ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগের সূচনা হয় তুর্কি আক্রমণের মাধ্যমে। একাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে সুলতান মামুদ গজনির ১৭ বার ভারত আক্রমণ এবং দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মুহাম্মদ ঘোরির আক্রমণ ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনে। মুহাম্মদ ঘোরির মৃত্যুর পর তার সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে এক নতুন মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা 'দিল্লি সুলতানি' নামে পরিচিত। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩২০ বছর ধরে এই সুলতানি সাম্রাজ্য ভারতে শাসন করে। এই সময়ের প্রধান রাজবংশগুলি ছিল দাস (মামলুক), খলজি, তুঘলক, সৈয়দ এবং লোদি। বর্তমান আলোচনায় প্রথম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
সুলতানি আমলের কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও তাদের গ্রন্থাদির বর্ণনা
### ১. দাস রাজবংশ (মামলুক রাজবংশ) (১২০৬-১২৯০ খ্রিস্টাব্দ)
* প্রতিষ্ঠাতা: কুতুবউদ্দিন আইবক (১২০৬-১২১০ খ্রি.): মুহাম্মদ ঘোরির মৃত্যুর পর ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তাঁকে ভারতে মুসলিম শাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* 'লক বকশ' (লক্ষদাতা) নামে পরিচিত ছিলেন।
* দিল্লিতে কুওয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ এবং কুতুব মিনার-এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন (ইলতুৎমিশ সম্পন্ন করেন)।
* আজমিরে আড়াই দিন কা ঝোপড়া নির্মাণ করেন।
* রাজধানী প্রথমে লাহোরে ছিল, পরে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করেন।
* ১২১০ খ্রিস্টাব্দে পোলো (চৌগান) খেলতে গিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যান।
* ইলতুৎমিশ (১২১১-১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ): কুতুবউদ্দিনের জামাতা ও দাস। দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পরিচিত।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* ১২১১ খ্রিস্টাব্দে আরাম শাহকে পরাজিত করে সিংহাসনে বসেন।
* দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
* সুলতানি সাম্রাজ্যের সংহতি ও প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করেন।
* ইকতা প্রথা (সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেতনের পরিবর্তে ভূমি প্রদানের ব্যবস্থা) চালু করেন।
* 'তুর্কি-ই-চাহালগানি' বা 'চল্লিশ চক্র' নামে একটি শক্তিশালী অভিজাতবর্গ গঠন করেন, যা সুলতানকে শাসনকাজে সহায়তা করত।
* রৌপ্য মুদ্রা 'টংকা' এবং তাম্র মুদ্রা 'জিতল' প্রচলন করেন।
* চেঙ্গিজ খানের আক্রমণের হাত থেকে দিল্লি সুলতানিকে রক্ষা করেন (খাওয়ারিজম শাহকে আশ্রয় না দিয়ে)।
* কুতুব মিনার-এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।
* সুলতানা রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রিস্টাব্দ): ইলতুৎমিশের কন্যা এবং দিল্লি সুলতানির একমাত্র নারী শাসক।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* তিনি একজন দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন।
* পুরুষের পোশাক পরিধান করে দরবারে আসতেন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
* অভিজাতদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন এবং ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন।
* গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ): ইলতুৎমিশের চল্লিশ চক্রের অন্যতম সদস্য এবং দাস বংশের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* সুলতানি সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকে সুসংহত করেন।
* 'লৌহ ও রক্ত নীতি' (Blood and Iron Policy) গ্রহণ করেন, যার মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন ও অভ্যন্তরীণ শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
* রাজার দৈব সত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং নিজেকে 'জিল-ই-ইলাহি' (আল্লাহর ছায়া) বলতেন।
* দরবারে সিজদা (সুলতানের সামনে নতজানু হওয়া) ও পাইবস (সুলতানের পায়ে চুম্বন) প্রথা চালু করেন।
* চল্লিশ চক্রের ক্ষমতা হ্রাস করেন এবং প্রয়োজনে তাদের ধ্বংস করেন।
* একটি শক্তিশালী গুপ্তচর ব্যবস্থা (বারিক) গড়ে তোলেন।
* সামরিক বিভাগ 'দেওয়ান-ই-আর্জ' পুনর্গঠন করেন।
* মঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সীমান্তে শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করেন।
* তাঁর শাসনকালে পারসিক উৎসব 'নওরোজ' প্রচলন করেন।
