মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর (শাসনকাল: ১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও সংহতিকারক। তার ৪৯ বছরের দীর্ঘ রাজত্বকালে তিনি কেবল মুঘল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তারই ঘটাননি, বরং সুসংহত প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যবস্থা এবং উদার ধর্মীয় নীতির মাধ্যমে একটি স্থায়ী ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তার সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য তার স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে।
### I. আঞ্চলিক সম্প্রসারণ (Territorial Expansion):
আকবর তার সুদীর্ঘ রাজত্বকালে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তার সম্প্রসারণবাদী নীতিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
* প্রাথমিক পরিস্থিতি (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ): সিংহাসনে আরোহণের সময় আকবরের হাতে শুধুমাত্র দিল্লি, আগ্রা এবং পাঞ্জাবের কিছু অংশ ছিল। এই সময়ে বৈরাম খাঁ তার অভিভাবক ও সেনাপতির ভূমিকা পালন করেন।
* পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ): ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই নভেম্বর আকবরের সেনাপতি বৈরাম খাঁ আফগান সেনাপতি হেমুর নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এটি মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল, কারণ এই জয়ের ফলে মুঘলরা ভারতে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়।
* গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযান ও বিজয়সমূহ:
* মালব (১৫৬১-১৫৬২ খ্রিস্টাব্দ): আকবর প্রথমদিকে মালব জয় করেন। এর শাসক বাজবাহাদুর পরাজিত হন এবং পরবর্তীতে আকবরের মনসবদার হিসেবে যোগদান করেন।
* গোন্দওয়ানা (১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ): রানি দুর্গাবতী এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। আসফ খাঁ-এর নেতৃত্বে মুঘল সেনাবাহিনী গোন্দওয়ানা জয় করে।
* রাজপুতানা: আকবর রাজপুতদের সাথে দুটি নীতি গ্রহণ করেন –
* বৈবাহিক ও মৈত্রী নীতি: তিনি আমের (জয়পুর) এর রাজা ভারমলের কন্যা জোধাবাইকে (মরিয়ম-উজ-জমানি) বিবাহ করেন এবং অনেক রাজপুত রাজাকে উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন (যেমন - মানসিং, ভগবন্ত দাস, টোডরমল)। এই নীতি রাজপুতদের আনুগত্য লাভে সহায়ক হয়েছিল।
* সামরিক নীতি: যারা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেনি, তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হয়। মেবারের রানা প্রতাপ সিং ছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম।
* চিতোর বিজয় (১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ): মেবারের রাজধানী চিতোর আকবরের হাতে পরাজিত হয়।
* রণথম্ভোর বিজয় (১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দ): বুন্দির শাসক সুরজন হাডা পরাজিত হন।
* হলদিঘাটের যুদ্ধ (১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ): রানা প্রতাপ সিং এর সাথে আকবরের সেনাবাহিনীর (মানসিংহের নেতৃত্বে) এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়। যদিও রানা প্রতাপ সম্পূর্ণ পরাজিত হননি, মেবারের একটি বড় অংশ মুঘলদের দখলে আসে।
* গুজরাট বিজয় (১৫৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দ): এটি ছিল আকবরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। গুজরাট ছিল একটি সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং আরব সাগরের বন্দরগুলির উপর মুঘল নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। এই জয়ের স্মারক হিসেবে তিনি ফতেহপুর সিক্রিতে বুলন্দ দরওয়াজা নির্মাণ করেন।
