জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ (An overview of the reigns of Jahangir and Shahjahan)

ইতিহাস সিলেবাসের প্রেক্ষাপটে জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বকাল নিয়ে বিস্তারিত নোট দেওয়া হলো।

মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে আকবরের উত্তরসূরি হিসেবে জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তাদের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো, শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ পরিবর্তন আসে।


 ১. জাহাঙ্গীর (Nur-ud-din Muhammad Salim Jahangir)

রাজত্বকাল: ১৬০৫-১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ জাহাঙ্গীরের প্রকৃত নাম ছিল নূরউদ্দিন মুহাম্মদ সেলিম। তিনি আকবরের পুত্র ছিলেন এবং 'জাহাঙ্গীর' উপাধির অর্থ 'বিশ্ববিজয়ী'। তাঁর রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য সামরিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং শিল্পকলা, বিশেষত চিত্রকলার ব্যাপক বিকাশ ঘটে।


১.১. প্রারম্ভিক চ্যালেঞ্জ ও বিদ্রোহ:

   খসরুর বিদ্রোহ (১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ): সিংহাসনে আরোহণের পরপরই জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র খসরু (খুররমের ভাই) বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহে শিখ গুরু অর্জুন দেব খসরুকে আশীর্বাদ ও আর্থিক সহায়তা করায় জাহাঙ্গীর তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এটি মুঘল-শিখ সম্পর্কের অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।


১.২. নূরজাহানের প্রভাব:

   মেহেরুন্নিসা (নূরজাহান): জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মেহেরুন্নিসা (পরবর্তীতে নূরজাহান) ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা জাহাঙ্গীরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

   ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু: যদিও জাহাঙ্গীর সার্বভৌম শাসক ছিলেন, নূরজাহান পর্দার আড়াল থেকে রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন। তাঁর নামে মুদ্রা জারি হয়েছিল এবং তাঁর পিতা ইতমাদ-উদ-দৌলা ও ভাই আসফ খান সহ শাহজাদা খুররমকে (পরবর্তীকালে শাহজাহান) নিয়ে গঠিত 'নূরজাহান জুন্টা' (Junta) বেশ প্রভাবশালী ছিল।


১.৩. সামরিক অভিযান ও সাম্রাজ্য বিস্তার:

   মেবারের বিজয়: দীর্ঘদিনের প্রতিরোধের পর, মেবারের রাজপুত রানা অমর সিংহ (মহারানা প্রতাপের পুত্র) ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেন। এটি মুঘলদের একটি বড় সামরিক ও কূটনৈতিক বিজয় ছিল, কারণ আকবর তা করতে পারেননি। মুঘলরা মেবারের প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করে।

   কাংড়া জয় (১৬২০ খ্রিস্টাব্দ): শক্তিশালী কাংড়া দুর্গ জয় করেন।

   দাক্ষিণাত্য নীতি: দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের সাফল্য সীমিত ছিল। আহমদনগরের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি মালিক অম্বর এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং মুঘল সেনাবাহিনীকে বারবার পরাজিত করেন। যদিও শাহজাদা খুররমকে দাক্ষিণাত্য জয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তা পুরোপুরি সফল হয়নি।


১.৪. শিল্পকলা ও স্থাপত্য:

   চিত্রকলা: জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল মুঘল চিত্রকলার স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। তিনি নিজে একজন শিল্পরসিক এবং চিত্র সমালোচক ছিলেন। তাঁর দরবারের বিখ্যাত চিত্রকরদের মধ্যে মনসুর (উদ্ভিদ ও প্রাণীর চিত্রণে পারদর্শী) এবং আবুল হাসান (পোর্ট্রেট ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্রণে দক্ষ) অন্যতম।

   স্থাপত্য: জাহাঙ্গীরের স্থাপত্যে তাঁর পিতা আকবরের প্রভাব দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল: আগ্রার আকবরের সমাধি (সিকান্দ্রা)।

       আগ্রার ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধি: এটি সম্পূর্ণ শ্বেতপাথরে নির্মিত প্রথম মুঘল স্থাপত্য। এতে প্রথম 'পিয়েত্রা দুরা' (Pietra Dura) বা রঙিন পাথর খোদাই করে নকশা করার কৌশল ব্যবহৃত হয়।

   সাহিত্য: জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনী 'তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী' বা 'জাহাঙ্গীরনামা' (ফারসি ভাষায়) রচনা করেন। এটি মুঘল আমলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উৎস।


১.৫. ইউরোপীয় বণিকদের আগমন:

   ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স এবং ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস রো জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন। তারা ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের অধিকার লাভ করেন, যা ভবিষ্যতে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ খুলে দেয়।


১.৬. ধর্মীয় নীতি:

   জাহাঙ্গীর আকবরের মতো উদার ছিলেন না, তবে আওরঙ্গজেবের মতো গোঁড়াও ছিলেন না। তবে শিখ গুরু অর্জুন দেবের মৃত্যুদণ্ড এবং কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংসের ঘটনা তাঁর ধর্মীয় নীতিতে গোঁড়ামির ইঙ্গিত দেয়।