* দাস বংশের পতন: বলবনের মৃত্যুর পর তার অযোগ্য উত্তরাধিকারী কায়কোবাদ ও কায়ুমার্সের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জালালউদ্দিন খলজি ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দাস বংশের শেষ শাসক কায়ুমার্সকে হত্যা করে খলজি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এটি 'খলজি বিপ্লব' নামে পরিচিত।
### ২. খলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০ খ্রিস্টাব্দ)
* প্রতিষ্ঠাতা: জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি (১২৯০-১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ): দাস বংশের অভিজাতদের উৎখাত করে তিনি সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন তুলনামূলকভাবে দয়ালু ও সহনশীল শাসক।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* পুরাতন তুর্কি অভিজাতদের প্রভাব হ্রাস করে নতুন খলজি অভিজাতদের উত্থান ঘটান।
* ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই ভাইপো ও জামাতা আলাউদ্দিন খলজি তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন।
* আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ): খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ এবং দিল্লি সুলতানির অন্যতম শক্তিশালী শাসক।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* সাম্রাজ্যবাদী নীতি: দক্ষিণ ভারতে প্রথম মুসলিম সুলতান হিসেবে অভিযান পরিচালনা করেন (মালিক কাফুরের নেতৃত্বে)। দেবগিরি, ওয়ারাঙ্গল, দ্বারসমুদ্র, মাদুরাই পর্যন্ত তাঁর সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়।
* বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি: একটি সুসংগঠিত বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল কম খরচে একটি বিশাল সেনাবাহিনী পরিচালনা করা এবং মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা।
* বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেন।
* শস্যের জন্য শাহানা-ই-মান্ডি (বাজার পরিদর্শক) এবং বস্ত্র, চিনি ইত্যাদির জন্য সরাই-ই-আদল নামক বাজার স্থাপন করেন।
* গোয়েন্দা (বারিক) ও গুপ্তচর (মুনহিয়ান) নিয়োগ করেন বাজার তদারকির জন্য।
* ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করলে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল।
* সামরিক সংস্কার:
* সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রথম স্থায়ী ও বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন।
* সেনাবাহিনীতে 'দাগ' (ঘোড়ার গায়ে চিহ্ন) এবং 'হুলিয়া' (সৈন্যদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা) প্রথা চালু করেন, যাতে দুর্নীতি ও ছদ্মবেশ রোধ করা যায়।
* সৈন্যদের নগদ বেতনের ব্যবস্থা করেন।
* ভূমি রাজস্ব সংস্কার:
* জমির পরিমাণ অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করেন।
* ভূমির উৎপাদনের ৫০% রাজস্ব হিসাবে আদায় করা হত।
* দু-আবের উপর অতিরিক্ত কর (চরই ও ঘরই) আরোপ করেন।
* 'খামস' (যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ৫ ভাগের ৪ ভাগ) রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার নির্দেশ দেন।
* ধর্মীয় নীতি: উলেমাদের প্রভাব হ্রাস করেন এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেন। "রাজত্ব কোনো ধর্মের ওপর নির্ভরশীল নয়" - তাঁর বিখ্যাত উক্তি।
* নির্মাণ কাজ: আল্লাই দরওয়াজা, সিড়ি দুর্গ, হাজার স্তম্ভযুক্ত প্রাসাদ, হাওজ খাস নির্মাণ করেন।
* খলজি বংশের পতন: আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার অযোগ্য উত্তরাধিকারী ও মালিক কাফুরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হয়। শেষ খলজি শাসক মুবারক শাহকে হত্যা করে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নতুন তুঘলক বংশের সূচনা করেন।
### ৩. তুঘলক রাজবংশ (১৩২০-১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ)
* প্রতিষ্ঠাতা: গিয়াসউদ্দিন তুঘলক (১৩২০-১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ): খলজি বংশের পতনের পর তিনি সিংহাসনে বসেন এবং তুঘলক বংশের সূচনা করেন।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশাসক ছিলেন।
* কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে মনোযোগী হন এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন।
* 'তুঘলকাবাদ' নামে নতুন শহর ও দুর্গ নির্মাণ করেন।
* ১৩০টি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।
* মুহাম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ): গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের পুত্র। তাঁকে 'পাগলা রাজা' বা 'বিচিত্র রাজা' বলা হয় তার কয়েকটি বিতর্কিত ও ব্যর্থ প্রকল্পের জন্য।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৭ খ্রিস্টাব্দ): দিল্লি থেকে দেবগিরি (দাক্ষিণাত্যে দৌলতাবাদ নামকরণ) তে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, যা চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। জলের অভাব, পথের কষ্ট, স্থানীয় বিরোধিতার কারণে অনেক মানুষ মারা যায় এবং পরে রাজধানী আবার দিল্লিতে ফিরিয়ে আনতে হয়।