* বাংলা ও উড়িষ্যা বিজয় (১৫৭৬-১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ): মুনিম খাঁ ও টোডরমলের নেতৃত্বে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে দাঊদ খাঁ কররানীকে পরাজিত করে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে উড়িষ্যাও (১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) মুঘলদের অধিকারে আসে। বাংলা ছিল অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
* কাবুল বিজয় (১৫৮১-১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ): আকবরের সৎ ভাই মির্জা হাকিমের বিদ্রোহ দমন করে কাবুল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
* কাশ্মীর ও সিন্ধু বিজয় (১৫৮৬-১৫৯২ খ্রিস্টাব্দ): ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর এবং ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু মুঘলদের দখলে আসে।
* দক্ষিণ ভারত নীতি (দাক্ষিণাত্য নীতি):
* আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি মূলত তিনটি রাজ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়: আহমদনগর, বিজাপুর ও গোলকুন্ডা।
* খান্দেশ (১৫৯১ খ্রিস্টাব্দ): এটি স্বেচ্ছায় মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে।
* আহমদনগর: চাঁদবিবির বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের পরেও ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আহমদনগরের বড় অংশ মুঘলদের হাতে আসে।
* বেরার (১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দ) ও দৌলতাবাদ (১৬০১ খ্রিস্টাব্দ): এই দুটিও মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়।
* আকবরের মৃত্যুর সময় মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে দাক্ষিণাত্যের বেরার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
* সম্প্রসারণের গুরুত্ব:
* এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্য এক বিশাল আকার ধারণ করে, যা ভারতের ইতিহাসে এক বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলির অন্যতম ছিল।
* সমগ্র ভারতের উপর একটি কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠা হয়।
* কৃষি, বাণিজ্য ও অর্থনীতির উন্নতি ঘটে, যা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
* সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি পায়।
### II. মনসবদারি ব্যবস্থা (Mansabdari System):
মনসবদারি ব্যবস্থা ছিল আকবরের প্রবর্তিত একটি অনন্য সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করে। 'মনসব' একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ পদ বা পদমর্যাদা।
* উৎস ও প্রবর্তন: আকবর ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে) তার শাসনকালে মনসবদারি প্রথা প্রবর্তন করেন। এটি চেঙ্গিস খাঁ-এর সামরিক দশমাংশ ব্যবস্থার (Decimal System) উপর ভিত্তি করে তৈরি হলেও আকবর একে নিজস্বতা ও বৈচিত্র্য দান করেন।
* বৈশিষ্ট্যসমূহ:
* পদমর্যাদা ও শ্রেণীবিভাগ: মনসবদাররা সম্রাটের অধীনে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সামরিক পদে নিযুক্ত হতেন। এই পদগুলি বংশানুক্রমিক ছিল না। মনসবদারদের পদমর্যাদা ১০০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত (পরবর্তীতে ৭০০০ পর্যন্ত) ছিল, যা তাদের দায়িত্ব, বেতন এবং সামরিক বাহিনীর আকার নির্দেশ করত।
* জাত (Zat) ও সাওয়ার (Sawar): মনসবদারদের দুটি প্রধান পদমর্যাদা ছিল:
* জাত (Zat): এটি মনসবদারের ব্যক্তিগত মর্যাদা, বেতন এবং প্রশাসনিক পদাধিকার নির্দেশ করত। অর্থাৎ, এটি ব্যক্তির সম্মান ও পদ বোঝাতো।
* সাওয়ার (Sawar): এটি মনসবদারকে কত অশ্বারোহী সৈন্য ও ঘোড়া রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, তা নির্দেশ করত।
* জাত ও সাওয়ারের সম্পর্ক: মনসবদারদের সাধারণত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো:
* যে মনসবদারের জাত ও সাওয়ার সমান, তিনি প্রথম শ্রেণীর মনসবদার।
* যে মনসবদারের সাওয়ার জাতের অর্ধেকের বেশি কিন্তু সমান নয়, তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর মনসবদার।
