দুর্গ আক্রমণ করেন। মেদিনী রায়ের চূড়ান্ত পরাজয় রাজপুতদের সামরিক শক্তিকে আরও দুর্বল করে দেয় এবং মধ্য ভারতে বাবরের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।


* ৪. ঘর্ঘরার যুদ্ধ (১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ):

    * প্রতিপক্ষ: মাহমুদ লোদি (ইব্রাহিম লোদির ভাই) ও বাংলার শাসক নসরৎ শাহ-এর নেতৃত্বে আফগান বাহিনী।

    * স্থান: বিহারের ঘর্ঘরা নদীর তীরে।

    * গুরুত্ব: এটি ছিল বাবরের শেষ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বাবর স্থল ও জলপথে (নদীর বুকে) উভয় দিক থেকে যুদ্ধ করেন। আফগানদের সংগঠিত প্রতিরোধ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেওয়া হয়। এই জয়ের ফলে বাবরের সাম্রাজ্য পূর্বে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং ভারতে আফগান শক্তির পুনরুত্থানের সম্ভাবনা আপাতত স্তিমিত হয়।


#### ৫. বাবরের শাসন ব্যবস্থা ও অবদান

বাবরের শাসনকাল ছিল তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত (মাত্র ৪ বছর) এবং বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে যুদ্ধবিগ্রহে ব্যয় করতে হয়েছিল। তাই তিনি একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার যথেষ্ট সময় পাননি।


* প্রশাসনিক ভিত্তি: যদিও তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, তবে তিনি তাঁর বিজিত অঞ্চলগুলিকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেন এবং সেগুলিতে নিজস্ব গভর্নর নিযুক্ত করেন।

* 'তুজুক-ই-বাবরী' বা 'বাবরনামা': বাবরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তাঁর আত্মজীবনী 'তুজুক-ই-বাবরী', যা তুর্কি (চাগতাই তুর্কি) ভাষায় রচিত। এটি মধ্যযুগীয় ইতিহাসের একটি অমূল্য উৎস, যেখানে ভারত ও মধ্য এশিয়ার ভূগোল, প্রাণীজগত, উদ্ভিদজগত, জনজীবন, রাজনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এটি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয় 'বাবরনামা' নামে।

* শিল্প ও স্থাপত্য: বাবর উদ্যান (বাগিচা) নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন। তিনি অনেক নতুন সড়ক নির্মাণ ও কুয়ো খননের নির্দেশ দেন।

* ধর্মীয় নীতি: বাবর ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করতেন, যদিও খানুয়ার যুদ্ধে তিনি 'জিহাদ'-এর ডাক দেন।


#### ৬. ভারত আক্রমণের গুরুত্ব ও ফলাফল

বাবরের ভারত আক্রমণ ভারতের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে।


* ১. দিল্লি সালতানাতের অবসান ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা: পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতে প্রায় ৩২০ বছরের দিল্লি সালতানাতের (১২০৬-১৫২৬ খ্রি.) চূড়ান্ত অবসান ঘটায়। এর ফলে ভারতে এক নতুন, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য – মুঘল সাম্রাজ্য – প্রতিষ্ঠিত হয়, যা প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত শাসন করেছিল।

* ২. নতুন যুদ্ধ কৌশল ও সামরিক প্রযুক্তির আগমন: বাবরের আক্রমণের মাধ্যমেই ভারতে উন্নত সামরিক প্রযুক্তি, বিশেষত কামান ও গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহার শুরু হয়। তাঁর তুলঘুমা কৌশল ও অশ্বারোহী বাহিনীর কার্যকর ব্যবহার ভারতীয় সামরিক রণনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।

* ৩. রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতার ভিত্তি স্থাপন: বাবরের বিজয় ভারতে একটি কেন্দ্রীয় শক্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছিল, যা আকবরের সময়ে পূর্ণতা পায়।

* ৪. অর্থনৈতিক প্রভাব: মুঘল সাম্রাজ্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে, যা বাণিজ্য ও কৃষি ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে। যদিও বাবরের শাসনকালে এর প্রভাব সীমিত ছিল, তবে এটি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপন করে।

* ৫. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব: বাবরের আগমনের সাথে ভারতে মধ্য এশীয় ও ফারসি সংস্কৃতির একটি নতুন ঢেউ আসে। এর ফলে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, ইন্দো-পার্সীয় স্থাপত্য শৈলী, চিত্রশিল্প এবং সঙ্গীতকলা ভারতে আরও বিকশিত হয়। মুঘল চিত্রশিল্প ও উদ্যান স্থাপত্যের ভিত্তি তিনিই স্থাপন করেন।

* ৬. প্রশাসনিক সংস্কারের ভিত্তি: যদিও বাবর প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারেননি, তবে তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে শের শাহ সুরি ও আকবরের মতো শাসকদের অধীনে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কারের পথ প্রশস্ত হয়।

* ৭. আফগান শক্তির চূড়ান্ত পরাজয়ের পথ প্রশস্ত: বাবর আফগানদের সাংগঠনিক শক্তিকে বারবার পরাজিত করে তাদের দুর্বল করে দেন, যা শেষ পর্যন্ত শের শাহ ও হুমায়ুনের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের পর আকবরের সময়ে আফগান শক্তির চূড়ান্ত বিলুপ্তির পথ তৈরি করে।


#### ৭. মূল্যায়ন

বাবর ছিলেন একজন অসাধারণ সামরিক প্রতিভা এবং একজন দূরদর্শী শাসক, যিনি নিজের সীমিত সম্পদ ও প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ভারত আক্রমণ শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল না, এটি ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যা আগামী কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতের গতিপথ নির্ধারণ করে। তাঁর উত্তরাধিকার মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ও সমৃদ্ধির মাধ্যমে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।