* প্রতীকী মুদ্রা প্রচলন (১৩২৯-১৩৩০ খ্রিস্টাব্দ): রৌপ্য মুদ্রার অভাব মেটাতে তামা ও ব্রোঞ্জের প্রতীকী মুদ্রা প্রচলন করেন। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও অভিজ্ঞতার অভাবে ব্যাপক জাল মুদ্রা তৈরি হয়, যার ফলে অর্থনীতির পতন হয়।
* দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি (১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ): গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন ভালো হওয়া সত্ত্বেও তিনি কর বৃদ্ধি করেন। সে বছর খরার কারণে উৎপাদন কমে যায় এবং অতিরিক্ত করের ফলে কৃষকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়।
* খোরাসান ও কারাচিল অভিযান: দূরবর্তী খোরাসান ও কারাচিল জয়ের জন্য বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং ব্যয়বহুল অভিযান চালান, যা সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়।
* কৃষি সংস্কার: কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য 'দেওয়ান-ই-কোহি' নামে একটি নতুন কৃষি বিভাগ চালু করেন এবং 'সোনধার' নামক কৃষি ঋণ প্রদান করেন, যা খুব একটা সফল হয়নি।
* তাঁর রাজত্বকালে মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা ভারতে আসেন এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব-উর-রাহলা' (সফরনামা) তে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের বর্ণনা দেন।
* তাঁর সময়েই বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সুলতানির দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়।
* ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ): মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ভ্রাতুষ্পুত্র। তুলনামূলকভাবে জনকল্যাণমুখী শাসক ছিলেন।
* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
* জনকল্যাণমূলক কাজ: অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেন, যেমন - সেচের জন্য বহু খাল খনন (যমুনা-সুতলেজ সংযোগ খাল), বাঁধ নির্মাণ, পানীয় জলের ব্যবস্থা, বহু শহর নির্মাণ (ফিরোজাবাদ, হিসার, ফতেহাবাদ, জৌনপুর)।
* হাসপাতাল স্থাপন: 'দার-উল-শিফা' নামে সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
* কর্মসংস্থান ও জনসেবা: বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান ব্যুরো ও দরিদ্রদের জন্য 'দেওয়ান-ই-খয়রাত' (দান বিভাগ) প্রতিষ্ঠা করেন। দাসদের জন্য 'দেওয়ান-ই-বন্দাগান' নামে একটি পৃথক বিভাগ ছিল (তাঁর ৩০,০০০ দাস ছিল)।
* অর্থনৈতিক সংস্কার: জনগণের উপর থেকে অনেক অপ্রয়োজনীয় কর তুলে দেন এবং কুরআন অনুমোদিত ৪টি কর (খামস, খারাজ, যাকাত, জিজিয়া) চালু রাখেন।
* ধর্মীয় নীতি: গোঁড়া সুন্নি মুসলিম ছিলেন। ব্রাহ্মণদের উপর প্রথম জিজিয়া কর আরোপ করেন।
* সামরিক দুর্বলতা: সামরিক ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারের নীতি চালু করেন, ফলে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি কোনোরূপ সাম্রাজ্যবাদী অভিযান চালাননি।
* প্রশাসনিক দুর্বলতা: তিনি সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে তুঘলক বংশের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
* তুঘলক বংশের পতন: ফিরোজ শাহ তুঘলকের দুর্বল প্রশাসনিক নীতি এবং অযোগ্য উত্তরাধিকারীদের কারণে সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লং-এর ভারত আক্রমণ দিল্লি সুলতানির ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয় এবং তুঘলক বংশের চূড়ান্ত পতন ঘটে।
### উপসংহার:
দাস, খলজি এবং তুঘলক রাজবংশ দিল্লি সুলতানিকে ভারতে একটি শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্যে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই রাজবংশগুলি যেমন সাম্রাজ্য বিস্তারে, তেমনি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে অবদান রেখেছিল। বিশেষ করে আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং মুহাম্মদ বিন তুঘলকের বিভিন্ন পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ আধুনিক ইতিহাসের গবেষকদের কাছে আজও আলোচনার বিষয়। তবে, প্রতিটি রাজবংশের পতনই তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অভিজাতদের ষড়যন্ত্র এবং অযোগ্য উত্তরাধিকারীদের ফলস্বরূপ ঘটেছিল, যা সুলতানি সাম্রাজ্যের পরবর্তী যুগের ভিত্তি তৈরি করে।
FAQ Questions Answers 100
1. দিল্লি সুলতানির প্রতিষ্ঠা কবে হয়?