* যে মনসবদারের সাওয়ার জাতের অর্ধেকের কম, তিনি তৃতীয় শ্রেণীর মনসবদার।
* বেতন ও জায়গির (Jagir): মনসবদাররা নগদ অর্থে (নকদি) অথবা জায়গির (ভূখণ্ডের রাজস্ব অধিকার) হিসেবে বেতন পেতেন। জায়গিরদাররা তাদের নির্দিষ্ট জায়গির থেকে রাজস্ব আদায় করে তার থেকে নিজেদের বেতন ও সৈন্যদের খরচ মেটাতেন। জায়গিরগুলি সাধারণত অস্থায়ী ছিল এবং ঘন ঘন স্থানান্তরিত করা হতো, যাতে কোনো জায়গিরদার স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে না পারে।
* দাগ ও চেহরা প্রথা (Dagh and Chehra System): অশ্বারোহী বাহিনীর মান উন্নত রাখতে এবং দুর্নীতি দমনের জন্য আকবর ঘোড়া দাগানো (দাগ) এবং সৈন্যদের বিবরণী (চেহরা) রাখার প্রথা চালু করেন। এতে নকল ঘোড়া বা সৈন্য দেখিয়ে বেতন নেওয়ার প্রবণতা কমে।
* নিয়োগ ও পদচ্যুতি: মনসবদাররা সরাসরি সম্রাটের দ্বারা নিযুক্ত হতেন এবং সম্রাটের ইচ্ছানুযায়ী পদচ্যুত বা স্থানান্তরিত হতে পারতেন। এতে সম্রাটের ক্ষমতা সুদৃঢ় হয়।
* সর্বভারতীয় চরিত্র: এই ব্যবস্থায় তুর্কি, ইরানি, রাজপুত, আফগান এবং ভারতীয় মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা সাম্রাজ্যের বহুত্ববাদী চরিত্রের পরিচয় দেয়।
* গুরুত্ব:
* কেন্দ্রীয়করণ: এটি সাম্রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনকে সম্রাটের অধীনে কেন্দ্রীভূত করে।
* দক্ষ প্রশাসন: মনসবদারি ব্যবস্থা সাম্রাজ্যকে একটি সুসংহত ও কার্যকরী প্রশাসনিক কাঠামো প্রদান করে।
* সামরিক শক্তি: এর মাধ্যমে একটি বিশাল ও সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব হয়, যা সাম্রাজ্যের বিস্তার ও রক্ষণাবেক্ষণে সহায়ক ছিল।
* আনুগত্য নিশ্চিতকরণ: মনসবদাররা সরাসরি সম্রাটের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন, যা বিদ্রোহের সম্ভাবনা হ্রাস করে।
* জাতীয় ঐক্য: এই ব্যবস্থা বিভিন্ন জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষকে একত্রিত করে সাম্রাজ্যের সেবায় নিযুক্ত করে।
### III. ধর্মীয় নীতি (Religious Policy):
আকবরের ধর্মীয় নীতি ছিল তার শাসনকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তার উদার ও সহনশীল ধর্মীয় নীতি সাম্রাজ্যের সংহতি সাধনে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল।
* নীতি পরিবর্তনের কারণ:
* ব্যক্তিগত অন্বেষণ: আকবর ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় সত্যের সন্ধানী ছিলেন।
* বিভিন্ন ধর্মের সংস্পর্শ: সূফি সাধক শেখ সলিম চিশতি, রাজপুত রানি এবং অন্যান্য ধর্মগুরুদের প্রভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়।
* রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা: ভারতের বিপুল সংখ্যক অমুসলিম প্রজার সমর্থন লাভ এবং সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য একটি উদার নীতির প্রয়োজন ছিল।
* উলেমা বা মোল্লাদের প্রভাব কমানো: উলেমাদের গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিরক্ত হয়ে আকবর তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে চেয়েছিলেন।
* মূল বৈশিষ্ট্য ও পদক্ষেপসমূহ:
* উদারনীতি গ্রহণ (প্রাথমিক সংস্কার):
* তীর্থকর বাতিল (১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ): হিন্দু তীর্থযাত্রীদের উপর ধার্য তীর্থকর বাতিল করেন।
* জিজিয়া কর বাতিল (১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ): অমুসলিমদের উপর ধার্য বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর বাতিল করেন, যা অমুসলিম প্রজাদের কাছে আকবরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে।
* যুদ্ধবন্দীদের দাসত্ব প্রথা বাতিল (১৫৬২ খ্রিস্টাব্দ)।
* রাজপুত নীতি: বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং রাজপুতদের উচ্চ পদে নিয়োগ (যেমন - মানসিং, টোডরমল, বীরবল)।