 ২. শাহজাহান (Shahab-ud-din Muhammad Khurram Shah Jahan)

রাজত্বকাল: ১৬২৮-১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ শাহজাহানের প্রকৃত নাম ছিল খুররম। তিনি 'শাহজাহান' উপাধির অর্থ 'জগতের অধিপতি' গ্রহণ করেন। তাঁর রাজত্বকালকে মুঘল সাম্রাজ্যের "স্বর্ণযুগ" বলা হয়, বিশেষত স্থাপত্যের ক্ষেত্রে।


২.১. প্রারম্ভিক চ্যালেঞ্জ ও বিদ্রোহ:

   সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তিনি বুন্দেলার জমিদার জুঝার সিংহ এবং দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহী খান জাহান লোদির বিদ্রোহ দমন করেন, যা তাঁর শাসনের প্রাথমিক স্থিতিশীলতা প্রমাণ করে।


২.২. সামরিক অভিযান ও সাম্রাজ্য বিস্তার:

   দাক্ষিণাত্য নীতি: শাহজাহান দাক্ষিণাত্য নীতিতে আরও আগ্রাসী ছিলেন।

       আহমদনগর: ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে আহমদনগর সম্পূর্ণরূপে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

       বিজাপুর ও গোলকুন্ডা: এই দুটি রাজ্যকে মুঘলদের করদ রাজ্য হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য করেন।

   উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত: তিনি কান্দাহার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন, যা মুঘলদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের শাহের কাছে কান্দাহার চূড়ান্তভাবে হাতছাড়া হয়।

   মধ্য এশিয়া অভিযান: মধ্য এশিয়ায় (বলখ ও বদখশান) মুঘল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং এতে রাজকোষের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়।


২.৩. স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ:

   শাহজাহানের রাজত্বকালকে মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তাঁর নির্মিত স্থাপত্যগুলি মুঘল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি শ্বেতপাথর ও মার্বেলের ব্যাপক ব্যবহার করেন।

   তাজমহল: আগ্রায় তাঁর প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতিতে নির্মিত এই সৌধটি বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। এটি শ্বেতপাথরে নির্মিত এবং পিয়েত্রা দুরা শিল্পের এক অসাধারণ উদাহরণ। প্রধান স্থপতি ছিলেন উস্তাদ আহমেদ লাহোরি (ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে)।

   দিল্লির স্থাপত্য:

       লালকেল্লা: সম্পূর্ণ লাল বেলেপাথরে নির্মিত এই দুর্গটি মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দেওয়ান-ই-আম (সাধারণের দরবার কক্ষ) এবং দেওয়ান-ই-খাস (ব্যক্তিগত দরবার কক্ষ)।

       জামা মসজিদ: ভারতের বৃহত্তম মসজিদগুলির মধ্যে অন্যতম।

       মতি মসজিদ: আগ্রা ফোর্টের মধ্যে অবস্থিত এটি একটি অপূর্ব শ্বেতপাথরের মসজিদ।

   ময়ূর সিংহাসন: বিখ্যাত কোহিনূর হীরা খচিত এই সিংহাসনটি তাঁর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল, যা রাজকীয় ঐশ্বর্যের প্রতীক ছিল।


২.৪. অর্থনীতি ও প্রশাসন:

   শাহজাহানের সময়ে মুঘল অর্থনীতি বেশ সমৃদ্ধ ছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করে।

   তবে, তাঁর বিশাল স্থাপত্য নির্মাণ প্রকল্পগুলির কারণে রাজকোষে প্রচুর চাপ সৃষ্টি হয় এবং কৃষকদের উপর করের বোঝা বৃদ্ধি পায়।


২.৫. ধর্মীয় নীতি:

   আকবর ও জাহাঙ্গীরের তুলনায় শাহজাহান ছিলেন কিছুটা বেশি রক্ষণশীল ও গোঁড়া সুন্নি মুসলিম। তিনি কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংসের আদেশ দেন এবং ধর্মান্তরের প্রতি উৎসাহ দেখান। তবে তিনি পুরোপুরি অসহিষ্ণু ছিলেন না।


২.৬. উত্তরাধিকার যুদ্ধ ও গৃহবন্দিত্ব (১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ):

   শাহজাহানের অসুস্থতার সুযোগে তাঁর চার পুত্রের (দারা শিকোহ, আওরঙ্গজেব, শাহ সুজা ও মুরাদ বখশ) মধ্যে সিংহাসন দখলের জন্য এক ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়।

   এই যুদ্ধে আওরঙ্গজেব জয়ী হন এবং শাহজাহানকে আগ্রা দুর্গে গৃহবন্দী করেন। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


উপসংহার:

জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বকাল মুঘল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ছিল। জাহাঙ্গীরের সময়ে চিত্রকলা বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছায়, অন্যদিকে শাহজাহানের সময়ে স্থাপত্যশিল্প তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এই দুই শাসকের অধীনে মুঘল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিস্তারও অব্যাহত থাকে, যদিও শাহজাহানের শেষ জীবনে উত্তরাধিকার যুদ্ধ সাম্রাজ্যের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, যা পরবর্তীকালে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের বীজ বপন করে।