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে।
2. দিল্লি সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
কুতুবউদ্দিন আইবক।
3. দাস রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
কুতুবউদ্দিন আইবক।
4. দাস রাজবংশের অপর নাম কী?
মামলুক রাজবংশ।
5. কুতুব মিনার নির্মাণ কাজ কে শুরু করেন?
কুতুবউদ্দিন আইবক।
6. কুতুবউদ্দিন আইবক কীভাবে মারা যান?
চৌগান খেলার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে।
7. কুতুবউদ্দিন আইবকের পর কে দিল্লির সুলতান হন?
ইলতুৎমিশ।
8. ইলতুৎমিশ কত খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন?
১২১১ খ্রিস্টাব্দে।
9. চল্লিশ চক্র বা বন্দেগান-ই-চাহালগানি কে গঠন করেন?
ইলতুৎমিশ।
10. দিল্লির প্রথম মহিলা সুলতান কে ছিলেন?
রাজিয়া সুলতানা।
11. রাজিয়া সুলতানা কার কন্যা ছিলেন?
ইলতুৎমিশের।
12. গিয়াসউদ্দিন বলবন কোন রাজবংশের সুলতান ছিলেন?
দাস রাজবংশ।
13. বলবনের আসল নাম কী ছিল?
উলুগ খান।
14. বলবন কী নীতি গ্রহণ করেছিলেন?
লৌহ ও রক্ত নীতি।
15. সিজদা ও পাইবস প্রথার প্রচলন কে করেন?
গিয়াসউদ্দিন বলবন।
16. দাস রাজবংশের শেষ সুলতান কে ছিলেন?
কায়কোবাদ।
17. খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি।
18. খিলজি বিপ্লব কবে ঘটে?
১২৯০ খ্রিস্টাব্দে।
19. জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজিকে কে হত্যা করেন?
আলাউদ্দিন খিলজি।
20. আলাউদ্দিন খিলজির আসল নাম কী ছিল?
আলি গুরশাপ।
21. আলাউদ্দিন খিলজি কী উপাধি গ্রহণ করেন?
সিকান্দার-ই-সানি বা দ্বিতীয় আলেকজান্ডার।
22. আলাউদ্দিন খিলজির দক্ষিণ ভারত অভিযানের প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন?
মালিক কাফুর।
23. আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতির প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ।
24. আলাউদ্দিন খিলজি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নতুন দুটি দপ্তর কী ছিল?
দিওয়ান-ই-রিয়াসাত ও শাহানা-ই-মান্ডি।
25. আলাউদ্দিন খিলজি কোন কৃষি-সম্পর্কিত কর প্রবর্তন করেন?
চরাই (চারণভূমি কর) ও ঘরাই (গৃহ কর)।
26. আলাই দরওয়াজা কে নির্মাণ করেন?
আলাউদ্দিন খিলজি।
27. খিলজি রাজবংশের শেষ সুলতান কে ছিলেন?
কুতুবউদ্দিন মোবারক শাহ খিলজি।
28. তুঘলক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক।
29. গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আসল নাম কী ছিল?
গাজী মালিক।
30. তুঘলকাবাদ শহর কে প্রতিষ্ঠা করেন?
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক।
31. মোহাম্মদ বিন তুঘলকের আসল নাম কী ছিল?
জুনা খান।
32. কোন সুলতানকে 'পাগলা রাজা' বলা হয়?