* হিন্দুদের প্রতি সহনশীলতা: গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা, হিন্দু উৎসবগুলিতে অংশগ্রহণ এবং হিন্দু মন্দির নির্মাণে অনুমতি দান।
* ইবাদতখানা (উপাসনা কক্ষ) প্রতিষ্ঠা (১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ):
* ফতেহপুর সিক্রিতে আকবর বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন ও মতবাদের আলোচনার জন্য 'ইবাদতখানা' নির্মাণ করেন।
* শুরুতে কেবল মুসলিম ধর্মগুরুদের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকলেও, পরে হিন্দু, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান (যেমন - পাদ্রি অ্যাকোয়াভিভা, ফাদার মানসারাট) এবং সুফি সাধকদেরও অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়।
* এই আলোচনার মাধ্যমে আকবর অনুভব করেন যে, সব ধর্মেই কিছু সত্য নিহিত আছে এবং কোনো ধর্মই এককভাবে চূড়ান্ত সত্যের দাবিদার নয়।
* মহজরনামা (Infallibility Decree) জারি (১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ):
* ইবাদতখানার বিতর্কের পর আকবর বুঝতে পারেন যে, উলেমা বা ধর্মীয় পণ্ডিতরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছেন।
* তিনি শেখ মোবারক, ফৈজি ও আবুল ফজলের সহায়তায় একটি দলিল বা ঘোষণাপত্র (মহজর) জারি করেন, যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে ধর্মীয় বিষয়ে চূড়ান্ত বিচারক বা ব্যাখ্যাদাতা (ইমাম-ই-আদিল বা মুজতাহিদ) হিসেবে ঘোষণা করেন।
* এর ফলে উলেমাদের ক্ষমতা খর্ব হয় এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ধর্মীয় হস্তক্ষেপের পথ বন্ধ হয়।
* দীন-ই-ইলাহি (Tauhid-i-Ilahi) প্রবর্তন (১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ):
* ইবাদতখানার আলোচনা ও মহজরনামা জারির পর আকবর 'দীন-ই-ইলাহি' প্রবর্তন করেন। এটি কোনো নতুন ধর্ম ছিল না, বরং বিভিন্ন ধর্মের ভালো দিকগুলির সমন্বয়ে গঠিত একটি দার্শনিক মতবাদ বা নৈতিক আদর্শের সমষ্টি ছিল।
* এর মূল ভিত্তি ছিল সুলহ-ই-কুল (Sulh-i-Kul) বা 'সর্বজনীন শান্তি ও সম্প্রীতি'।
* দীন-ই-ইলাহির মূলনীতিগুলি ছিল: ঈশ্বর এক (তৌহিদ-ই-ইলাহি), অহিংসা, বিশ্বস্ততা, উদারতা, সদিচ্ছা, ক্ষমা, দয়া ও সহনশীলতা।
* এর অনুসারীর সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত (আবুল ফজল, ফৈজি, বীরবল প্রমুখ)।
* সুলহ-ই-কুল (সর্বজনীন শান্তি ও সম্প্রীতি):
* আকবরের ধর্মীয় নীতির মূলমন্ত্র ছিল 'সুলহ-ই-কুল', যার অর্থ সবার প্রতি শান্তি ও সম্প্রীতি।
* এই নীতির মাধ্যমে আকবর ধর্মীয় ভেদাভেদ দূর করে সকল প্রজাকে সমান চোখে দেখতেন।
* এটি তার সকল রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক নীতির ভিত্তি ছিল।
* গুরুত্ব:
* সাম্রাজ্যের সংহতি: আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি অমুসলিম প্রজাদের আনুগত্য লাভে সহায়ক হয়েছিল এবং সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি করেছিল।
* ধর্মীয় বিভেদ হ্রাস: এই নীতি সমাজে ধর্মীয় বিদ্বেষ কমিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি করে।
* রাজনীতির ধর্মনিরপেক্ষতা: আকবর ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেন, যা মুঘল সাম্রাজ্যের সুস্থিতি নিশ্চিত করে।
* সংস্কৃতির বিকাশ: বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে, যা শিল্পকলা, সাহিত্য ও স্থাপত্যের বিকাশে সহায়তা করে।
উপসংহার:
আকবরের দূরদর্শী আঞ্চলিক সম্প্রসারণ, সুসংহত মনসবদারি ব্যবস্থা এবং উদার ধর্মীয় নীতি মুঘল সাম্রাজ্যকে একটি বিশাল, শক্তিশালী ও স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। তার এই পদক্ষেপগুলি কেবল তার রাজত্বকালকেই নয়, বরং পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের শাসনকেও প্রভাবিত করেছিল এবং ভারতের ইতিহাসে এক স্বর্ণময় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। আকবরকে "জাতীয় সম্রাট" (National Monarch) হিসেবে অভিহিত করা হয় তার এই বহুত্ববাদী ও সংহতিকারী নীতির জন্য।