মোহাম্মদ বিন তুঘলক।
33. মোহাম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজধানী কোথা থেকে কোথায় স্থানান্তরিত করেন?
দিল্লি থেকে দেবগিরি (দৌলতাবাদ)।
34. মোহাম্মদ বিন তুঘলক কোন প্রতীকী মুদ্রা চালু করেন?
তামা ও পিতলের মুদ্রা।
35. ইবনে বতুতা কার রাজত্বকালে ভারতে আসেন?
মোহাম্মদ বিন তুঘলকের।
36. ফিরোজ শাহ তুঘলক কার সম্পর্কিত ভাই ছিলেন?
মোহাম্মদ বিন তুঘলকের চাচাতো ভাই।
37. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন নতুন কর আরোপ করেন?
সেচ কর (হক-ই-শার্ব)।
38. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন জনহিতকর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন?
দিওয়ান-ই-খাইরাত ও দিওয়ান-ই-বন্দগান।
39. ফিরোজ শাহ তুঘলক দ্বারা নির্মিত দুটি প্রধান শহর কী কী?
ফিরোজাবাদ ও ফতেহাবাদ।
40. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান?
খাল খনন।
41. তুঘলক রাজবংশের শেষ শাসক কে ছিলেন?
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ তুঘলক।
42. তিমুরের ভারত আক্রমণ কার রাজত্বকালে ঘটে?
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ তুঘলকের।
43. ইকতা প্রথার প্রচলন কে করেন?
ইলতুৎমিশ।
44. ইকতা প্রথা কী ছিল?
সামরিক কর্মকর্তাদের বেতন হিসেবে ভূমি অনুদান।
45. কোন সুলতান হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর পুনরায় আরোপ করেন?
ফিরোজ শাহ তুঘলক।
46. তুর্কি-ই-চাহালগানি ভেঙে দেন কে?
গিয়াসউদ্দিন বলবন।
47. দাস রাজবংশ কত সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে?
১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
48. খিলজি রাজবংশ কত সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে?
১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
49. তুঘলক রাজবংশ কত সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে?
১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
50. দিল্লি সুলতানির শাসনের প্রধান ভাষা কী ছিল?
ফার্সি।
51. কুতুবউদ্দিন আইবক কখন নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন?
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে।
52. ইলতুৎমিশ কী উপাধি গ্রহণ করেছিলেন?
সুলতান-ই-আজম।
53. ইলতুৎমিশের শাসনকালে দিল্লি সুলতানির রাজধানী কোথায় ছিল?
দিল্লি।
54. ইলতুৎমিশ কোন মুদ্রা চালু করেন?
তঙ্কা ও জিতল।
55. রাজিয়া সুলতানা কত সালে সিংহাসনচ্যুত হন?
১২৪০ খ্রিস্টাব্দে।
56. বলবন কোন বংশের লোক ছিলেন?
ইলবারী তুর্কি।
57. বলবনের সভাকবি কে ছিলেন?
আমির খসরু।
58. বলবন কোন পার্সি উৎসবের প্রবর্তন করেন?
নওরোজ।
59. বলবন প্রবর্তিত সামরিক বিভাগের নাম কী ছিল?
দিওয়ান-ই-আর্জ।
60. দাস রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কাকে বলা হয়?
ইলতুৎমিশকে।
61. দাস রাজবংশের শেষ উল্লেখযোগ্য শাসক কে ছিলেন?
গিয়াসউদ্দিন বলবন।
62. খিলজি বিপ্লবের মাধ্যমে কোন রাজবংশ ক্ষমতাচ্যুত হয়?
দাস রাজবংশ।
63. জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি কোন বছর সিংহাসনে বসেন?
১২৯০ খ্রিস্টাব্দে।
64. জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি কী নীতি গ্রহণ করেছিলেন?
উদার নীতি।
65. আলাউদ্দিন খিলজি কখন সিংহাসনে বসেন?
১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে।
66. আলাউদ্দিন খিলজির রাজস্ব ব্যবস্থার নাম কী ছিল?
দিওয়ান-ই-মুস্তখরজ।
67. আলাউদ্দিন খিলজির সেনাবাহিনী কেমন ছিল?
স্থায়ী ও সুসংগঠিত।
68. আলাউদ্দিন খিলজি কোন দুর্গ নির্মাণ করেন?
সিরি দুর্গ।
69. আলাউদ্দিন খিলজি দ্বারা প্রবর্তিত গুপ্তচর ব্যবস্থার নাম কী ছিল?
বারিদ।
70. আলাউদ্দিন খিলজি কোন কর চালু করেন পশুপালনের উপর?
চরাই ও ঘারি।
71. আলাউদ্দিন খিলজি কোন বিখ্যাত ঐতিহাসিককে পৃষ্ঠপোষকতা করেন?
আমির খসরু।
72. খিলজি রাজবংশের পতনের পর কোন নতুন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে?
তুঘলক রাজবংশ।
73. গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কোন পদ থেকে সুলতান হয়েছিলেন?
পাঞ্জাবের গভর্নর।
74. গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ডাকনাম কী ছিল?
গাজী মালিক।
75. গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন?
খসরু খান।
76. মোহাম্মদ বিন তুঘলকের কোন প্রকল্প কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে?
দোয়াবে রাজস্ব বৃদ্ধি।
77. মোহাম্মদ বিন তুঘলক কোন কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন?
দিওয়ান-ই-কোহি।
78. মোহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে বিদ্রোহের সংখ্যা কেমন ছিল?
অনেক বেশি।
79. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন?
নির্মাণ কার্য ও জনহিতকর কাজ।
80. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন মসজিদ নির্মাণ করেন?
কোটলা ফিরোজ শাহ মসজিদ।
81. ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক নির্মিত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাল ব্যবস্থার নাম কী?
যমুনা খাল।
82. ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকালে প্রচলিত একটি নতুন মুদ্রা কী ছিল?
অর্ধ।
83. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন কর রহিত করেন?
২৮ প্রকারের অ-ইসলামিক কর।
84. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন দাসদের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন?
দিওয়ান-ই-বুন্দাগান।
85. তুঘলক রাজবংশের পতনের প্রধান কারণ কী ছিল?
তৈমুরের আক্রমণ।
86. তৈমুরের ভারত আক্রমণের সময় দিল্লির সুলতান কে ছিলেন?
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ তুঘলক।
87. দিল্লি সুলতানির যুগে ফারসি ভাষার গুরুত্ব কী ছিল?
এটি ছিল সরকারি ভাষা।
88. দিল্লি সুলতানির শাসনব্যবস্থা মূলত কিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল?
শরিয়ত আইন।
89. দাস রাজবংশকে কেন 'দাস' রাজবংশ বলা হয়?
কারণ এর প্রথম দিকের শাসকরা সুলতানদের দাস বা সামরিক অধিনায়ক ছিলেন।
90. খিলজি বংশের শাসকরা জাতিতে কী ছিলেন?
তুর্কি-আফগান।
91. তুঘলক বংশের শাসকরা জাতিতে কী ছিলেন?
তুর্কি।
92. দাস রাজবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ কোনটি?
কুতুব মিনার।
93. কুতুব মিনার কোন সূফী সাধকের নামে উৎসর্গীকৃত?
কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী।
94. রাজিয়া সুলতানা পুরুষের পোশাক পরে কী করতেন?
উন্মুক্ত দরবারে বসতেন ও হাতির পিঠে চড়ে বের হতেন।
95. বলবন নিজেকে কার বংশধর মনে করতেন?
কিংবদন্তি ইরানি রাজা আফ্রাসিয়াবের।
96. আলাউদ্দিন খিলজি তার সেনাবাহিনীতে কী পদ্ধতি চালু করেন?
দাগ ও হুলিয়া।
97. আলাউদ্দিন খিলজি তার সাম্রাজ্যকে কীভাবে সংগঠিত করেছিলেন?
শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন দ্বারা।
98. মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সাম্রাজ্যে বিদ্রোহের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কী ছিল?
তার বিভিন্ন পরীক্ষামূলক ও দূরদর্শী কিন্তু ব্যর্থ প্রকল্প।
99. ফিরোজ শাহ তুঘলক কোন মুসলিম ধর্মীয় আইন কঠোরভাবে অনুসরণ করেন?
শরিয়ত আইন।
100. দিল্লি সুলতানির যুগে বিচার ব্যবস্থার প্রধান কে ছিলেন?
কাজী-উল-কুজ্জাত।